
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা
সুনীল শর্মাচার্য
কবিতার ভাষা নিয়ে যখন কিছু বলতে যাই, তখনই মনে প্রশ্ন জাগে—কবিতার, না কবির ভাষা? নির্বিশেষ ‘কবিতার ভাষা’ ব’লে কিছু আছে কি? এক একজন কবি, তার ভাষার ভাণ্ডার থেকে নিজভাষা নির্মাণ করেন, অবশ্যই তাৎপর্য পূর্ণ কবির কথাই বলছি।
এ ভাষার ভাণ্ডার নানাভাবে গড়ে ওঠে—মানুষের কথকতায়, দৈনন্দিন আদান-প্রদানের স্রোতে আবার ঐ ভাষাই ইতোমধ্যে যে কবিতা বা সাহিত্য তৈরি করছে তাতেও।
একজন বড় কবি নিজের সিলমোহর ঐ উভয় পরম্পরার ওপর বসিয়ে দেন। কবির ভাষা তাই এক রকম নয়, নির্বিশেষ কবিতার ভাষাও নেই। সময় বিশেষ পরিস্থিতি কবির বীক্ষাভূমি এসবের
মিথষ্ক্রিয়ায় কবির ভাষা তৈরি হয়। আর সেখানে আধুনিক প্রাক-আধুনিক উত্তর আধুনিক—এরকম কোন অনড় ছাপ থাকে না। জীবনানন্দের কবির ক্রিয়া (হাঁটিতেছি) সাহিত্যের ভাষায় সে অর্থে ‘আধুনিক’ নয়, সুধীন্দ্রনাথের বহু শব্দই প্রচলিত আধুনিকের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবে না। অথচ তাঁরা আমাদের দুজন প্রবলভাবে আধুনিক কবি।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর এক সময়ের ভাবাদর্শে কবিতার ভাষাকে করে তুলেছিলেন দৈনন্দিন মুখের ভাষার অনুরূপ, আবার তাঁর পরের সময়ের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এমন কবিতা পাই—যার চাল-চলন ভাষা যেন আগের যুগের।
তাই আমরা যে কবিতার ভাষা ও তার সংকটের কথা বলতে চাই—তা আসলে কবির ভাষার।
কবি একজন পরিশ্রমী ভাষা-শ্রমিক, তাঁর কাজ তাঁর ভাষার পূর্ণ সম্ভবনাকে বিকশিত করে তোলা।
কিন্তু তাঁর কবিতার মালিক তিনি নন। প্রথমত, ভাষা তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, যে ভাষা নিয়ে তাঁর কাজ সেই ভাষার পরম্পরা আছে, বিবর্তন আছে, বদ্ধতা আছে, সীমা আছে—তাঁর আগেই এর অনেকটা গঠিত হয়ে গেছে। সেই ভাষায় আরো অনেকে কথা বলে, লেখে।
কবি সেই ভাষাকে ব্যবহার করেন, নতুন তাৎপর্য দেন, কিন্তু কখনোই সম্পত্তির মালিকের মতো ইচ্ছা হলে, তাকে ধ্বংস করে অপচয় করতে পারেন না; অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা কবিতায় অচল।
দ্বিতীয়ত, ভাষা-শ্রমিক হিসাবে যখন কবি একটি কাজ সম্পূর্ণ করেন, তখনই সেটি আর তাঁর নিজের থাকে না, কারণ পাঠকের বাজারে সেটিকে আনতেই হয়। অর্থাৎ ভাষা নামক এক সামাজিক সম্পত্তিকে নিজ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় কবিতায় রূপান্তরিত করে কবি আবার সমাজের হাতেই তাকে ছেড়ে দেন। অন্যভাবে বলা যায়, কবিতা সমাজ থেকে সমাজের দিকে যাত্রা করে।
এই যাত্রার কেন্দ্রীয় বিন্দু কবি। তিনি আর পাঁচজন মানুষেরই একজন। অন্যরা যেমন কাজ করে, তিনিও তেমনি কাজ করেন—ভাষা নিয়ে কাজ। অন্য ব্যক্তির মতোই তিনি প্রকৃতি—অন্য মানুষ পরিবেশ নিয়ে গড়ে ওঠেন, তিনি একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সমাজগত। ব্যক্তি ও সমাজের সামঞ্জস্য ও বিরোধ—এই দুয়ের চেতনা যত তীক্ষ্ণমুখ হয়ে ওঠে—কবির পরিশ্রমী চেতনায়, ততই কবি তাঁর ভাষাকে Signifier ও Singnified-এর হরগৌরী মিলনে নিয়ে যেতে পারেন, ততই তিনি ভাষার
