শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৩০তম পর্ব
জ্যোতি পোদ্দার
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৩০তম পর্ব
ত্রিশ
গারো আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিত্রের একটি অনবদ্য বার্ষিক সংকলন ‘ব্রিংনি বিবাল’। বড়দিন ও নববর্ষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে মরিয়মনগর থেকে। ব্রিংনি বিবালের অর্থ বনের ফুল। সম্পাদক টিটু রাকসাম। গত শতকের আটের দশক থেকে প্রকাশ। এ সংখ্যায় লিখেছেন—সঞ্জিব দ্রং, বাঁধন আরেং, লিপা চিসিম, সোহেল ম্রং প্রমুখ।
নিষ্কৃত হাগিদক ‘অবকাশ নয়, চাই গাজনী গ্রাম’। নিবন্ধে লিখেছেন ‘এই তিনটি লেক বহু গারো পরিবারের ভূমি গ্রাস করেছে। তোমরা এর প্রবাহধারাকে বল প্রবাহিণী, আমি বলি তারে অশ্রুধারা; তোমরা একে শুধু বল জল, আমি বলি তারে চোখের জল। কারো আবাদী জমি, কারো জুম জমি, কারো আনারস, আম বা কাঁঠাল বাগান, কারো একমাত্র সম্বল দু’বিঘা ভিটেমাটি দখল করে গড়া এই গজনী অবকাশ। তোমরা এর মাঝে খুঁজে পাও নয়নাভিরাম দৃশ্য, নাম দিয়েছ তারে ‘অবকাশ কেন্দ্র’।
আমি এর মাঝে খুঁজে পাই শোষণ, বঞ্চনা আর শুনতে পাই পাহাড়ের কান্না, যারে আমি নাম দিয়েছি ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন কেন্দ্র’।… চাই না আমি উড-লট বাগান, সামাজিক বনায়ন; চাই শুধু প্রাকৃতিক বন জঙ্গল; চাই না আমি গজনী অবকাশ, চাই ফিরে পেতে গাজনী গ্রাম। দাও ফিরে আমার সেই বড় গাজনী গ্রাম।’২০
হাগিদক চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই অঞ্চলের মানুষের মর্মবেদনা। যে গ্রাম এই জনপদে বেড়ে ওঠা মানুষের জীবন-জীবিকার চাতাল সেই গ্রাম এখন বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিনোদন কেন্দ্র। পিকনিক স্পট। সেই স্পটের গভীরে লুকিয়ে আছে ভূমিজ মানুষের প্রপিতামহ কিংবা তার প্রপিতামহের কবর। হাজারো মানুষের বুকফাঁটা আর্তনাদ।
আকাশমনি গাছে ছেয়ে গেছে গাজনী গ্রাম। পাখ-পাখালি নেই। পশু-পাখি নেই। শুধুই লিজের পর লিজের রবার বাগান। সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের লিজের বাগান।
মিঠুন রাকসাম তার ‘দলিলে ভাটপাড়া গ্রাম’ কবিতায় লিখেছেন-
‘তখনও মান্দি নারী কাঠগড়ায়
চেঁচিয়ে বলছে ‘বাবু ও দলিল জাল’
মিঠুন প্রতিশ্রুতি তরুণ কবি। তার কবিতায় গারো সমাজযাপনের কথা যেমন ওঠে এসেছে, তেমনি শোষণ-বঞ্চনার কথা। তার কবিতায় নিজস্ব শৈলী ইতোমধ্যে পাঠক সমাজের দৃষ্টি কেড়েছে।
বারমারী ফাতেমা রানী তীর্থযাত্রা উপলক্ষে রয়েছে প্রতিবছর কোনো-না-কোনো স্মরণিকা। আমি যে সংখ্যাটি হাতে পেয়েছি সেটি ষষ্ঠ বর্ষের প্রথম সংখ্যা ২০০৩। এ বছরে অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘জপমালার শক্তি আমাদের মুক্তি’। এই অনুষ্ঠানের তীর্থ সংগীত রচনা ও সুর দিয়েছেন জেমস জর্ণেশ চিরান।
.
