shubhobangladesh

সত্য-সুন্দর সুখ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবসময়…

টংকনাথ ও হরিপুরের রাজবাড়ির খোঁজে

Tankanath Rajbari

Tankanath Rajbari

Tankanath Rajbari

টংকনাথ ও হরিপুরের রাজবাড়ির খোঁজে—অনেকটা পথচলা। দেখা হলো : টংকনাথ ও হরিপুর রাজবাড়ি—দুটি পৃথক স্থাপনা। এর সঙ্গে ফানসিটি এমিউজমেন্ট পার্ক, খুনিয়াদিঘি ও স্মৃতিসৌধ, রানীদিঘি, হরিপুর উপজেলা কমপ্লেক্স ও নাগর নদী। খাওয়া হলো হরিপুরের বিখ্যাত খাবার…

ভ্রমণপিপাসু মানুষই শুধু বুঝবেন কথাটির মর্ম, তা হলো—কয়েকদিন ঘরে বন্দি থাকলেই মনটা বাইরে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে। করোনার জন্য ছয় মাস ধরে বাড়ির বাইরে যেতে পারছি না। মন তো আকুপাকু করছে। কী করা যায়?

এ নিয়ে যখন মনে মনে ভাবছি, তখন পথ দেখিয়ে দিলো ফেসবুক। একজনের পোস্ট থেকে জানতে পারলাম, পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলায় রয়েছে বিশাল এক দিঘি রানীসাগর। আর আছে রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি। ভাবলাম রাণীশংকৈল তো কাছেই। দিব্যি ঘুরে আসতে পারি।

দিনাজপুরের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অপু দে’কে সাথে পেলাম। কাজেই দিনক্ষণ ঠিক করে শরতের এক সকালে মাইক্রো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা।

দিনাজপুর থেকে রাণীশংকৈল সড়ক পথে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি পথ রয়েছে। আমরা বেছে নিলাম দিনাজপুর টু পীরগঞ্জ। সেখান থেকে সেতাবগঞ্জ হয়ে যাব রাণীশংকৈল। মাইক্রো চলতে থাকুক। এই ফাঁকে আমি আপনাদের ঠাকুরগাঁও জেলা সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে নেই।

ঠাকুরগাঁও, সংক্ষিপ্ত তথ্য-পরিচিতি

রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪৫৯ কিমি দূরে রংপুর বিভাগের জেলা ঠাকুরগাঁও। এর নামকরণ নিয়ে দু’ধরনের তথ্য পাওয়া যায়।

প্রথমত, ১৮০০ সালের দিকে এক ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে বর্তমান ঠাকুরগাঁও পৌরসভার এলাকার উত্তর পাশে একটি থানা স্থাপন করা হয়। সেই ঠাকুরদের নামানুসারে থানার নাম হয় ঠাকুরগাঁও।

দ্বিতীয়ত, এই এলাকায় ব্রাহ্মণদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে এর নাম হয় ঠাকুরগাঁও। টাংগন নদীর তীরে অবস্থিত এ জেলার অধীনে আছে ছয়টি উপজেলা—ঠাকুরগাঁও সদর, পীরগঞ্জ, হরিপুর, বালিয়াডাঙ্গি, রুহিয়া, হরিপুর ও রাণীশংকৈল। আমাদের আজকের জার্নি শেষের দুই উপজেলায়।

ফানসিটি এমিউজমেন্ট পার্ক

পীরগঞ্জে পৌঁছাতে সময় লাগল না। এখানে শহরের প্রাণকেন্দ্রে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে ফানসিটি এমিউজমেন্ট পার্ক। বাচ্চারা তো খুব খুশি। তারা টপাটপ নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। মনে করেছে সারাদিন এখানেই থাকব।

প্রায় দশ একর জায়গাজুড়ে পার্কের মূল আকর্ষণ হল মেরি গো রাউন্ড, সুপার চেয়ার, ওয়েস্টার্ন ট্রেন, কিডস রাইডস, প্যাডেল বোটস, ব্যটারি কার, থ্রি ডি জু ভিডিও গেমস ইত্যাদি। পার্কের অন্যতম আকর্ষণ হলো দেয়ালে আঁকা বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ছবি। কটেজ সুবিধা আছে। আছে পিকনিক স্পট। স্বপরিবারে সারাদিন কাটানোর মতোই স্পট।

