শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২৫তম পর্ব
জ্যোতি পোদ্দার
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২৫তম পর্ব
পঁচিশ
বাংলাদেশ লেখক সমিতি শেরপুর জেলা শাখা গোলাম রাব্বানি সভাপতি ও কবি আরিফ হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে নয় সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয় গৃদানারায়নপুরে অস্থায়ী কার্যালয়ে ১৯৯৬ সালের ৩ জুনে। কয়েকটি সাহিত্যসভা করলেও, পরবর্তী সময়ে তাদের কার্যক্রম সঠিক গতি পায়নি।
সমিতির জেলা শাখার মুখপত্র ‘বর্ষাতি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি। এক ফর্মার এই কাগজটি সম্পাদনা করেন তাছলীমা আবেদ নাজমা। তিনিই সম্ভবত প্রথম নারী যিনি শেরপুরে কোনো সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। স্বাধীনতার পঁচিশ বছর উপলক্ষে এই ‘বর্ষাতি’ প্রকাশিত হয়। ফকরুল চৌধুরীর প্রচ্ছদে একটি ছিমছাম কাগজ।
.
ক.
‘তোমার ছবিটি রেখেছি আমি
আমার মনের এ্যালবামে,
তোমার চিঠিটি রেখেছি আমি
যত্ন করে হৃদয় খামে।
… … …
কাজল করে রেখেছি তোমায়
আমার দুটি নয়ন কোণে
আপন করে রেখো আমায়
তোমার ওই মনের বনে।’
(তোমাকে রেখেছি : তাছলীমা আবেদ নাজমা)
খ
‘ঘাবড়ে গেলাম জীবন নিয়ে
সাহস পেলাম মানুষ পেয়ে।
মানুষ দেখে পেলাম ভয়,
মানুষও কি এমন হয়?’
(দর্শন : আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ)
.
‘মানুষকে নিয়েই সাহিত্য, আর সাহিত্য নিয়েই মানুষ। স্বাধীনতা যুদ্ধে যাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি এই বাংলাদেশ। শহীদদের স্মরণ করে এই ‘রক্তঝরা একাত্তুর’।’ লিখেছেন সম্পাদক মো. সেলিম মিয়া। প্রকাশ কাল বিজয় দিবস ১৯৯৫। মদিনা প্রেস থেকে প্রকাশিত এই কাগজটি সৌরভ সংঘের মুখপাত্র।
স্থান কাজী বাড়ী পুকুর পাড়। সৌরভ সংঘের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে কোনো তথ্যই শেষ পর্যন্ত পেলাম না। তরুণদের উচ্ছাসে জন্ম নেয়া সংগঠন এভাবেই হারিয়ে যায়। স্থানিক ইতিহাসচর্চায় তাদের কোনো ইশারাই খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু যে সংঘবদ্ধ তরুণেরা একদিন ‘আমি তুমি সবে মিলে’ যতটুকুই কাজ-কারবার করেছে, তার কি কোনো স্বীকৃতি নেই? মূল্যায়ন হবে না? সংগঠনচর্চা নাগরিক সমাজ গঠনের অন্যতম উপদান। হোক না সে কবি সংগঠন বা ক্রীড়া অথবা কিশোর ক্লাব বা সমবায় সমিতি।
সে যাই হোক। একটি পরিচ্ছন্ন সাহিত্যপত্র। বিকশিত হবার আগেই পর্দার অন্তরালে। সম্পাদকের কবি ও কবিতা নির্বাচনে মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে। লিখেছেন—সুহৃদ জাহাঙ্গীর, রফিকুল ইসলাম আধার, আয়েশা সিদ্দিকা, আবুল কালাম আজাদ, সেলিম আজামেদ সুপ্ত, রোজিন চৌধুরী, লাইলুন নাহার-সহ আরো বেশ কয়েকজন।
.
‘অমৃতের চায়ের দোকানে যাই
কবোঞ্চ চায়ের পেয়ালায় চুম্বন রেখে
বেঁচে থাকি কিছুটা সময় নীরবে
রাঁখি হাত সময়ের হাতে বিমূঢ়
সময় ধর্ষিতা বালিকার মতোন বিপন্ন
বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে।
(পাথর সময়ের গদ্য : সুহৃদ জাহাঙ্গীর)
.
