সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের তিন মিনিটের কবিতা
সুমন সরদার
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের তিন মিনিটের কবিতা
‘এই যে নিজের অন্তরাত্মাকে বাহিরে অনুভব করা, এটা প্রথমে মানুষের মধ্যেই মানুষ অতি সহজে এবং সম্পূর্ণরূপে করিতে পারে। চোখের দেখায়, কানের শোনায়, মনের ভাবায়, কল্পনার খেলায়, হৃদয়ের নানান টানে মানুষের মধ্যে সে স্বভাবতই নিজেকে পুরোপুরি আদায় করে। এইজন্য মানুষকে জানিয়া, মানুষকে টানিয়া, মানুষের কাজ করিয়া, সে এমন কানায় কানায় ভরিয়া উঠে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধের এই অংশের সারবস্তু প্রয়োগের বিষয় নয়, এ নিরন্তর সাধনায় হয়ে ওঠার বিষয়। নিরন্তর কাব্যসাধনায় রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের দেখায়, …কল্পনার খেলায়, হৃদয়ের টানে’ এর অবশ্যম্ভাবী ভষ্মে দ্রবীভূত উচ্চারণ—
………………‘পাদ্রিপিতা, ধবধবে ফাদারের কাছে প্রশ্ন :
………………সম্পর্কের তৃষ্ণা পেলে কাকে বাবা বলে ডাকবো?’
কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের ‘তিন মিনিটের কবিতা-৫০’-এ এরকম উক্তি মানবসভ্যতার ভিত নাড়িয়ে দেয়। এ শুধু কল্পনাপ্রসূত নয়, চোখের দেখায় নয় কিংবা হৃদয়ের টানে নয়—এই তিনটির সংমিশ্রণে ইতিহাস, হিংস্রতা ও যুদ্ধশিশুর গল্প।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল সত্তর দশকের কবি হলেও, দশকীয় বন্ধন ছিন্ন করেছেন কাব্যগুণে। যতটুকু আধুনিকতায় নিজেকে রাঙানো যায়, তারও অধিক সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর সাম্প্রতিক কাব্যকে।
………………‘কাঁপতে কাঁপতে শীতল কুয়াশা ঘেরা হিম রাতে
………………করুণার মতো শুয়ে আছো তুমি অসহায় শিশু
………………দুঃখিনী দ্বীপের মতো জেগে আছো একাকী সাগরে।’
………………(নিঃসঙ্গ/ তবু কেউ কারো নই, ১৯৮৫)
জীবনানন্দ-ঘেঁষা এরকম উচ্চারণ থেকে বেরিয়ে এসে আজ তিনি নিজেই গড়ে তুলেছেন নিজস্ব এক কাব্যসত্তা। যেখান থেকে পৃথিবীটা দেখলে ক্রমশ ছোট থেকে ছোট হয়ে যায়। কখনো কখনো তিনি চলে যান বোধের বাইরে আবার কখনো মানুষের ভিড়ে নেমে এসে মানবতার বর্তমান ভিতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান।
একে কেউ আন্দোলন-বিদ্রোহ বলেও শনাক্ত করতে পারেন, আবার কেউ তাঁর কবিতায় সন্ধান পেতে পারেন বৈশ্বিক চরিত্র। তবে আমার মতে, তাঁর বর্তমান কবিতাসমূহে যুগপৎভাবে চারটি চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়, বৈশ্বিকচারিত্র্য উপস্থাপন, দেশিয় উপাদান, প্রতিবাদ ও বৈশ্বিক চরিত্রকে টেনেহিঁচড়ে গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্যমণ্ডিত ধানক্ষেত-শালিকের ভূমিতে প্রতিস্থাপন।
যেমন—
………………‘মুগ্ধতার দিকে হাত বাড়িয়ে লাভ নেই,
………………ভুলে যাওয়া পুরনো গানের মতো
………………মায়ের গন্ধ মূল্যবান।’
কিংবা,
………………‘আমরা ছিলাম পাখির মতো—
………………অবিবাহিত।’
অথবা,
………………‘প্রতিটি ভাষাই প্রাণের পুষ্প
………………গৌরব,
………………বাংলা ভাষায় গেঁথে থাকে ঘ্রাণ—
………………সৌরভ!’