আমরা বের হয়েছি রাজবাড়ি দেখার উদ্দেশ্যে। কাজেই বাচ্চাদের আপত্তি সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়লাম আবার। গন্তব্য রাণীশংকৈল।

Tankanath Rajbari
টংকনাথ রাজবাড়ি সামনে (দাঁড়িয়ে) লেখক
রাজবাড়ি দর্শন, টংকনাথের রাজবাড়ি

দুপুরের দিকে পৌঁছালাম রাজবাড়ির সামনে। ঢোকার মুখে প্রথমেই রয়েছে পুরনো মন্দির—যা এখন ইসকনের অধীনে। সেটা দেখে রাজবাড়ির গেট পার হতেই চমকে গেলাম।

ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জমিদার বাড়ি।

প্রায় ধ্বংসের মুখে থাকলেও, এটা যে রাজবাড়ি, তা যেন নীরবেই বুঝিয়ে দিল আমাদের। ভেতরে প্রবেশ করলাম সদলবলে। মেঝেতে মাটি ছাড়া কিছু নেই। জানালা, দরজা সব খুলে নিয়ে গেছে কে বা কারা। কিন্তু জমিদারির যে গাম্ভীর্য তা টের পেলাম মর্মে মর্মে।

রাজবাড়িটি কুলিক নদীর তীরে অবস্থিত। টংকনাথের বাবা ছিলেন বুদ্ধিনাথ চৌধুরী। তিনি ছিলেন গোয়ালা বংশীয় জমিদারের শ্যামরাই মন্দিরের সেবায়েত।

নিঃসন্তান গোয়ালা জমিদার কাশীবাসে যাওয়ার সময় তাঁর সব জমিদারি সেবায়েতের তত্ত্বাবধানে রেখে যান এবং তাম্রপাতে দলিল করে যান, তিনি কাশী থেকে ফিরে না-এলে শ্যামারাই মন্দিরের সেবায়েত জমিদারির মালিক হবে।

বৃদ্ধ জমিদার আর ফিরে না-এলে বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হন। তিনিই এ রাজবাড়ির নির্মাণ শুরু করেন—যা শেষ করেন তাঁর ছেলে টংকনাথ। তাঁর নামানুসারেই এ বাড়িটিকে টংকনাথের রাজবাড়ি বলে।

চলে আসার সময় পেছন ফিরে চাইলাম। দেখলাম, নিঃসঙ্গভাবে দাড়িয়ে আছে রাজবাড়িটি। দুঃখী মুখ নিয়ে।

যেন অপেক্ষা করছে, কবে কেউ এসে তাকে আবার তার পুরনো রূপ ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করবে।

Khuniya Dighi Memorial
খুনিয়াদিঘি স্মৃতিসৌধ
খুনিয়াদিঘি, স্মৃতিসৌধ

টংকনাথের রাজবাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় যাব, জানতে চাইলাম আকাশের কাছে। সে একটি কীটনাশক কোম্পানিতে চাকরি করে। তার বস বিশ্বনাথ তাকে আমাদের যাওয়ার কথা জানিয়ে রেখেছিলেন। আকাশ দারুণ সার্ভিস দিল আমাদেরকে। সে পুরো জার্নিতেই আমাদের গাইড হিসেবে সাথে সাথে থাকল।

রাজবাড়ি দেখা শেষ হতেই সে আমাদের নিয়ে গেল খুনিয়াদিঘি দেখাতে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অনেক মানুষকে হত্যা করে লাশগুলো এই দিঘিতে ফেলে গিয়েছিল। পাশেই বিশ জন মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে নতুন একটি স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়েছে। মনোমুগ্ধকর তার ডিজাইন।

রানীদিঘি

এখান থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম রানীর দিঘি দেখতে। রামসাগরের চেয়ে ছোট একটা দিঘি। চারপাশে ছোট ছোট পাহাড়। সেখানে সারি সারি লিচু গাছ। বেশ ছায়াময়। নৌকায় ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। পর্যটকদের জন্য আছে অনেকগুলো স্ট্রিটফুডের দোকান। কয়েকটি খাবারের দোকান আছে।

আকাশ আমাদের জন্য প্যাকেট লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছিল। সেগুলোর সদগতি করলাম সবাই মিলে। রানীদিঘির চারপাশে পায়ে চলার ব্যবস্থা আছে। আমরা সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে দিঘির চারপাশে ঘুরলাম। যদিও বুঝতে পারলাম না, দিঘির নাম রানীদিঘি কেন? রানী নিশ্চয়ই অনেকদূর থেকে এখানে স্নান করতে আসতেন না!

