
ও ভাই
প্রদীপ মিত্র
ও ভাই : প্রদীপ মিত্র
করো না বায়ুদূষণ করো না সীমা লঙ্ঘন
করো না নদীবন্ধন করো না পাহাড় কর্তন
করো না বৃথা আক্রমণ করো না সংক্রমণ
পথের মাঝে পথ হারালে আড়াল থেকে কেমনে করব জগত সংসারে চলন ফেরন
আমার উত্তরণ নাই-বা হলো তাই বলে তোমার চলন, তোমার বলন
করো না করো না তোমার ও রাঙাচরণ অমন করে সঞ্চালন…
ও ভাই : প্রদীপ মিত্র
করো না কূটিল কীর্তন করো না আকাশ ধর্ষণ
করো না মন্দবর্ধন করো না হিংসার রন্ধন
করো না কোলাকুলি করো না হুলাহুলি
দম ফুরালে দমের ভেতর দম দমা দম দমটা ভাই কেমনে আসে
হাটের ভেতর হিরিক মিরিক শেকড় কেটে শেকল বাঁধা পায় কেমনে হাঁটা যায়;
গাছের ডালে চিলের মাছি উল্টে-পাল্টে কোথায় বা কারে ভালোবাসে
থোকায় থোকায় জোনাকজ¦লা রাতটা আমার কেমনে কেমনে হারিয়ে যায়; হারিয়ে যায়…!
আদার ব্যাপারী জাহাজ ঘাটায় কী চায় কী চায় ওরে, ও মন মাঝি ভাই;
করো না করো না ওর সাথে ইতি উতি; উত্তরে নাই দক্ষিণে যাই; নাই সে উপায়
ও ভাই, এ দিন দুনিয়ায় একী দেখি করোনা নামটার মারাত্মক উঁকিঝুঁকি; ও ভাই…
ও ভাই : প্রদীপ মিত্র
অসফল করো না আমার কর্তব্য অস্বচ্ছল ঘরে সবে বেন্ধেছি মাঝি রে তোর
সুখের দোর আমার ঘরে বোধের দোল, দোল দোল দোলনা; ও কী,
তবুও যে খুকুর চোখে ঘুম আসে না ঘুম আসে না। বুঝলে, জগতসখী
কী এক অদ্ভুত করোনা, করোনা, করোনায় জাগে রৌদ্রভোর!
যেন দিবানিশি জুজুভয়; যুদ্ধ ভয়ের চেয়েও ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কিত ভয়; সখা,
চল চলা চল চলাও নাই ফেরাও নাই; হাত ধরাধরি ধরাও নাই; যাওয়াও নাই;
যাওয়ার মাঝে অনেক ভয়, অনেক ভয় যেন ভয় বাহাদুর নাকি ভয় ভয় চাপ
ভয় ভয়ঙ্কর অনেক রূপের মারাত্মক ডাক, ও ডাকটা তার গুমোটফাঁকা।
গুমোটগরম গোমরামুখো ধোঁয়ার ভেতর আঁধার যথা যেন আঁধার ঘরে সাপ
সাড়া ঘরে সাপ। কোথায় খুঁজব কোথায় খুঁজব ধনীর দুনিয়া
এক কায়দায় এক পায়েই হাঁপায় সমুদ্র-মুনিয়া?
.
ঢাকা কোলকাতা, আসাম আসানসোল, আফগান, বাগদাদ, আলজেরিয়া, নিউজার্সি;
আফ্রিকা কুয়েত আরব আবুধাবী; থিম্পু, মরক্কো, ফ্রান্স, কলোম্ব-করাচি, কাঞ্চী-কাশী।
কাশ্মীর, কানাডা, পানামা, পাবনা, হংকং; সিঙ্গাপুর, সিংহল-সাংহাই, উহান, পাটনা;
বেলজিয়াম, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া; ব্রুনাই, নেপোলি-বার্সনোলা, স্পেন, ইতালি, রাশিয়া।
দিল্লি; ইরাক-ইরান-আমেরিকা, নিউ ইয়র্ক; লাদাখ, হ্যানয়; লেবানন, আর্জেন্টিনা।
মালী-গাজা, রুশ-রোম; তাসখন্দ, তানজিনিয়া, মক্কা-মদিনা, বাহরাইন, রোমানিয়া।
করাচি, পাঞ্জাব, কাবুল; নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড; মরিশাস; ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, জাপান
কাঠমুণ্ড, কোরিয়া; তাইওয়ান, বেইজিং, বলিভিয়া, মিসর, মায়ানমার, গাম্বিয়া জার্মান।
ইন্দোনেশিয়া; সুইডেন, সুদান-তুরস্ক, বুদাপেস্ট—থরথর কাঁপে আইএলও;
ফিফা অলিম্পিক আইসিসি; হলিউড, বলিউড, ঢালিউড, সার্ক, ইউএন, পিএলও
হঠাৎ ছড়ায় আলো না অন্ধকার, অন্ধকার, অন্ধকার! কোথায় হু? হু কোথায়…?
