shubhobangladesh

সত্য-সুন্দর সুখ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবসময়…

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২৯তম পর্ব

Little Magazine
Little Magazine

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২৯তম পর্ব

জ্যোতি পোদ্দার

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২৯তম পর্ব

ঊনত্রিশ

টাউন শেরপুরে শারদীয় পূজা সংখ্যা ‘মার্চেন্ট ক্লাব’ নয় আনী বাজারে তরুণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন। প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৪। ক্লাবের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশ করেন চার কালারের একটি স্মরণিকা।

‘আদ্যা’ (২০১৪)। সস্পাদক রাজন সরকার রাজু। সভাপতিমণ্ডলীর উপদেষ্টা শিব শংকর কারুয়া।

শিব শংকর এই শহরের একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সকলের প্রিয় মুখ। শিশু-কিশোর সংগঠন থেকে শুরু করে নাটক সংগঠন—বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি কার্যকর ভূমিকা রেখে চলছেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন নারায়ণ চন্দ্র সরকার ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বলরাম কর্মকার।

দুর্গাপুজা উপলক্ষে এই বিশেষ সংকলনে লিখেছেন—ড. সৌমিত্র শেখর, তৎকালীন শেরপুরের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর রাজিব সরকার, জীবন কৃষ্ণ বসু, শিব শংকর কারুয়া, সন্ধ্যা রায় ও সঞ্জিব চন্দ বিল্টু প্রমুখ।

গীতিকার ও সুরকার দেবদাস চন্দ বাবু লিখেছেন আগমনী সংগীত।

.

‘মা দূর্গা তুমি অভয়া তারিণী

দুঃখ হরা দুর্গতি নাশিনী

মা দুর্গা… মা দুর্গা

তোমারই শক্তি তোমারই তেজে

এসেছিলে মা অসুর নাশিতে

স্বর্গে মর্তে আনিতে শান্তি

আদ্যাশক্তি রূপে প্রকাশিতে’

.

আরো যথারীতি আছে কবিতা সম্ভার। মফস্বলে সাহিত্যচর্চার চাতাল নির্মাণে ধার্মিক সংগঠনও ভূমিকা পালন করে। ছোটকাগজ চর্চার কথা লিখতে গেলে এই ধরনের স্মরণিকার হদিশ নিতেই হবে, নইলে চর্চার জমিন দৈর্ঘে-প্রস্থে খাটো হয়ে পড়ে।

.

‘কাঁশ ফুলের নদীর ধারে দাঁড়িয়েছিলাম তখন

শরৎকালের ফুলের গন্ধ আসত যখন তখন।

(একটি চাওয়া : পকথা কারুয়া)

.

তেমনি আরেকটি পুজা সংকলন ‘শারদীয়া’, প্রকাশকাল ১৯৯২। সম্পাদক বিমল কর্মকার। শেরপুরের নাট্য আন্দোলনে অন্যতম ব্যক্তিত্ব। অভিনয়, নাটক রচনা ও পরিচালনয় তিনি একজন দক্ষ কারিগর। এই সংকলনে তিনি চমৎকার একটি কাব্যনাট্য লিখেছেন।

.

রাজা—কি হচ্ছে তথায় মন্ত্র শোনা যায়?

তোষামুদে—মায়ের পুজা হচ্ছে তথায়।

রাজা—বলিস কিরে পুজো করে,

পায় না খাবার কি করে?

তোষামুদে—বুঝেছি হুজুর হয়েছে কসুর

অপরাধ ওদের হয়েছে প্রচুর।

.

‘অবক্ষয়ের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মা দুর্গার কাছে খোলা চিঠি’ লিখেছেন নিখিল সাহা। সমসমায়িক বিষয়কে লক্ষ্য রেখে স্যাটায়ারধর্মী এই লেখা। কবিতা লিখেছেন—ধীমান দাস, প্রসূন তালুকদার, মনিকা চক্রবর্তী ও বিশ্বনাথ ভট্টার্চায।

.