স্বাভাবিকতা পেরিয়ে সাংস্কৃতিক স্তরে যেতে পারেন।
যে কোনো নির্মাণ, তা সে মৃৎপাত্র বা যন্ত্র যাই হোক না কেন, আসল প্রাকৃতিককে রূপান্তরিত করা, শক্তিকে রূপান্তরিত করা—কবিতা-নির্মাণও তাই। মুখের স্বাভাবিক ভাষাকে রূপান্তরিত করার মধ্য দিয়ে তিনি একই রূপ-ছন্দ নির্মাণ করেন—যা বাইরের প্রকৃতিতে নেই। সার্বজনীন ভাষাকে ব্যক্তিচৈতন্যেরে চাপে বিশেষ একটি রূপ দেন, আর এই রূপের তাৎপর্য এখানে যে—এর ব্যঞ্জনা নানামাত্রিক।
নদী-ফুল-নারী বা মৃত্যু যৌনতা-বিকার—এসব এমনিতে একমাত্রিক। এদের প্রাকৃতিক বা শারীরিক অর্থ একটাই। কিন্তু এরাই যখন কবির কাজে আসে, তখন তাদের অর্থ ব্যপ্ত হয়। নদী—নদী থাকে না, নারী—নারী, মৃত্যু অনেক সময় জন্ম হয়ে যায়। ভাষা শ্রমিক হিসাবে কবির নির্মাণ—কার্যের গুরুত্ব এখানেই।
দুই
কবির এই নির্মাণ—কার্যের কি ভাষার বাইরের কোনো উদ্দেশ্য থাকে? তাঁর ভাষা শ্রমিকের ভূমিকা কি ভাষা-অতিরিক্ত কোনো উদ্দেশ্যর দ্বারা চালিত? অর্থাৎ রলা বার্ত যাকে বলেছেন ecrivant কবি কি তাই, না, তাঁর কাছে ভাষাই উদ্দেশ্য, তিনি জগতের দ্বারা নয়, ভাষার দ্বারা অধিকৃত?
এই প্রশ্নের মীমাংসা—কিন্তু শুধু কবির কাজে পাওয়া যাবে না, কারণ তাঁর কাজ সামাজিক।
এ কথা ঠিক কবির কাজ কোন বিমূর্ত নিয়ে নয়, একেবারে অব্যবহিত ভাষা তাঁর উপাদান। আর ভাষা লেখার আগেই বলার, অর্থাৎ মানুষের উত্তপ্ত মুখগহ্বর থেকে নির্গত, তাঁর মস্তিষ্ক-স্নায়ু-শরীর দিয়ে তৈরি। এই ভাষা যাঁর প্রাথমিক উপাদান, তাঁর কাজ, বোধহয় সকলের কাজই, সংযোগী হতে বাধ্য।
লোকচক্ষুর অন্তরালে কোনো ফুল ফুটে থাকলে, তার সৌন্দর্যের অস্তিত্ব থাকে, কিন্তু তাৎপর্য থাকে না। তেমনি অর্থহীন ভাষা কোন Sign হতে পারে না, Signifier-তো নয়ই। আবার কোনো ধারণাও প্রকাশ ছাড়া দাঁড়াতে পারে না।
লোকচক্ষুর সামনে এলেও, সৌন্দর্য আসতে পারে না—যদি না ফুলের প্রকাশ থাকে। কবির রচনায় সাস্যুর যাকে বলেছেন langue বা বিশেষ ভাষায় গঠন ও parole বা এই কাঠামো দৈনন্দিন ভাষা, দুই-ই অঙ্গীভূত।
বলা যায়, স্ট্রাকচার ও ইভেন্ট, ভাষার বিমূর্ত কাঠামো ও মূর্ত ব্যক্তিগত ব্যবহার কবির নিজস্ব নির্মাণে একই সঙ্গে, কখনো পৃথকভাবে, আসতে বাধ্য। আর সেই আসার সূত্রেই কবি ভাষা-অতিরিক্ত তাৎপর্য নিয়ে আসেন।
আমাদের পরিচিত বস্তু-প্রকৃতি কবিতার ভাষার সংগঠনে ভিন্নরূপ নেয়, অর্থের ব্যাপ্তি ঘটিয়ে, ব্যঞ্জনা বাড়িয়ে বা কমিয়ে কবি তাদের সম্পূর্ণ নতুন রূপে, ফলত নতুন অর্থে হাজির করেন। আর বিভিন্ন কবির হাতে—এই রূপান্তর ও অর্থান্তর ভাষা-শ্রমিকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য-দক্ষতা-চৈতন্য অনুযায়ী বিভিন্ন রকম।
আর এ-কারণেই কবির কাজ আমাদের জীবনে একান্ত প্রয়োজনীয়। শিল্প ও প্রকৃতির এক অনন্য আততি কবিতায় থাকে—এই আততির দরুণ কবিতার চৈতন্য আমার অভিজ্ঞতাকে শুধু বহুমাত্রিক
এক রূপান্তরের সম্মুখীন করে তাই নয়, মুক্তিও দেয়।