Haripur Rajbari
হরিপুর রাজবাড়ি
হরিপুর রাজবাড়ি

বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তে সীমান্ত-ঘেষে অবস্থিত হরিপুর উপজেলা। রাণীশংকৈল থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রানীদিঘি থেকেই বের হতে-না-হতেই সাগরের ফোন চলে এলো।

সাগর, দিনাজপুর সরকারি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হরিপুরের আরো কয়েকজন দিনাজপুরে পড়াশোনা করে। তারা সবাই গ্রিনভয়েস নামক সংগঠনের সদস্য। নিজ এলাকায় অনেকগুলো গাছ তারা রোপণ করেছে। স্থাপন করছে পাবলিক লাইব্রেরি।

‘স্যার, আপনি কোথায়?’ সাগরের কণ্ঠে ব্যাকুলতা টের পেলাম।

‘আমরা রানীদিঘি দেখা শেষে রওয়ানা দিয়েছি।’ বললাম।

মিনিট বিশেক পরেই ওদের সাথে দেখা হলো। আমাদের জন্য ওরা হরিপুর জমিদারবাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিল।

১৪০০ সালের শুরুর দিকে ঘনশ্যাম কুণ্ডুর বংশধররা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন হরিপুর রাজবাড়ি। সে-সময় মেহেরুন্নেসা নামে একজন বিধবা মুসলিম নারী এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। খাজনা অনাদায়ের কারণে তাঁর জমিদারির কিছু অংশ নিলামে উঠলে ঘনশ্যাম কুণ্ডু তা কিনে নেন।

তার পরবর্তী বংশধরের একজন রাঘবেন্দ্র রায় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান রাজবাড়ির নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু তিনি শেষ করতে পারেননি। তাঁর পুত্র জগেন্দ্র নারায়ণ রায় উনিশ শতকের শেষ দিকে বাড়িটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন।

জমিদার বাড়ির সামান্যই দেখতে পেলাম। জরাজীর্ণ অবস্থা। একশ বছরের পুরনো এ বাড়িটির সংরক্ষণের অভাবে দিনের পর দিন ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে।

সাগর জানাল, তারা উদ্যোগ নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তারা এসে ভবনটি পরিদর্শন করে গেলেও, কোন বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। জমিদারির আশেপাশে অনেক জমি বেদখল হয়ে গেছে।

কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ তাঁর একটি সিনেমার শুটিংয়ের জন্য রাজবাড়ি মেরামত করিয়ে নিয়েছিলেন। হরিপুর রাজবাড়ির জন্যও তেমনই কোনো নির্মাতা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে।

হরিপুর উপজেলা কমপ্লেক্স ও নাগর নদী

হরিপুর উপজেলা কমপ্লেক্সও কম আকর্ষণীয় নয়। বেশ নয়নাভিরাম। কমপ্লেক্স দেখানোর পর সাগর আর রাশেদ (সাগরের সঙ্গে এসেছিল) আমাদেরকে নিয়ে গেল নাগর নদী দেখাতে।

নদীর ওপাশেই ভারত। গিয়ে দেখি বিজিবি আর বিএসএফ-এর মধ্যে ফ্লাগ মিটিং চলছে। কাজেই তাড়াতাড়ি বিদায় নিতে হলো সেখান থেকে।

হরিপুরের বিখ্যাত খাবার

হরিপুরের বিখ্যাত খাবার কী? জানতে চেয়েছিলাম সাগরদের কাছে। জবাবে বিদায় নেয়ার সময় আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলো একটা করে প্যাকেট। বলল, স্যার, আমাদের এখানকার বিখ্যাত খাবার।

বাসায় ফিরে দেখি, সেই খাবারটি চানাচুর। খুবই মিহি করে ভাজা চানাচুর—যেমন সুস্বাদু, তেমনি মচমচে।

ঠিক আমাদের ভ্রমণের মতোই মচমচে আর সুস্বাদু।

—বিশ্বজিৎ দাস। সহকারী অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, দিনাজপুর সরকারি কলেজ, দিনাজপুর, বাংলাদেশ

About The Author

শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে থাকুন...