‘ঢ্যামকুঁড়কুঁড় ঢ্যামকুঁড়কুঁড়

বাদ্যি বাজে ওরে—

ছেঁড়া প্যান্টের কয়টি ছেলে

সানকি নিয়ে ঘোরে।

ঢ্যামকুঁড়কুঁড় ঢ্যামকুঁড়কুঁড়

দে মা একটু খাবার

ওদের কি মা নেই অধিকার

একটু প্রসাদ পাবার?

(বিশ্বনাথ ভট্টার্চায)

.

আরো লিখেছেন—সাধন গুপ্ত, দেবাশীষ চক্রবর্তী, সমিরেন্দ্র মোহন সাহা ও উদয় শংকর রতন। সংকলটির প্রচ্ছদশিল্পী কবি রনজিত নিয়োগী।

মাধবপুর ক্লাবের জন্ম ১৩৪৩ (১৯৪৩) সনে। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নরেশ কর্মকার। যদিও এটি ধার্মিক সংগঠন—বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে।

বিমল কর্মকার তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘১৩৪২-৪৩ সালে শেরীপাড়ায় ব্যাপক আকারে কলেরা প্রার্দুভাব ঘটে। নরেশ কর্মকারের নেতৃত্বে তখন এই গ্রামের (মাধবপুর) তরুণেরা সেবা শুশ্রুষায় এক নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত রাখে। এ ছাড়া নাটক, সঙ্গীত, খেলাধুলায়—এই ক্লাবের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেছেন।’৩০

ক্লাবের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকাটি (১৩৯২) উৎসর্গ করেন এই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদ ধ্বসে পড়ায় যে সকল শিক্ষার্থী অকালে প্রাণ বিসর্জন দেয়—সেই সকল উজ্জ্বল নক্ষত্রদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সম্পাদক ছিলেন—দেবাশীষ চক্রবর্তী ও জীবন কৃষ্ণ বসু।

শিক্ষক জীবন কৃষ্ণ বসু টাউন শেরপুরে শিক্ষক হিসেবে আসেন গোপালগঞ্জ থেকে গত শতকের আটের দশকে। এখানেই থিতু হন। স্কুলের বার্ষিকী প্রকাশে যেমন উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন, তেমনি এই শহরের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধর্মীয় কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। মওলা প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপা স্মরণিকার প্রচ্ছদ করেন বিজন কর্মকার।

এখানে উল্লেখ্য যে, সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নবমী পুজার রাতে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, তাতে অংশগ্রহণ করেন—মনিকা, পলী, গৌতম, মুক্তি দত্ত, সুতপা দত্ত ও শিপ্রা কর্মকার। অনুষ্ঠানে কিশোর যাদুকর রুহুল হায়দার শামীমেরর যাদু প্রদর্শিত হয়। জয়ন্তী সংখ্যায় লিখেছেন—দ্বীজেন্দ্র চন্দ্র পাল, জীবন কৃষ্ণ বসু, কল্যাণী কর্মকার, গঙ্গেশ চন্দ্র দে-সহ প্রমুখ কবি।

অন্যদিকে, চক বাজার সমবায় সংঘ স্থাপিত হয় ১৩৪৫ সালে। সংঘের হীরকজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরণিকা ‘অঞ্জলি’র (১৪১৯) সম্পাদক স্মরণ রায়। সমবায় সংঘ প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই এই স্থান ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কায়কারবারের প্রশস্ত চাতাল।

আড়াই আনী জমিদার গোপাল দাস চৌধুরী এখানকার চক বাজার মাঠকে কেন্দ্র করে ‘একটি বাজার প্রতিষ্ঠার’৩১ ভেতর দিয়েই মূলত এই চাতাল গড়ে তুলেন। গত শতকের গোড়ার দিকে যে অসহযোগ আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়, তার ঢেউ শেরপুরেও আছড়ে পড়ে।