ক.
‘আমরা মিলন মোহনাতে এসেছি
মাগো তোমারি কাজে
বুকেরি মাঝে
তব নাম লিখে নিয়েছি।’
খ.
‘সবুজ শ্যামল পাহাড় ঘেরা
মায়ের তীর্থভূমি
তোমার চরন রাখি মোরা
শত প্রণাম চুমি’
(মায়ের চরণ : লিপা চিসিম)
.
‘ওয়ানগালা’ মান্দিদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি উৎসব। কৃষিকেন্দ্রিক উৎসব। গারো জনগোষ্ঠী তাদের শস্যের দেবতা ‘মিসি সালজং’কে নিবেদিত প্রথম কর্তিত ফসল অর্ঘ্যদানের উৎসব। ‘আমন ধান রোপণ শেষে বর্ষার ফসল আউস ধান ও অন্যান্য ফসল ঘরে তোলার পর পরই এই ‘ওয়ানগালা’ অনুষ্ঠিত হয়।২১
প্রতিবছর আশ্বিন মাসে এই উৎসবের শুভারাম্ভ। যেমনটি বাঙালি জনগোষ্ঠীর নবান্ন কার্তিকের শেষদিনে। নতুন ধান নতুন চালের পিঠা পায়েসের পারিবারিক সামাজিক উৎসব। কৃষি আমাদের যাপনের ভিত্তি হলেও, শিল্পের দিকে ঝুঁকে পড়বার কারণে কৃষিকেন্দ্রিক উৎসব থেকে আমরা দূরে সরে গেছি।
নাগরিক নবান্ন উৎসব হচ্ছে বটে—তাঁর সাথে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের প্রাণের সংযোগ নেই। চারুকলার বকুল তলায় নবান্ন উৎসব সৌখিন নাগরিকদের কর্পোরেট কৃষি উদযাপন—সেখানে বাহারী রঙের মেলা থাকলেও, সেখানে প্রাণ ও প্রকৃতির স্পর্শ নেই।
‘গারোদের আদিপিতা আ, নিআ, পিলফা শস্যের দেবতা মিসি সালজং এর দর্শন লাভ করেন। সেই সময়ে পিলফার সার্বিক অবস্থা শোচনীয় ছিল। শস্যদেবতা মিসি সালজং তাঁকে শস্যের বীজদান ও আর্শীবাদ করে যান। সেই থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ আদি গারো পিতা শস্য ফলিয়ে এবং তা খাওয়ার আগে বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে শস্য এবং শস্যজাত চু এবং নাচ গান তাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য উৎসর্গ করেন।’২২
এই কৃষিকেন্দ্রিক যৌথসামাজিক উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত প্রথম কাগজ ‘ওয়ানগালা’ স্মরণিকা’৯৯। সম্পাদক রবেতা ম্রং। রবেতা শিক্ষকতার পাশাপাশি গারো সমাজের সাংস্কৃতিক সামাজিক নানা তৎপরতায় নিজেকে যুক্ত রেখেছেন দীর্ঘদিন। এ তল্লাটের একজন পরিচিত সাহসী মানুষের নাম রবেতা ম্রং।
‘যুগের বির্বতনে এবং বিদেশি খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রভাবে আজ গারোরা খ্রিস্টধর্মাবলম্বী’২২ ‘প্রকৃত অর্থে আমি জাতিতে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত বোডো সম্প্রদায়ের গারো, মাতৃসূত্রে বাঁধা এবং অন্যদিকে ধর্মবিশ্বাসে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান’২৩ বললেন সুদিন চিরান।
ধর্মান্তরের দাপট এবং কালের প্রবাহে ওয়ানগালা, রংচুগালা-সহ মান্দিদের বাদ্য বাজনা মান্দি দামা, রাংখ্রাম আদুরী বাজনা পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল।… কারণই ছিল সরল প্রাণ মান্দিদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ। খ্রিস্টধর্মই যে এসব মান্দি কৃষ্টির অন্তরায় বা বাঁধা ছিল তা কিন্তু ছিল না। তখনকার মিশনারীদের এইসব কৃষ্টি পালনে ভুল বোঝাবুঝিই ছিল আসল কারণ।’২৩
