
খুচরো কথা চারপাশে
ইন্ডিয়া ইউনাইটেড বনাম সেলিব্রিটিদের শানে-নজুল
সুনীল শর্মাচার্য
ইন্ডিয়া ইউনাইটেড বনাম সেলিব্রিটিদের শানে-নজুল
একজন পপ তারকার একটা এক লাইনের ট্যুইট সামলাতে আপাতত আর কঙ্গনার মতো সুস্থ মানুষজনকে দিয়ে কাজ হচ্ছে না, ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক থেকে প্রাক্তন ক্রিকেটার অবধি শাসক দলের পুরো টিম নেমে পড়েছে। মোটামুটি সবার এক রা, ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, ভারত বুঝে নেবে, পরে একটা হ্যাশট্যাগ জুড়েছেন, ইন্ডিয়া ইউনাইটেড!
এই পুরো ব্যাপারটার সবচেয়ে হাস্যকর দিক কোনটা জানেন? মার্কিন ক্যাপিটলে হামলার পরে পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখান থেকে প্রতিবাদ বা নিন্দা বা কটাক্ষ বা একেবারে কাঁচা খিল্লি আসেনি। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং হ্যাঁ, এশিয়া বা আফ্রিকা থেকেও ধেয়ে গিয়েছিল ট্যুইট। যে তালিকায় ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিজি নিজেই।
‘অব কি বার, ট্রাম্প সরকার’ বলে ট্রাম্পের পিঠ চুলকে আসার পরে সেই ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা দেখেই মোদিজি সটান লিখেছিলেন, ‘distressed to see news about rioting and violence in DC।’ যেটা বলার, তখনো ট্রাম্পের আওতায় থাকা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে, কিন্তু এর জন্য কোনো প্রতিবাদ আসেনি। কেউ বলেনি আপ কৌন হ্যায় বে, ইন্টারনাল ব্যাপারে নাক গলানেওয়ালা?
আসলে, যে কোনো আধুনিক, উন্নত দেশেই এগুলো হয় না। ব্রেক্সিট নিয়ে ট্যুইট করলে ব্রিটিশ বিদেশ দফতর কিছু বলে না, ইয়েলো ভেস্ট নিয়ে ট্যুইট করলে ফরাসি প্রশাসন প্যারিসে ঢুকতে দেব না বলে শাসায় না। ট্যুইট নিয়ে মাথা ঘামানো ছাড়াও তাদের অন্য কাজ থাকে।
অদ্ভুতভাবে, ঠিক এই যুক্তিতে দেখলে, তাহলে জার্মান ছাড়া নাৎসি অত্যাচার নিয়ে কারোর কথা বলা চলে না। কাম্বোডিয়ান ছাড়া পল পটের জেনোসাইড নিয়ে কারোর কথা বলা চলে না। জাতে রুশ না-হলে অ্যলেক্সেই ন্যাভালনির গ্রেফতারি নিয়ে কথা বলা চলে না। বর্মীয় না-হলে মায়ানমারে এই মুহূর্তে চলা ক্যু নিয়ে কারোর কথা বলা চলে না। ইজরায়েলি বা প্যালেস্টাইনি না-হলে গাজা নিয়ে কথা বলা চলে না। ব্রাজিলীয় না-হলে আমাজন ধ্বংস করা নিয়ে কথা বলা চলে না। মিশরীয় না-হলে সেখানকার বিক্ষোভ নিয়ে কথা বলা চলে না। স্পেনীয় না-হলে কাতালোনিয়া আন্দোলন নিয়ে কথা বলারই অধিকার নেই।
সবচেয়ে বড় কথা, ঠিক একই যুক্তিতে দেখলে, পাকিস্তানের হিন্দু হত্যা বা বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নিয়েও কথা বলা চলে না, তাই না? সেগুলোও তো ভৌগলিকভাবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘটছে। চিন হংকং-এ যে অকথ্য সন্ত্রাস করছে, সেটা নিয়েও কি কথা বলা চলে?
অথচ এখানেই কিন্তু মজা। ভারতের একটা গোটা আইন আনা হয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের কথা ভেবে। স্বাধীনতার আগে এরা এক দেশ ছিল—এই যুক্তিও খাটে না, কেননা আফগানিস্তান দেশভাগের ফলে সৃষ্ট নয়। সেটা নিয়ে কথা বলেছেন স্বয়ং ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিদেশমন্ত্রী নন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
অথচ ভারতের অভ্যন্তরে চলা একটা কৃষক বিক্ষোভ—যা নিয়ে গোটা বিশ্ব সরব, যার কথা লাগাতারভাবে প্রকাশ করেছে সমস্ত আন্তর্জাতিক মিডিয়া—যা নিয়ে মতামত দিয়েছে বিবিসি, সিএনএন, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্টের মতো কাগজ; সেটা নিয়ে কেউ কথা বললেই রে রে করে উঠছে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক।
মোদীজি ক্যাপিটল হিল হামলা নিয়ে ট্যুইট করেন, কিন্তু কৃষক বিক্ষোভ নিয়ে কথা বললে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে কড়কানি দেন। কথা ওঠে, পপ তারকা রাজনৈতিক ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন কেন?