‘এই সময়ে (১৯২৮) সেরপুর টাউনের চকবাজারে সার্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করে সর্বপ্রথম অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের সমাজ সংস্কারমূলক কাজ ও আন্দোলন শুরু হয়। হদি ক্ষত্রিয়দের ‘জলচল’ আন্দোলনের ঢেউ অন্যান্য অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও আড়োলন সৃষ্টি করে।’৩২

এখানে উল্লেখ্য যে, হিন্দু সমাজের বর্ণবাদিতার কারণে যে বিভাজন সমাজ শরীরে বিদ্যমান ছিল সেখানে একে অপরের ‘জল’ স্পর্শও করতো না। কেদার চক্রবর্তী এই মাঠেই জগদ্ধাত্রী পূজার দিনে ‘পরস্পর পরস্পরকে’কে পানীয় জল প্রদান ও গ্রহণ করার যে আন্দোলন—সেটিই ‘জলচল’ আন্দোলন।

বর্ণবাদকে ভেঙে এককাতরে সমাসীন হবার আন্দোলন। কেদার চক্রবর্তীই হদি ক্ষত্রিয়দের মাঝে ‘অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের’ আন্দোলন গড়ে তুলেন। এই জলচলের দাবি হদি ক্ষত্রিয়দের মাঝ থেকে উত্থাপিত হয়। তার পর ছড়িয়ে পড়ে হাজং ডালু সম্প্রদায়ের ভেতর।

‘এই সময় পূর্বধলা থানার গুয়াতলা বন্দরে এক সন্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। জেলার বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় অনুন্নত সম্প্রদায়ের জল চলের দাবি মানিয়া লয়।’৩১

প্রমথ গুপ্ত আরো লিখেছেন, ‘সামাজিক আন্দোলনে অনেকটা অগ্রসর হইয়া হদি ক্ষত্রিয়গণ রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হয়।… এই সমস্ত সামাজিক আন্দোলন গুলির মধ্য দিয়া সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের এক ঐক্যবদ্ধ শক্তি গড়ে ওঠে।’৩১

কাজে কাজেই চকবাজার মাঠে একদিকে যেমন ধর্মীয় কাজ কর্ম ছিল, তেমনি ছিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতার কেন্দ্রভূমি। স্মরণ রায়ের সম্পাদিত কাগজে লিখেছেন—প্রফেসর গোপাল চন্দ্র সাহা, নারায়ণ সাহা, কমল চক্রবর্তী, জীবন কৃষ্ণ বসু, সাধন গুপ্ত ও প্রিয়তোষ সরকার।

নিখিল সাহা’র সম্পাদনায় এই চকবাজার সমবায় সংঘ থেকে প্রকাশিত হয় ‘দশভূজা’ (১৮৮৬) ও ‘শারদ অর্ঘ্য’ (১৯৮৭)। সম্পাদক নিখিল নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ চুটকির মাধ্যমে তৎকালীন সমাজ ও তার প্রতিবেশ নিয়ে লিখেছেন ‘যদি কিছু মনে না করেন—খিচুরী মিস্টান্নের গপ্পো শোনেন’ স্যাটায়ারধর্মি আখ্যান।

নিখিল তার সম্পাদিত দুটি কাগজেই প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, ব্যঙ্গাত্মক লেখা ও কবিতার সমাবেশ ঘটিয়েছেন বেশ মুন্সিয়ানায়।

.

‘ধমক খেয়ে চমক লাগে গমক লাগে গায়;

এমনি করে কি আজকে মানুষ বড় হতে চায়?

আদ্যাশক্তি মহামায়ায় মহাশক্তি বলে,

স্বর্গ মর্ত্য পাতাল—ত্রিকাল তিনটি ভাবে চলে।

… … …

ধাক্কা খেয়েই চাক্কা ঘুরে শক্তি ছাড়া নয়,

শক্তিহীন—হলেই হবে মরা বাঁচার ভয়।

(শক্তিসাধনা : গঙ্গেশ চন্দ্র দে)

.