জগৎকে দেখতে ও বুঝতে শেখায় আমারই আশৈশব পরিচিত ভাষার মাধ্যমে। এ ভাষা যতই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, কখনোই পুরোমাত্রায় স্বাভাবিক হতে পারে না। কোনো শিল্পই পারে না, তাই বারবার প্রকৃতিবাদের বিরুদ্ধে শিল্পীদের উদ্যত হতে হয়েছে।
রেমণ্ড উইলিয়ামস ঠিকই বলেন, ব্রেখট অ্যারিস্টটেলীয় থিয়েটার বলে যাকে আক্রমণ করেন, অ্যারিস্টটল বেঁচে থাকলে তার বর্ণনায় অবাকই হতেন। আসলে ব্রেখট আক্রমণ করেছিলেন প্রকৃতিবাদী থিয়েটারকে।
কবিতায় এ রূপান্তর ভাষার, আমার মুখের ভাষা যখন অন্যার্থবাহী হয়ে ওঠে, গভীর ব্যঞ্জনাসঞ্চারী হয়ে ওঠে, তখন আমার কাছেই সে নতুন অভিজ্ঞতা।
তিন
আর যেহেতু শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অভিজ্ঞতা ও ভাষারও শ্রেণীচিহ্ন থাকে—একটি নির্বিশেষ কাঠামোর
মধ্যেই, সেহেতু কোনো ভাষার কবিতার আলোচনায়—কারা কবিতা লেখেন ও কারা পড়েন, তার একটা বিবেচনা জরুরি।
বাংলা কবিতা ক্রমশ মুখের ভাষার কাছাকাছি আসতে চেয়েছে—এই সিদ্ধান্ত কবির কাজ সম্পর্কে যেমন ভ্রান্তি ছড়ায়, তেমনি প্রশ্ন তোলে, কার মুখের ভাষার? মুখের ভাষার স্বর, টোন, গতিস্পন্দর সাহায্য নেওয়ার উদ্দেশ্য কবিতাকে মুখের ভাষা করে তোলা নয়, বরঞ্চ কবিতার বিশেষ ভাষাকে আরো বিশেষ করে তোলার চেষ্টা। তেমনি মুখের ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম, বিভিন্ন শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত।
বাংলা কবিতা এখনো মধ্যবিত্ত যে dominant language বলে, তার থেকেই নির্মিত। এই কবিতা যাঁরা পড়েন, তাঁরাও এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
বাংলা কবিতার দুর্দশা যদি কিছু ঘটে থাকে, তারও কারণ—এই শ্রেণীর ভাষার সংকট, পুরনো মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে ভাষা বহন করত, আজকে বিভিন্ন শিল্প ও কলোনী নগরীর নতুন মধ্যবিত্তরা তা করে না; হিন্দি ছবির অনুরাগী যুবক-যুবতীরা তা করে না, ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের ছেলে-মেয়েরা তা করে না। আর এই না-করার দরুণই, এক ধরনের বর্ণসঙ্কর চরিত্রহীন ভাষার প্রভাবশালী হওয়ার জন্যই ভাষা-শ্রমিক হিসাবে কবির সংকট বৃদ্ধি পায়।
এ সংকট মোচনের আপাতত সম্ভবনা নেই। সংকট মোচন শব্দটাই বোধহয় ভুল হলো। সংকট কাটিয়ে ওঠার পরই আবার সংকট আসে—সংকট আসবেই।
তবে সংকটের চেতনা তার সঙ্গে না-থাকলে তার মোকাবেলা করা যায় না। বাংলা কবিতা এখনো মধ্য শ্রেণীর একান্ত অধিকারে। আর এ শ্রেণীর এখন যে দিশাহীন নিরুদ্দেশ যাত্রা, তাতে কবিতাকে ভাষার দিক থেকে ঐ শ্রেণীর প্রতিপক্ষে দাঁড়াতে হবে।
গত ত্রিশ বছরে এই শ্রেণী ক্রমশ ভাষা হারা হয়েছে, এক বিকৃত ভাষার জগতে। দূরদর্শন-খবরের কাগজের ভাষায় সে ভাসছে-ডুবছে। কবির ভাষা এই অবস্থায় অনেক প্রত্যাখানের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠতে পারে। মূলত কবিরাই এখন প্রান্তিক, কিংবা প্রান্ততেও নেই।
……………………
36 thoughts on “কবির ভাষা, কবিতার ভাষা”