
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১৫তম পর্ব
জ্যোতি পোদ্দার
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১৫তম পর্ব
তের
সম্পাদক আবদুর রেজ্জাকের সম্পাদনায় জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানকে নিয়ে প্রকাশিত হয় বিশেষ ‘স্মরণিকা’। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা শেরপুর জেলা শাখার প্রযত্নে প্রকাশিত এই স্মরণিকার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন খন্দকার আবদুল হামিদ। প্রচ্ছদ করেছেন এম এ মান্নান।
লিখেছেন—সৈয়দা সানজিদা মনিকা, খন্দকার মোহছেনা আখতার ও শাহ মো. আবদুল আজিজ। কবিতায়—কাজী মতিউর রহমান, গঙ্গেশ চন্দ্র দে, রবিন পারভেজ, সাদিকুর রহমান মিরন ও আবদুর রেজ্জাকের দীর্ঘকবিতা।
‘যে জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেনা সে জাতির সংস্কৃতির মুক্তিও ঘটতে পারে না। যার জন্য একটা সুষ্ঠু জাতি হিসেবে পরিচয় ঘটতে পারে না। যে দেশের সংস্কৃতি যত উন্নত সে জাতি তত সভ্য এবং উন্নত’ লিখেছেন আবদুর রেজ্জাক। ১৯৮২ সালের ২১শের সংকলনের সস্পাদকীয়ে।

‘উচ্চারণ’ জাসাসের অনিয়মিত কাগজ। কবি রেজ্জাকের কবিতা নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ আলোচনা করেননি। আবদুর রেজ্জাক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত।
মত ও পথের ভেদ এবং পথ চলা নিয়ে স্থানিক পর্যায়ে কোনো আলোচনা বা সমালোচনার জন্য সেমিনার শেরপুরে দেখা যায়নি। শুধু শেরপুর কেন—এমন অবস্থা বাংলাদেশের সাধারণ দৃশ্য।
কেন্দ্রের বাইরে পরিধি কেবল ভোক্তা—শ্রোতা সত্তা নিয়েই হাজির থেকেছে, কখনো উৎপাদক—কর্তা সত্তা হিসেবে নিজেকে জানান দেয় নাই। প্রতিটি স্থানিকের যে রঙ মেজাজ মর্জি আলাদা—এক রূপতার আড়ালে সবকিছু দৃশ্যের উপারে চিহ্নের আড়ালে চলে গেছে।
ব্যক্তিমাত্রই কোনো-না-কোনো দর্শন দ্বারা পরিচালিত। ব্যক্তির মত ও পথের প্রতি সন্মান এবং পারস্পরিক আলোচনার ভেতর দিয়ে যে সহাবস্থান একটা সুন্দর সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত—কথাটি বইয়ে পড়তে, বলতে বেশ নিজেকে গণতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক লাগে; বাস্তবতা হলো আমরা তেমন ‘কৃষ্টি-কালচার’ তৈরি করতে পারিনি।
নয়ের দশকের শুরুর দিকে আবদুর রেজ্জাক ‘কালিক’ নামে একটি ছোটকাগজ প্রকাশ করেন। শেরপুর সাহিত্য পরিষদের ব্যানারে। তিনি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে একাধিক কাগজ সম্পাদনা করেন। কোনোটিই স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি।
আবদুর রেজ্জাক ও গঙ্গেশ দে’র যৌথতায় ‘সৃজনী’ নামে আটের দশকে একাধিক স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। অগ্রজ এই দুই লেখককে নিয়ে কাউকে কথা বলতে শুনিনি। এখানকার তরুণেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রেজ্জাক বা গঙ্গেশ দ্বারা কোনো-না-কোনোভাবে প্রভাবিত।
যদিও দুজনেই স্থানিক সাহিত্যচর্চার মাঠকে বলতে গেলে একক প্রচেষ্টায় কর্ষণ করে গেছেন। রেজ্জাকের একাধিক কাব্যগ্রন্থ নিয়ে পরবর্তী দশকের কোনো তরুণই কী মৌখিকভাবে, কী লিখিতভাবে—কোনো কথাই বলেননি। যদিও অগ্রজ কবির পাঠ-মোকাবেলা করেই তরুণকে পথ নির্মাণ করতে হয়।