আসলে এটাও আমাদের ঐ একটি ধানের শিষের ওপর একটু শিশির বিন্দুতে আটকে থাকা কূপমণ্ডূকতা। একটা তুলনা বারবার চলে, আমেরিকা ও ভারত, পৃথিবীর প্রাচীনতম গণতন্ত্র ও বৃহত্তম গণতন্ত্র। অথচ এক হিসেবে এই ব্যাপারে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের কোনো তুলনাই চলে না।
রাজনীতি যে জীবনে কীভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, তা অন্তত হলিউড বারবার মেনে আসছে। বহু হলিউড তারকা বিশ্বজোড়া নানা মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সরব। গোটা রক, ব্লু’জ বা পপ সঙ্গীতের ইতিহাসেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে রাজনীতি। বিটলস, পিট সিগার, জোন বায়েজ, রজার ওয়াটারস, বব ডিলানের গান রাজনীতি ছাড়া অসম্পূর্ণ।
একালে, এই একুশ শতকেও ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বিক্ষোভে এক ধাক্কায় সারা হলিউড দাঁড়িয়ে যান বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে। অন্তত একজন বড়মাপের শিল্পীকেও পাওয়া যায় না, যে দক্ষিণপন্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
শুধু হলিউড কেন? সমাজের প্রতিটি স্তরে। মনে করুন—মেগান রাপিনো। নারী ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক বলেছিলেন, ট্রাম্পকে তিনি পাত্তা দেন না। মনে করুন, ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিকে। ২০০ মিটার রেসে সোনা ও ব্রোঞ্জ জিতলেন দুই কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন খেলোয়াড়—টমিস্মিথ ও জন কার্লোস।
পোডিয়ামে উঠেছেন, সঙ্গে রূপোজয়ী অস্ট্রেলিয়ার পিটার নর্মান, তিনি শ্বেতাঙ্গ। শুরু হলো জাতীয় সঙ্গীত, কালো গ্লাভস পরে ডান হাত মুঠো করে উপরে তুললেন দুই মার্কিন, বর্ণবিদ্বেষের প্রতিবাদে। তীব্র সমালোচনা হলো, শাস্তি হলো, দুই খেলোয়াড়ের পরিবারের কাছে খুন করার হুমকি এলো। দমেনি কেউ। দমেনি সেই পোডিয়ামের শ্বেতাঙ্গ নর্মানও। সমর্থন জানিয়েছিলেন তিনিও।
বাকিটা ইতিহাস। আজও এই ঘটনা ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’ বলে ইতিহাসে বন্দিত। ২০০৮ সালে মেলবোর্নে নিজের বাড়িতে পিটার নর্মানের প্রয়াণের পর তাঁর কফিন বাহক হয়েছিলেন সুদূর আমেরিকা থেকে উড়ে আসা তাঁর সেদিনের দুই সঙ্গী—স্মিথ আর কার্লোস।
এক দেশ থেকে অন্য দেশে খোঁচা মারা, ব্যঙ্গের ঘটনাও কম নেই। খুব সাম্প্রতিক একটা ঘটনা বলি : ২০২০ বাফটা পুরস্কার, ব্রিটিশ ফিল্ম ও টেলিভিশন অ্যাকাডেমির সর্বোচ্চ সম্মান। ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন হলিউড’-এর জন্য সেরা সাপোর্টিং অভিনেতার পুরস্কার পেলেন ব্র্যাড পিট, আমেরিকান। তিনি আসেননি, পুরস্কার নিতে এলেন মার্গো rabi, অস্ট্রেলিয়ান। তাঁর হাতে ব্র্যাডের পাঠানো ধন্যবাদ-জ্ঞাপক ভাষণ।
সেটা শুরু হলো এইভাবে : ‘Hey Britain? How did you just become single? Welcome to the club!’ সারা অডিটোরিয়ান হাসিতে ফেটে পড়ল। অবশ্যই কটাক্ষের লক্ষ্য ব্রেক্সিট। নিজের দেশে, অস্কারের মঞ্চেও অবিশ্যি ব্র্যাড এরকমই। ওই একই ছবির জন্য অস্কার জিতে মঞ্চে বলেছিলেন, ‘আমাকে বলার জন্য ৪৫ সেকেন্ড দেওয়া হয়েছে, সেনেট জন বোল্টনকে যতটা সময় দিয়েছে, তার থেকেও ৪৫ সেকেন্ড বেশি…’