সেই ভুল বোঝাবুঝি সহজে কাটেনি। গত শতাব্দীর প্রথম দশকে রাণীখং এ মিশনারীদের কার্যক্রম শুরু হবার পর সোমেশ্বরীতে অনেক জল বয়ে গেছে। নতুন ধর্মাচরণে ওয়ানগালাকে অভিযোজিত করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ভাটিকানের সিদ্ধান্তের জন্য।
‘দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভায় (১৯৬০-৬৫) খ্রিস্টিয় উপাসানালয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিজস্ব ভাষায়, কৃষ্টিতে চালু করার সুপারিশক্রমে অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে বিভিন্ন জাতির মানুষ স্ব স্ব ভাষায়, কৃষ্টিতে খ্রিস্টিয় উপাসনা শুরু করেন।
এভাবেই নিজস্ব ও স্থানীয় কৃষ্টির সঙ্গে ধর্মীয় ভাবধারায় খাপ খাইয়ে সংস্কৃতায়ন করা হয়। এই সংস্কৃতায়নের সুবাদেই আজ আমরা প্রাচীনকালের ঐতিহ্যাবস্থা হারিয়ে যাওয়া এই ওয়ানগালা উৎসবটির জাঁকজমকের সাথে পালন করে থাকি।’২৪
রবেতার সম্পাদিত কাগজ প্রসঙ্গেই কথাগুলো উঠে এলো। রবেতার নিজস্ব প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় অংকন করেছেন সাইফুল ইসলাম। রবেতা প্রচ্ছদের একটি ভাষ্য দিয়েছে। ‘উঁচু পাহাড়ের টিলায় নকপান্থের পাশ দিয়ে কল কল রবে ছোট ঝর্ণা বয়ে গেছে। ঝর্ণা এখানে শুদ্ধতার প্রতীক; আনন্দ উচ্ছ্বাসের প্রতীক রূপে নেওয়া হয়েছে। দোমি যুক্ত ক্রশ—যা অতীত ও বর্তমানের সংস্কৃতায়নেরর প্রতীক। সূর্য সমগ্র খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রতীক। আদুর—যা দিয়ে ওয়ানগালা উৎসবে আসার জন্য জনগণকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। পেছনে দামা বাদকের সাথে দুই নারী আনন্দে নেচে নেচে মোড়ল বাড়ির দিকে যাচ্ছে, ওয়ানগালায় শরিক হতে।’২২
.
* নকপন্থ—যুবদের থাকার ঘর
** দোমিযুক্ত ক্রুশ—মুরগীর পালক লাগানো ক্রুশ
*** আদুর—মহিষের শিঙ্গা
.
রবেতা সম্পাদিত এটি প্রথম সংখ্যা হলেও, এটি মরিয়মনগরের দ্বিতীয় ওয়ানগালা উৎসব। এর আগে ১৯৮৫ সালে মিশনে পালিত হয় এবং ভাটিকান সিদ্ধান্তের পর ১৯৮৪ সালে বিড়ুইডাকুনী মিশনে প্রথম ওয়ানগালা উৎসব পালিত হয়।
ওয়ানগালা একটি হাইব্রিট শব্দ। মান্দি ওয়ান্না আর খ্রিস্টিয় উৎসব থেকে উপজাত গালা শব্দের মেল বন্ধনের ফসল ওয়ানগালা। ধর্মান্তরিত গারোদের এই উৎসব ধর্মপল্লীতে পালন করার জন্য ভ্যাটিকানের সিদ্ধান্তের জন্য ১৯৮৪ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। গারো জীবন দুই বিশ্বাসে বিভক্ত, আবার কেউ কেউ দুইয়ের যৌথায় দেখেছেন মানবের মুক্তি।
তরুণ কবি মিঠুন রাকসাম সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ওয়ানগালা নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে। তার কারণ একটাই। গারোরা তো গারো নেই। তারা হয়ে গেছে খ্রিস্টান। ফলে তারা খ্রিস্ট রাজার পর্ব করছে—ওয়ান্না নয়।