আবদুর রেজ্জাক সম্পাদিত সাপ্তাহিক শেরপুর (১৯৮৬) এই অঞ্চলের তরুণদের কবিতাচর্চার প্রশস্ত চাতাল হিসেবে দীর্ঘদিন কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে; তেমনি আবু বকরের সাপ্তহিক দশকাহনীয়া (১৯৯১) ও জাকির হোসেনের সাপ্তাহিক চলতি খবর। এই তিনটি সাপ্তাহিক ও সম্পাদকত্রয়ের প্রতি আমার অশেষ ঋণ। গত শতাব্দীর নয়ের দশকে এই সাপ্তাহিক তিনটি ছিল আমার কবিতাচর্চার একমাত্র চাতাল।
জাকির হোসেন ষাট-সত্তর দশকের শক্তিমান অভিনেতা। সুবক্ত। ১৯৭৮ সালে ‘সাহিত্য কলতান’ প্রকাশ করে ‘বিজয় কেতন’। সম্পাদক জাকির হোসেন ছিলেন কলতান সাহিত্যগোষ্ঠীর প্রধান সম্পাদক। কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে যায়।
‘সাহিত্য কলতানে’ সে সময় যুক্ত ছিলেন—দীপক ভট্টার্চায, মানিক নাগ, নারায়ণ চক্রবর্তী, নির্বাহী সম্পাদক দেবাশীষ চক্রবর্তী, কমল চক্রবর্তী ঝুনু, মহিলা সম্পাদক মনিকা চক্রবর্তী দেবী ও সাহিত্য সম্পাদক বাদল দাম প্রকাশ।
‘বাংলাদেশর সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ জাকির হোসেন লিখেছেন, ‘একটা দেশের সাংস্কৃতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করতে গেলে সেই দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, সমাজ সংস্কার, আচার আচরণ, প্রথা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ও সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পর্যালোচনা অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়।
আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি ও তার ক্রমবিকাশ ও স্বকীয়তা নির্ধারণ করতে হলে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমি, জাতীয়তাবাদের উদ্ভব, ভৌগোলিক অবস্থান ও সমকালীন সমাজ জীবনের উপর আলোকপাত আবশ্যক।’
‘বিজয় কেতন’-এর কোনো বিনিময় ছিল না। ১৯৮১ সালেও তিনি সম্পাদনা করেন ‘অন্বেষা।’ এটিও কলিতে ঝরে যায়। স্থানিক কাগজচর্চার এটি একটি সাধারণ নিয়তি। যে আবেগ ভালোবাসা নিয়ে তরুণ কবিযশ প্রার্থীরা দলবদ্ধ হচ্ছে, একটি বা দুটি প্রকাশ করে পত্রিকা যেমন বন্ধ হয়ে যায়, তেমনি দল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
১৯৭৯ সাল ৪ জানুয়ারি শেরপুরের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। এদিন শেরপুর অঞ্চল মহকুমার শুভ যাত্রা শুরু হয়। টাউন শেরপুরে পৌরসভা হবার ১০৯ বছর পর টাউন শেরপুরে মহকমার সদর কার্যালয় স্থাপন করা হয়। নিশ্চয় দিনটি শেরপুরবাসীর আনন্দিত হবার দিন।
এ কে এম আহসান উল্লাহ, প্রথম মহকুমা প্রশাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় দিনটির স্মরণে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয় জাকির হোসেনের সম্পাদনায়। সম্পাদনা পরিষদে আরো ছিলেন—সৈয়দ আব্দুল হান্নান, মুহম্মদ আবু তাহের ও গোলাম রহমান রতন।
এই স্মরণিকায় চমৎকার কয়েকটি গদ্য প্রকাশিত হয়েছে। জাকির হোসেনের ‘শেরপুর ইতিবৃত্ত’, গোলাম রহমান রতনের ‘শেরপুরের সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, গঙ্গেশ দে’র ‘শেরপুরের লোকগীতি’, সুনীল বরণ দে’র ‘শেরপুরের গারো সংস্কৃতি’ ও পণ্ডিত ফসিহুর রহমানের মহকুমা শেরপুরের হাল নাগাদ তথ্য সংবলিত নিবন্ধ।
(চলবে)
…………………
পড়ুন
কবিতা
রাংটিয়া সিরিজ : জ্যোতি পোদ্দার
প্রবন্ধ-গবেষণা
টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী
১ম পর্ব । ২য় পর্ব । ৩য় পর্ব । ৪র্থ পর্ব । ৫ম পর্ব । ৬ষ্ঠ পর্ব । ৭ম পর্ব । ৮ম পর্ব । ৯ম পর্ব । ১০ পর্ব । ১১তম পর্ব । ১২তম পর্ব । ১৩তম পর্ব । ১৪তম পর্ব । ১৫তম পর্ব
10 thoughts on “শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১৫তম পর্ব”