এ ছাড়া লিখেছেন—রণজিত নিয়োগী, মানিক নাগ, দেবাশীষ চক্রবর্তী, প্রদীপ কান্তি মজুমদার, দেবজ্যোতি সাহা, জীবন সাহা, জীবনকৃষ্ণ বসু, বিমল কর্মকার ও সুতপা দত্ত। শারদ সংখ্যা দুটি উৎসর্গ করা হয়েছে—১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর রাতে জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডিতে নিহত শিক্ষার্থীদের ও ’৮৭ সালের বন্যায় বানভাসি মানুষদের।

প্রতি বছরই শারদ সংখ্যা বের হতো—এমন নয়। উদ্যোগী তরুণ পূজাকে আর্বতন করে সাহিত্যচর্চার পাটাতন নির্মাণে এগিয়ে আসতেন। উৎসবে নতুন পালক যুক্ত হতো কোনো তরুণের সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা। তারুণ্যের উচ্ছ্বাস বহুরৈখিক। এক মহল্লার দেখাদেখি অন্য মহল্লার তরুণেরা জোট বাঁধে। কবিতা সংগ্রহ করে। প্রতিযোগিতা বাড়ে। পত্রিকা বের হয়। এই তো স্থানিকে ছোটকাগজ চর্চা চর্যার রীতি-নীতি।

তবে টাউন শেরপুরে গত শতকের আটের দশক মূলত শারদীয় উৎসবে পূজা সংখ্যা বের করার প্রাবল্য লক্ষণীয়। এদিকে মাধবপুর ক্লাব, চকবাজার সমবায় সংঘ, অন্যদিকে শিব বাড়ি তরুণ সংঘ।

কমল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘শারদ অঞ্জলী’তে লিখেছেন—সুধাময় দাস, ক্ষমা চক্রবর্তী ও ডা. সুজিত রায়। এ ছাড়া তরুণ কবি রবিন পারভেজ, উদয় শংকর রতন ও জয়স্রী নাগ-সহ প্রমুখ কবিদের কবিতা। প্রচ্ছদ ও কাঠ খোদাই করেছেন বিজন কর্মকার।

এ ছাড়া পূজা উদযাপন পরিষদ শেরপুর জেলা শাখা কয়েক বছর ধরে সাংগঠনিক ভাবে ‘বোধন’ নামাঙ্কনে স্মরণিকা প্রকাশ করে আসছে। সময়ের পালা বদলে স্মরণিকায় উন্নত মানের কাগজ, মুদ্রণ, চার কালারে প্রচ্ছদ যুক্ত হয়েছে। বোধনে বিভিন্ন সংখ্যায় লিখেছেন—ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, ড. পরেশ চন্দ্র মণ্ডল, সুধাময় দাস, ড. সৌমিত্র শেখর, অজয় দাশগুপ্ত, শিব শংকর কারুয়া ও প্রিয়তোষ সরকার।

(চলবে)

…………………

পড়ুন

কবিতা

রাংটিয়া সিরিজ : জ্যোতি পোদ্দার

তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার

জ্যোতি পোদ্দারের কবিতা

প্রবন্ধ-গবেষণা

টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা

১ম পর্ব । ২য় পর্ব । ৩য় পর্ব । ৪র্থ পর্ব । ৫ম পর্ব । ৬ষ্ঠ পর্ব । ৭ম পর্ব । ৮ম পর্ব । ৯ম পর্ব । ১০ পর্ব । ১১তম পর্ব । ১২তম পর্ব । ১৩তম পর্ব । ১৪তম পর্ব । ১৫তম পর্ব । ১৬তম পর্ব । ১৭তম পর্ব । ১৮তম পর্ব । ১৯তম পর্ব । ২০তম পর্ব । ২১তম পর্ব । ২২তম পর্ব । ২৩তম পর্ব । ২৪তম পর্ব । ২৫তম পর্ব । ২৬তম পর্ব । ২৭তম পর্ব  । ২৮তম পর্ব  । ২৯তম পর্ব

About The Author

শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে থাকুন...