পেট ফাঁপা, রাতের গভীরে বৈষম্যের সামান্য চেরাগ জ¦লে চাঁদের দোলায়!
ও ভাই : প্রদীপ মিত্র
কারখানা থেকে কারাগার; বাসস্ট্যান্ড থেকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া;
আইএমএফ; ওয়াইসি, জাহাজঘাটা কিংবা এয়ারলাইন এয়ারপোর্ট
অ্যারোড্রাম; ড্রামাহাউজ অথবা পাঁচতারকা হোটেল-মোটেল; সাগরবাড়ির ছায়া;
পাহাড়লোকের ঝর্ণা-হাওয়ার দোল; রেলস্টেশন; হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট।
টেম্পু হাঁকিয়ে ঘাম দরদর ছুটে আসা মিষ্টিমুখের মিস্ট্রেস আর তার কলকল
গলার দম্ভের রোলকল সবই কী এক স্তব্ধ নিশানায় দিয়েছে বেজায় ধোঁকা;
হাস্যফোয়ারার রৌদ্রসঙ্গীতের তারে তারে পরীক্ষার কক্ষে লুকায়নি কেউ
নকল-টকল বিদ্যালয়ের মাঠের সতেজ ঘাসের শিরে শিরে কিংবা সরল
শরীরের কোষে কোষে; গ্রন্থাগারের টিউবলাইট পায়নি আঙুলের টোকা।
প্রথম বৈশাখ বরণের রমনার ছায়ানটেও আসেন নাই মঙ্গলপ্রাণের ঢেউ-
জাগা মঙ্গল রবীন্দ্রনাথ। সন্ধ্যাকীর্তনের মাদলের দোলে তালে নাচে নাই,
সাজে নাই গৌড় ও নিতাই; ব্রহ্মাপুত্রের স্মরণে পাপনাশিনী বারুণীর পুণ্যস্নানের
আঞ্জামে কাউকে কেউ ডাকে নাই; পীর-কুতুবের ডাক কেউ শোনে নাই।
আমি বিষাদের মেঘরোদে রোদে হাতড়ে ফিরেছি ঢের স্মৃতি। পূর্বপুরুষের;
নদীর পবিত্রতা কেউ মানে নাই; সমুদ্রগর্জনেও সাধ্যমতো শুদ্ধ হতে কেউ
এতটুকু চায় নাই। চারদিকে ছুটছে ফিনাক আত্মদম্ভের বিশাল ঢেউ…
.
ভাইরে কে আর হৃদয় খুঁড়তে চায়! মায়ের চোখের জলে জায়নামাজও
ভিজে যায়; কালের কাকের ডাক কেউ শোনে নাই; ও সখী, ঐ তোর জাও…
তাইরে নাইরে নাইরে তাইরে নাই নাই আমার যাবার জায়গা কোথাও নাই;
নাই নাই ঘরের ভেতর ঘর নাই; বন্ধুর ভেতর বন্ধু নাই; আশার আলোও নাই
নদী নাই গীতি নাই প্রীতি নাই জলের ভেতর জল নাই; জ্বালা নাই তালা;
ও সখী আমার, তোর ঐ মধুমুখী মুখ কেমন অমন ভীষণ করুণকালা…!
ও ভাই : প্রদীপ মিত্র
হৃদয়ের জ্বালা হৃদয়ে হৃদয় পোড়ে; বনে বনে উড়ে টারকি মাড়কি ঠেলা
আমার ত্বরিত উন্নয়ননেশা প্রবৃদ্ধির চমৎকার অহঙ্কার আশা; এ যে ছলাকলা
‘ভাবি নাই এমনও দিন আসিবে কী কখনও’ ভাবীর হাতের নাড়-মোয়া
যেন রাধার মাথার কাঁঠালটা ‘হাটের ভেতর ভাঙ্গিয়া বিলাইলাম কাঁঠালের কোয়া’।
হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া
ময়লা কয়লা না যায় গো ধোয়া জোড়া লাগে না বেহায়া পায়া।
এ জগত মাঝে কে আর আছেন আমার মতোন এতো অতো হাবাগোবা
আমার এবার না হলো গো দেখা ঐ না ঐ আমার প্রাণপ্রিয়পবিত্র কাবা।
কাবার পাথরে নিষিদ্ধ আমার চুমা। হায় দৈব-দূষণের ভয়ঙ্কর পাপ!