সাহিত্যলোকের জন্ম সাল ১৯৯৩ সালের চৌদ্দ এপ্রিল। টানা যাত্রা সাহিত্যলোকের হয়নি। থেমে থেমে যাত্রা হলেও, সাহিত্যলোক শিরদাঁড়া টান টান; পদক্ষেপেও সুচিন্তিত। কবি আরিফ হাসানের প্রযত্নে প্রকাশিত এই কাগজটি শেরপুরে ছোটকাগজ আন্দোলনের প্রভাবক। প্রতিটি সংখ্যা আরিফ সাজিয়েছেন নিজের মনের মতো করে।
এমনকি দুটো ‘শেরপুর সংখ্যা’ও করেছেন। এক ফর্মা বা দুই ফর্মার ভেতর জারি রয়েছে সত্যিকার ছোটকাগজ হবার সকল সম্ভাবনা। কিন্তু যা লেখা থাকে ছোটকাগজের ললাটে, তাই যেন ঘটে গেল আরিফের সাহিত্যলোকের ক্ষেত্রে। ১৯৯৯ এসে একেবারে থীতু হয়ে পড়ল। সাহিত্যলোকের শৈল্পিকতার কৃতি ছড়াচ্ছে তরুণ কবিদের মাঝে অথচ বর্তমানে সাহিত্যলোকের প্রকাশ নেই।
সর্বমোট দশে স্থিতি। বিজ্ঞাপনের অপ্রাপ্যতাকে দায়ী করেন আরিফ। হয়তো কোনো একদিন আবারো যাত্রা শুরু হবে সাহিত্যলোকের—এমন প্রত্যাশা করেন এই কমিটেড সম্পাদক।
সাহিত্যলোকের কাভারে আরিফ একটি সংখ্যায় ব্যবহার করেছেন এস এম সুলতানের ‘চর দখল’ স্কেচটি। সাদা কাভারে কালো পেন্সিল স্কেচটি গতিময়তা জারি রেখেছে। রয়েছে সুলতানের সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
আরিফ লিখেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের মুখে। দেশীয় সংস্কৃতির এই অকাল ধ্বংসরোধে একজন লেখকের ভূমিকা সবচেয়ে অগ্রণী… একজন সৃষ্টিশীল লেখক কখনো তার দায়িত্ব পালনে শৈথল্য প্রদর্শন করেন না।’
বিভিন্ন সংখ্যায় লিখেছেন—রবী নিয়োগী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শামসুর রাহমান, আবুল কাসেম ফজলুল হক, আহমেদ মাওলা, কাকন রেজা, রতন মোস্তাইন, রফিকুল ইসলাম আধার, ফকরুল চৌধুরী ও বৃতেন্দ্র মালাকার-সহ আরো অনেকে।
সাহিত্যলোকের ‘শেরপুর সংখ্যা’ নিয়ে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি লিখেছেন, ‘সাহিত্যলোকের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো এর নিটোল পরিচ্ছন্ন প্রকাশ। এই পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হয়েছে ধীরে ধীরে একটির পর একটি সংখ্যা প্রকাশ করতে করতে।’
তিনি আরো লিখেছেন, ‘…কবিতাগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে সহজ সরল অনুভূতি। আন্তরিকতা সত্ত্বেও অনুভূতিগুলোকে মনে হয় দুর্বল জীবনের দুর্বল অনুভূতি। কোথাও বলিষ্ঠতা কিংবা তীব্রতা নেই। তবে রুচির ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় আছে।’
আবুল কাসেম ফজলুল হকের মন্তব্য আজো প্রণিধানযোগ্য। তাঁর পর্যালোচনা নিশ্চয় এ অঞ্চলের কবিদের কাব্যকৃতি ভাবনায় রসদ যোগান দেবে।
.
ক.
‘মাথার উপর আকাশটাও ঝুলে থাকে,
আমি আকাশটাকেই বলি ঘর গেরস্থালি
এবং আশ্রয়।
যে যাই বলুক আমার ছাদের চেয়ে
আকাশটাই ভালো।’
(বিবাগি এবং গৃহী : কাকন রেজা)
খ.
‘বৃষ্টি ছিল মনে কাল সারারাত ধরে
আঁধার ছিল বনে কাল সারারাত ধরে
কান্না ছিল কোণে কাল সারারাত ধরে
কাটিয়ে দিলাম কাল সারারাত
তোমাকে ডেকে ডেকে।’
(বিপ্রতীপ : বৃতেন্দ্র মালাকার)
.
(চলবে)
…………………
পড়ুন
কবিতা
রাংটিয়া সিরিজ : জ্যোতি পোদ্দার
প্রবন্ধ-গবেষণা
টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী
১ম পর্ব । ২য় পর্ব । ৩য় পর্ব । ৪র্থ পর্ব । ৫ম পর্ব । ৬ষ্ঠ পর্ব । ৭ম পর্ব । ৮ম পর্ব । ৯ম পর্ব । ১০ পর্ব । ১১তম পর্ব । ১২তম পর্ব । ১৩তম পর্ব । ১৪তম পর্ব । ১৫তম পর্ব । ১৬তম পর্ব । ১৭তম পর্ব । ১৮তম পর্ব । ১৯তম পর্ব । ২০তম পর্ব । ২১তম পর্ব । ২২তম পর্ব । ২৩তম পর্ব । ২৪তম পর্ব । ২৫তম পর্ব
5 thoughts on “শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২৫তম পর্ব”