আমাদের অবস্থা এতটাই দীন যে, আমাদের এখানে তারকারা সকলেই চেষ্টা করেন শাসকের নেকনজরে থাকার, শাসকের সঙ্গে ছবি তোলার। যাতে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়। সে বলিউড হোক বা ক্রিকেট। তাই চাষিদের বিক্ষোভ নিয়ে রিহানার ট্যুইটের পরে ভারতের ঐক্য নিয়ে ট্যুইট করতে হয়—করণ জোহর, অক্ষয়কুমার থেকে শচীন টেন্ডুলকার, অনিল কুম্বলেকে।
জামিয়া মিলিয়ায় পুলিশি হামলার পরেও চুপ থাকেন প্রাক্তনী বীরেন্দ্র শেবাগ। যদিও চক্ষুলজ্জার খাতিরে জেএনইউ-এর উপর বিজেপির হামলার পর কিন্তু প্রতিবাদ করেছিলেন সরকারে থাকা দুই জেএনইউ প্রাক্তনী—নির্মলা সীতারামণ ও জয়শংকর।
অমিতাভ বচ্চন ও শচীন টেন্ডুলকার, ভারতের দুই সর্বকালের সেরা নায়কই নিজের জগতের বাইরে বিস্ময়কর রকমের নিশ্চুপ বা শাসক-ঘেঁষা। অথচ আজ শাসকের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামা সাধারণ মানুষই তাঁদের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিল, এখনো দেয়।
তাই আমাদের এখন মুখ বাঁচাতে ধরতে হয় ঐক্য নষ্ট হওয়ার ভয়। গেল গেল রব ওঠে, সবাই চেঁচিয়ে বলেন—ইন্ডিয়া ইউনাইটেড! যদিও স্বাধীনতার পর ৭৪ বছর ধরেই ভারত ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।
পৃথিবীর আর কোনো দেশে ২২টি অফিশিয়াল ভাষা আছে বলে জানা নেই, পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত রকম ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি, পোশাক, রান্না, নৃত্য, সঙ্গীত, হস্তশিল্প আছে বলে জানা নেই।
জরুরি অবস্থা, বাবরি মসজিদ, শিখ হামলা, গুজরাট দাঙ্গার পরেও, ভারতের ঐক্যকে টলানো যায়নি। কারণ ভারতের ঐক্য তো তার বৈচিত্র্য। ঐক্য চেঁচিয়ে বলার বিষয় নয়, তা উপলব্ধির বিষয়, অনুভবের বিষয়।
‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান/ বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।’ এই বিবিধকে পালটে ‘এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম’ যারা আনতে চায়, তাদেরই বারবার ‘ইন্ডিয়া ইউনাইটেড’ বলে চেঁচাতে হয়। এ কি অদ্ভুত মজা, তাই না?
আসলে এই আমাদের অবস্থা। আমরা চেঁচাই ‘বাইরের লোক আমাদের নিয়ে কথা বলবে কেন?’ অথচ আমাদের উপনিষদ বলে—‘বসুধৈব কুটুম্বকম’। জওহরলাল নেহরু, রাজীব গান্ধী বা মনমোহন সিং তো বটেই, এই শ্লোক বলেছেন অটলবিহারী বাজপেয়ীও।
সম্পূর্ণ শ্লোকটা এরকম :
‘অয়ং নিজঃ পরো বেতি গণনা লঘুচেতসাম
উদারচরিতানাং তু বসুধৈব কুটুম্বকং।।’
দেবনাগরী থেকে বাংলায় তুলে দিলাম, ব্যবহার নেই বলে ‘দ’-এর জায়গায় ‘ব’ করেছি। অর্থাৎ, ‘এটা আমার, ওটা অপরের, এগুলো লঘুচেতারাই ভাবে। উদারচরিত বুদ্ধিমানরা ভাবে, সারাবিশ্বই আমার পরিবার।’
শুধু কি তাই? ১৯২১ সালে এক বিখ্যাত বাঙালি একটি দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তাঁর মন্ত্র রেখেছিলেন, ‘যত্র বিশ্ব ভবত্যেকনীড়ম’—বিশ্ব যেথায় এক নীড়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল ‘বিশ্বভারতী’, প্রতিষ্ঠাতা—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প: সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হাল্কা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
রাজনীতি বোঝো, অর্থনীতি বোঝো! বনাম ভারতের যুবসমাজ
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
ভারতের CAA NRC নিয়ে দু’চার কথা
ভারতের এবারের বাজেট আসলে অশ্বডিম্ব, না ঘরকা না ঘাটকা, শুধু কর্পোরেট কা
8 thoughts on “ইন্ডিয়া ইউনাইটেড বনাম সেলিব্রিটিদের শানে-নজুল”