হৃদয়ের তাপ হৃদয়ে হৃদয়ে বাড়ে; বাড়ে অসম-বণ্টন, সাম্যহীনতার শাপ;
‘মা-বাপেরে ফালাইয়া পোলায় যায়রে পালাইয়া; পোলা যায় লাশটা থুইয়া
আর সবার দিনটা কাটে ঝিমাইয়া ঝুমাইয়া; জগত কাঁন্দল ফুঁপাইয়া’…।
ও ভাই : প্রদীপ মিত্র
এ সময়ে দেখি নদীর বুকের একবিংশ-হংস
রাখে, মনোহরী আনন্দের শুদ্ধরাগ
নদী আমার তিথির তীর্থ; নদী আমার প্রাণের উৎস;
মৎস্য-শস্য-চাষবাসের বিপ্লবীভাগ।
ও ভাই : প্রদীপ মিত্র
নদী যে আমার জীবনের ধন সুপবিত্র গায়ত্রী মন্ত্রের মতো স্পষ্ট, স্বচ্ছ তার ধার
নদীর বিশাল অনুরাগে অনুরাগে রবীন্দ্রনাথের পদ্মার নিঃস্ব ঢেউয়ে ঢেউয়ে গাঁথি
নদীদের মনোময় আভা। আমার বুকের ভেতর পৃথিবীর নদীমাতা, নদীপাড়।
করুণ গলায় দুলে দুলে ওঠা সুরে দেখি অদ্বিতীয় এক বিশ্বরূপ। ও আমার সাথী;
অবিরাম ঢেউ তুলে গান গেয়ে যায় প্রত্নজনা : গঙ্গেচ যমুনে চৈব গোদাবরী
সরস্বতী নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু।’ এমতো আমার নদী হয়
পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’—নদী আমার, আমার নদী বিভাবরী।
তার কিছু হলে প্রাণ খুলে সহস্রধারায় কাঁদি। কাঁদে যেমন জননীহারা সন্তানহৃদয়…
আমিও নদীর দুঃখে কাঁদি, বুক তুলে পাঠ করি : ফুলজোড়-করতোয়া; আমাজান,
মিসিসিপি, টেমস, ম্যাকেঞ্জি, ইয়ানটেজি, হুয়াঙ্গ হো, মেনি, নিগার-আমুর, হান।
কঙ্গো, লেনা, মেকঙ্গ, পারানা, ম্যুয়ে-ডাবলিং, ভোলগা, সাত ইল আরব, ইয়াংজি,
সিন্ধু, ইউকোন, সাও ফ্রান্সসিকো, সেলউইন, নিগারা, রিও গ্রান্ডডি, জামবেজি।
লওয়ার টানগুস্কা, আরাগুয়াইয়া, আমু, দরিয়া, জাগুরা, নেলসন, রিও প্যারাগুয়ে,
টোকানটিস, ধানুর, উড়াল, উড়াঙ্গি, ইসিক, রেড, নেগ্রো, দজলা, আপার ওয়ে।
টাইগ্রিস, অব ইরিটিস, পার্ল সিকাঙ্গ, ওহিয়ো, এলিস্টেনি, নর্দান সালাডো,
অরিনিকো, কলোম্বিয়া, অরেঞ্জ, ভিটিম; তাপাজস, ডন, স্টনি, আঙ্গারা-সেলেঙ্গা,
পেসোরা, লিম্পোয়ো, কামা, স্নেক, সেনেগাল, উরুগুয়ে ব্লু নীলাই, খাতাঙ্গা।
চুরচুলি, ডিনিপার, আলদান, ওলেনইয়োক, সেন্ট লরেঞ্জ, উড়াল, কোলোরাডো।
ইন্ডিগিরকা, ইসিক, রেড কাসাই, রাইন, ভোল্টা, লোমামি, টবোল, ফোয়াত, জর্জিনা,
কোপার-বারকো, বারমেজো, ফ্লাই, ভিসটুলা, গিলা, ভোনেটস, ম্যাগডালেনা।
প্লাটি, জুব্বা, পেকোস, খোপার, টাগুস, লি, বেনু, ইয়ামুনা, ওকা, ম্যারানোন,
পিউরাস, চেনাব-গাম্বিয়া, জরুয়া, কলিমা, ওকাভাঙ্গো, ইসেকিউবো, ইয়েলোস্টোন।
নদী নদী কোথা যাও
বাপ-ভাইয়ের বার্তা দাও!’
