একগুচ্ছ কবিতা
চন্দ্রশিলা ছন্দা
চন্দ্রশিলা ছন্দার একগুচ্ছ কবিতা
বৃষ্টি সয় না
পেছনে ছেড়ে আসা জলের পথে
যেতে চাই বারবার।
ফিরে ফিরে দেখি বৃষ্টির কলরোলে
আমার উৎসমূল।
চন্দ্র-সূর্য নিয়ন্ত্রিত আমাদের গ্রহকালটুকু
হয়তো শুধু গ্রহান্তরই হয়েছিল!
.
সলতেটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসলে
আগুন হয় ঊর্ধ্বমুখী
তোমরা আমাকে দায়ী করে কত কথা বলো
আমিই শুধু বুঝি,
না-পাওয়ার যন্ত্রণা ঊর্ধ্বমুখী আগুন হয়
বয়স বাড়লে।
অর্ধ মৃত চোখে সৃষ্টি দেখি,
শ্রাবণের গান গাই না—
মৌসুমজুড়ে দাবদাহে মানিয়ে গেছি বেশ
বর্ষা না-এলেও চুপচাপ পড়ে থাকতে পারি
জলের শরীরে এখন আর বৃষ্টি সয় না।
.
মরণকাল
ঈশ্বরের এক হাতে পৃথিবী
অন্য হাতে সমুদ্র
মহাঝুঁকিতে সৃষ্টিতত্ত্ব।
হয়তো সমুদ্রে ভেস্তে যাবে সবকিছু…
বিবর্তনবাদীয় উপাখ্যানও হবে মিথ্যে।
বললাম মৃত্যু তবে কি?
ঈশ্বর বললেন, মৃত্যু একটি অনিবার্য ঘটনা
একটি সত্য জন্ম নেয়ার পরেই শুধু এমন
অনিবার্য ঘটনা ঘটে।
অনিবার্য ঘটনা বড় কুৎসিত।
অথচ সত্য কত সুন্দর।
.
সুদূরের নিমফল
চকচকে কাঁচ চাঁদে বিচ্ছুরিত আলো এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় বুক, কিরিচ যেন!
সে আলোয় সৈকতে কুড়ানো একশো মৃত ঝিনুক ছুড়ে ফেলেছি, মুক্তো তুলে নিবো…!
নিশ্চয় পৃথিবীর মেঘ সরে গেলে মেতে উঠবে পাখিরা আবার
আর্দ্র পলিতে উগড়ে দেবে সুদূরের নিমফল।
.
বুকের আগলে দৃশ্যমান উর্বর পলি
অদৃশ্যে নিশ্চিত করেছিল মৃত্যু আমার।
.
দৌড়
নেহায়েত গৃহপালিত অক্ষম আবেগগুলোকে
বেত্রাঘাত করিনি, তবুও বিনয়ী হতে পারলে না!
একনো কত পথ বাকি, কত দিন?
মেঘ বৃষ্টি আর শব্দের খেলা
থেমে আছে পথের পাশে
শর্টকাটে স্লিম হয়ে ওঠা রমণীতে
ভরে ওঠা ক্লান্ত শহরে
আমি তবু কান পেতে থাকি
পাখির কোলাহল শুনব বলে।
.
যে আকাশ ভালোবাসে
সে আসলে ভালোবাসে অখণ্ডতাকে
যে সমুদ্র ভালোবাসে
সে কখনো লঙ্ঘন করতে পারে না সীমা
এতসব দার্শনিক কথাবার্তায় এখন আর ভোখ মেটে না আমার
গোলাপ পাপড়ি আচ্ছাদিত শরীরের ঘ্রাণে
ঘুম আসে না সারারাত
কানের ভেতর সুর করে নামতা পাঠের শৈশবে দৌড়াতে থাকি
দৌড়াতে দৌড়াতে ঢুকে যায় কোনো এক অন্ধকার ঘুলঘুলির মাঝে
ফিরে আসি আবার আলোতে
আবার যাই ঘনঘোর অন্ধকারে
একসময় সব সুর থেমে যায়
যে কোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যাবে
কানামাছি ভোঁ ভোঁ
তবু কেন ক্ষুধার কথা বলি
তবু কেন ঘ্রাণে আচ্ছাদিত প্রাণ!
আমাদের প্রেমগুলো আকাশ-জমিন
মহাশূন্যের ছায়ায় একই বিছানা চাদরে
কতদিন ঘুমোই না আকাশের বুকে।
.
নদীদের গল্প
আমি ঝরনা।
তা তা থইথই উছল আকুল মন;
মা আমাকে ছোট ছোট নূরী
আর পাথরের চাঁই দিয়ে বাধা দিয়ে বলেছিলেন,
আগে নদী হও; সাগরে হও বিলীন।
ইচ্ছে খুশির ডানা মেলে দিয়ে
ছুঁইও না হয় নীল।
.
নদী হবার পর, খুঁজতে খুঁজতে একদিন
পেয়ে গেলাম কাঙ্ক্ষিত সেই সাগর!
আমার তখন তা তা থই থই মন
যা ইচ্ছে তাই করতে পারি,
ভাবনাগুলোই এমন।
.