আবার এক শ্রেণির গারো তাদের শিকড়ে ফিরে যেতে চাচ্ছে, ফলে তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। একদল চাচ্ছে খামাল নিয়ে সাংসারেক ওয়ানগালা করতে, আরেক শ্রেণি চাচ্ছে গারোরা তো এখন খ্রিস্টান—তাই খ্রিস্টান রিচুয়াল মেনেই হবে ওয়ানগালা।
তারা খামালের বদলে ফাদারকে সালজং, তাতারা রাবুগা বানাচ্ছে। এতে সমস্যা হচ্ছে আদি গারোদের প্রকৃত ওয়ানগালাকে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, উপহাস করা হচ্ছে, ফলে ওয়ানগালা করতে গিয়ে জগাখিচুড়ি করে ফেলছে! আর সাংসারেক মান্দিরা তো ওয়ানগালা বলে না—তারা বলে ‘ওয়ান্না’। খ্রিস্ট ধর্মের চাপে ওয়ান্নাও হয়ে গেছে ওয়ানগালা।৩৫
এ ছাড়া ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘আপ্সান’। অর্থাৎ একতা। প্রধান সম্পাদক রবেতা ম্রং। নির্বাহী সম্পাদক নিলীপ ম্রং। ওয়ানগালাকে কেন্দ্র করে এটি সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটি মুখপত্র। ছয় ফর্মার স্মরণিকা। এবারই প্রথম মরিয়মনগর ধর্মপল্লীতে উদযাপিত হলো ‘রিচ্চাসা দামানি’ (একশত দামা) ওয়ানগালা ২০১৫। এই সংখ্যায় লিখেছেন—
.
সুভাষ জেংচাম : ওয়ানগালা উৎসব : স্রষ্টার উদ্দেশে গারোদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
সুদিন চিরান : ওয়ানগালা আবাচেংআনি খাৎথা
সঞ্জীব দ্রং : আদিবাসী অধিকার-উপলব্ধি
রবেতা ম্রং : আমাদের শিকড় কোথায়?
মতেন্দ্র মানখিন : গারোদের লোক নৃত্যধারা
নিলীপ ম্রং : গারো আদি সমাজ ও ধর্ম
কবিতা রিখেছেন—
গন্ধচোর : মিঠুন রাকসাম
তবুও এসেছি : লিপা চিসিম
.
আহ্বায়ক লিখেছেন, ‘উৎসবের ভেতর দিয়ে লুপ্ত প্রায় গারো জনগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে আরো সমৃদ্ধ করা, ঐতিহ্যবাহী গারো কৃ্ষ্টি ও সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহিত করা এবং ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্ম এবং শিকড়ের টানে আত্মপরিচয় খোঁজা, জানা ও লালন করার একটি উপায়।’২২
(চলবে)
…………………
পড়ুন
কবিতা
রাংটিয়া সিরিজ : জ্যোতি পোদ্দার
প্রবন্ধ-গবেষণা
টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী
১ম পর্ব । ২য় পর্ব । ৩য় পর্ব । ৪র্থ পর্ব । ৫ম পর্ব । ৬ষ্ঠ পর্ব । ৭ম পর্ব । ৮ম পর্ব । ৯ম পর্ব । ১০ পর্ব । ১১তম পর্ব । ১২তম পর্ব । ১৩তম পর্ব । ১৪তম পর্ব । ১৫তম পর্ব । ১৬তম পর্ব । ১৭তম পর্ব । ১৮তম পর্ব । ১৯তম পর্ব । ২০তম পর্ব । ২১তম পর্ব । ২২তম পর্ব । ২৩তম পর্ব । ২৪তম পর্ব । ২৫তম পর্ব । ২৬তম পর্ব । ২৭তম পর্ব । ২৮তম পর্ব । ২৯তম পর্ব । ৩০তম পর্ব
2 thoughts on “শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৩০তম পর্ব”