তুমি হে রবীন্দ্রনাথের পদ্মা আব্বাসউদ্দীনের ধরলা
তুমি হে ম্যাক্সিম গোর্কির ভোলগা চন্ডীদাসের যমুনা
তুমি হে শেকসপিয়রের টেমস…
ও ভাই : প্রদীপ মিত্র
ও আমার গঙ্গা, কুঙ্গা, গালোয়ান, সন্ধ্যা; জাহ্নবী-নারদ, হংস, দামোদর, মধুমতী,
বুড়িগঙ্গা, সোমেশ্বরী, বহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, গৌরী; কালীগঙ্গা, সুতী, ডাকাতিয়া,
কুশিয়ারা, হরিণবেকের তিতাস, হাঁসাইগাড়ি, বালু, নাগর-তুরাগ, তিস্তা, ভাগিরথী,
ঢেপা, নাফ, ফেণী; সুরমা-বাঙ্গালী, বিষখালী-কর্ণফুলী, কীর্তিনাশা; করতোয়া।
বংশী, বংশাই, কুমার, ধরলা; জলাঙ্গী, ইছামতী; পদ্মা-মেঘনা-যমুনাবতী সরস্বতী;
নাগেশ্বরী, গুড়; যাদুকাটা, আলোকি-চকরিপাশা, শঙ্কর-টাঙ্গুয়া, চলতি-গোমতী।
খোয়াই-গোমাই, মৃগী, মাতামুহুরী, আত্রাই; মহানন্দা, হালদা-ঝিনাই, হাড়িধোয়া;
ধলেশ্বরী, বুড়া, গড়াই-পশুর, গৌড়াঙ্গ, বড়াল, আগুনঝালা; নান্দিনা-আগুনমুখা;
ডাকুয়া, সুগন্ধা-বাদলাবাসা, রূপসা-আঙ্গরাকান্না, কংশ, চিত্রা, আড়িয়াল খাঁ।
নবগঙ্গা, ডোপা, বলেশ্বর, নরসুন্ধা; চন্ডীজন, চুনা; শোন, পাটলাই, তেঁতুলিয়া।
মনু-ধনু, দুধকুমার, মানাস, রমনা, দেউতি-বামনি, বুড়িতিস্তা, চেঙ্গি, মাথাভাঙ্গা;
মগড়া, কাপ্তাই, বরাক-অজয়, জাফলং, ঘাঘট, ভৈরব, দশানি, চিকনাই, মাইলডাঙ্গা।
কহুয়া-ভোগাই, সুরেশ্বর, লোভা; ফকিরনী, সারী-শিব; সপ্তমুখী, চেল্লাখালী, গেড়া;
সুতাবাড়িয়া, পাগলা. শাকবাড়িয়া, কালিন্দী, সারিগোয়াইন; মালঞ্চ, মাদার, তারা।
আছে যত পৃথিবীতে যতবিধ খালবিল, নদ-নদী, দিঘি-নালা; ভবদহ পুকুর-চলনবিল;
সতত শাশ্বত সৌন্দর্যের ধারে ‘স্রোতশীল হও নদী’ গভীর গম্ভীর; হও গো চিরায়ুষ্মতী…।
মৎস্য-মকর-হাঙ্গর, জলপিপি; ঝিনুক-পাখির কল্লোলের ডানামেলা আকাশের চিল;
কপোতাক্ষ নদের আনন্দে মধু মধু বলে মধুরসন্তান; নদীর তরঙ্গে রাখে নির্মলপ্রণতি…
ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি। ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি।
আমরা নদীর গতি চাই আমরা নদীর প্রীতি চাই
আমরা নদীর শক্তি চাই আমরা নদীর আয়ু চাই
আমরা নদীর জল চাই আমরা নদীর শস্য চাই
আমরা নদীর কোল চাই আমরা নদীর বোল চাই
আমরা নদীর জোয়ার চাই আমরা নদীর হাওয়া চাই
ও ভাই আমরা বহতা নদীর শুদ্ধ-শুচি হাওয়া চাই
আমরা আকাশ নদীর হাওয়া চাই আমরা আকাশ নদীর রৌদ্র চাই
ঐ আকাশনদীর জীবন
চাই হে সত্যের উদ্ভাসন…
6 thoughts on “ও ভাই : প্রদীপ মিত্র”