অবিরাম অবগাহনে উদ্বেলিত দু’কূল।
বললাম তার কানে মুখে
চলো না ছুঁয়ে আসি আদিগন্ত?
.
সাগর খানিক ফুঁসে উঠে বেশ বললো,
সূর্য আলোয় আছেই-বা কি?
কী সেখানে খোঁজ?
নদীর জীবনে যা ছিলে তা ছিলে!
এখন তোমার ভরা সংসার,
সংসার আগে বোঝো!
.
আহা সংসার!
বুঝতে বুঝতে ঘূর্ণাবর্তে ঘুরি
কখন যে হায় হারিয়েছি দিন
উচ্ছ্বাস গেছে চুরি!
.
তবুও আমায় টানে যে বেলাভূমে
রোদ ঝলমল ভীষণ একটা দিনে
আদর মেখে ছেলের কপাল চুমে
বললাম—
খোকা নিবি আমায়
ঢেউয়ের তালে তালে?
যেখানে তুই আছড়ে পড়িস
যেখানে কোলাহল
পায়ের আওয়াজ খিলখিল হাসি
জোছনা জলের গান
চল না খোকা, তোর সাথে যাই
জুড়িয়ে আসি প্রাণ।
.
খোকাও দেখি তাঁর স্বভাবে গড়া
বিরক্ত চোখে মুখে
সে-পথ বহু দূর্গম মা! বহুদূর সেই পথ
ক্লান্ত তুমি, শান্ত হও তো!
আসবে তোমার রথ!
.
নদী নারীর জীবন কখনো সহজ
সরল নয়
মোড় ঘুরে যাবে সকল নদীর
এই তো তোদের ভয়!
.
রথ আসবে, আসবেই জানি
জলীয়বাষ্প হবো
আর জীবনে ঝরনা হবো না
পাহাড় হয়ে রবো।
.
দাসজীবন
বিনয় আমাকে কিছু তৃণতুল্য বোধের জন্ম দিয়েছে।
ক্রমশ ক্ষুদ্র হতে হতে তুচ্ছ পদদলিত;
যেন অবধারিত অবজ্ঞার এক লিখিত পত্র হাতে
পৃথিবীর পথে পরিক্রমণ আমার।
দুর্বল পরিচিতির মারকারি কিছু দাগ ছাড়া সরলতার বিনিময়ে ভাগ্য জোটেনি ভালোবাসা
প্রবঞ্চনার ভারে কালো হয়ে আসা মেঘ ঠেকাতে
সূর্যের কাছে প্রার্থনা রাতভর
তবু ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙন
প্রতিহত করতে পারিনি আমি।
আর কৃতজ্ঞতা?
আমাকে দিয়েছে অপ্র্যাশিত এক দাসজীবন!
লজ্জা অপমানবোধগুলো প্রতিনিয়ত চিনচিন ব্যথায় ফেনায়িত হয়েছে পশ্চিম থেকে পুবে
অথচ কাগজ-কলমে সেই কবেই বিলুপ্ত হয়েছে বিনিময় প্রথা!
.
উৎসারিত সম্ভাবনার জলে হাত রেখে প্রশ্ন করেছি,
কি বাধ্যবাধকতা ছিল আমার, এই সবুজ পাহাড়ে জন্ম নেয়ার?
এমন তো হবার কথা ছিল না!
কারো অনুগ্রহের অপেক্ষায় অথবা
ধরো অনুদানে বাঁচবে জীবন!
এ বড় গ্লানির।
.
ইনসোমোনিক রাতগুলোয় প্রায়ই স্বপ্নপ্রবণ হয়ে ভেবেছি,
কখনো কোনো একদিন প্রবল বৈশাখী ঝড়ে
শুকনো পাতা হয়ে উড়ে যাবে জীবনের সমস্ত গ্লানি
স্বচ্ছলতা আর সম্মান এসে আসন পেতে বসবে
আমার উঠোনে; জীবন হবে জীবনানন্দময়
অথচ অবজ্ঞার কালসিটে মুছে পৌঁছানো হলো না আমার জীবনের কাছে
মধ্যযুগের রাজতন্ত্রীয় চাবুকে নীরব রক্তপাত, আমার বর্ণহীন এই দাসজীবনে।
তবু পরিত্যক্ত কুয়োর অতল তলানি জলের মতো
একটুখানি আত্মসম্মানবোধ হঠাৎ হঠাৎ চিকচিক করে ওঠে
অনেকটা নির্লজ্জ হয়ে কানামাছি খেলি কবিতার সাথে,
স্রোতের বিপরীতে বৈঠা চালাই।
সেখানেও দেখি স্বপ্ন অবদমনের সংগীত,
গাদা খানিক অস্বীকৃতি লেপ্টে আছে বুকে পিঠে;
জন্ম দাগ হয়ে…
তথাপি মৃত প্রায় নদীর চর হয়ে জেগে থাকি অনন্তকাল।
…………………
পড়ুন
কবিতা
চন্দ্রশিলা ছন্দার একগুচ্ছ কবিতা
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা
সুনীল শর্মাচার্যের দশটি কবিতা
নাসিমা খাতুনের কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের কবিতা