আবার,
………………‘ক্লিনটন সিলি, ডানিউল চুক, উইলিয়াম রাদিচের মতো তিনিও
………………বাংলা লিখছেন অভিধানের পাতা থেকে, দেখে’
………………(তিন মিনিটের কবিতা-৩৭, ৩৬, ৩৪ ও ৭)
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের কবিতার আড়ালের ইঙ্গিত পাঠ করা শক্ত—যা সম্ভব নয়, অর্থভেদে কিংবা সঙ্কেত পাঠে তা সম্ভব। এরকম জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া তাঁর সাম্প্রতিক কবিতায় মেলে,
………………‘… … …
………………উস্কানিমূলক রোদের রথে চড়ে তৃতীয় স্থান হিথ্রোতে এসো,
………………টেমসে তালা ঝুলিয়ে ফেলে দেবো চাঁদ এবং চাবি।
………………শুধু আকাশের আলোতে জল-জাহাজে জ্বলবে
………………আমাদের ধর্মহীন সম্পর্ক,
………………সঙ্গম খেলা।’
………………(তিন মিনিটের কবিতা-৪৬)
সমাজ নিরন্তর পরিবর্তনশীল। মানুষের আচরণ, বোধ, কাঠামোগত উন্নয়ন, জীবনপ্রবাহের পরিবর্তন ঘটলে কবিতায় ব্যবহৃত শব্দেরও পরিবর্তন ঘটে। মুঠোয়ভরা পৃথিবীর এ-প্রান্তের মানুষের খবর ও-প্রান্তের মানুষের কাছে পৌঁছে যায় অনায়াসে। আবার ও-প্রান্তে বসবাসরত কবির কবিতায় এ-প্রান্তের মানুষের কিছু কষ্টের চিত্র ফুটে ওঠে ফেলে যাওয়া কিছু শব্দের অনুরণনে—যা শাশ্বত।
সুদূর প্রবাসে বসে কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল দেখতে পান এদেশের মেহনতি মানুষের কষ্ট। এক্ষেত্রে কবিতায় তাঁরও শব্দ পরিবর্তিত হয়ে ফিরে আসে ভাত খাবো বলে—
………………‘ভাত খাবো বলে—
………………শুধু পিঠের ঘাম-নুন যথেষ্ট নয়,
………………নুন আনতে পান্তা ফুরায়
………………তাই একটু নুন ধার করেছি,
………………চুরি করেছি কাঁচা মরিচ।’
………………(তিন মিনিটের কবিতা-৫)
তিনি লিখেন—
………………‘স্তন মাতৃক দুধেও পোকা, অদ্ভুত ভেজাল
………………বাজে ভেজাল পিতাপুত্রের সম্পর্কে
………………ফুলে ঘ্রাণেও ভেজাল পবিত্র গ্রন্থে,
………………প্রার্থনায়।
………………এবং সঙ্গমে।
………………স্বপ্ন, নিদ্রা, শিশুদের কান্নাতেও ফরমালিন।’
একই কবিতার উপসংহারে আবার নির্দ্বিধায় তিনি বলে ওঠেন—
………………‘পৃষ্ঠা উল্টাও। চলো চা খাই।’
এ যেন অনিবার্য। হবারই ছিল, হয়েছে। কবিতায় ব্যতিক্রমী বিষয় বেছে নেয়া তাঁর পছন্দ। ভবিষ্যতে তিনি কোন বিষয় নিয়ে কবিতা লিখবেন, তারও ইঙ্গিত দেন অন্য কবিতায়। তিন মিনিটের কবিতা : ২২-এর শেষাংশ এরকম—
………………‘জীবনের আগে এবং জীবনের পরে
………………এই নিয়েও একটি কবিতা লিখবো, ভাবছি!
………………হয়তো জন্মের কথা থাকবে না এবং বিবাহ না।’
জীবনের আগে বা জীবনের পরে না আলো, না অন্ধকার; কিংবা অস্তিত্বহীন। অস্তিত্বহীন সময়কে নিয়ে তিনি কবিতা লিখতে চান—যা প্রকাশ করেন আগাম কবিতায়। যদি লিখেন তা কেমন হবে?
এ-জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো বিষয় তো উপজীব্য হতে পারে না। লিখলে তা জীবনের আগে বা পরে কী করে হয়! এমন একটি কবিতার স্বাদ পেতে মুগ্ধপাঠক অপেক্ষা করতেই পারে।
কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের জন্ম ১৯৫৮ সালে ৩০ মে শেরপুরে। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কবিতার পাশাপাশি তিনি দুই হাতে লিখেছেন ছড়া-শিশুসাহিত্য, উপন্যাস, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, গীতিকবিতা, প্রবন্ধ সাহিত্য এবং সম্পাদনা করেছেন নানা গ্রন্থ।
ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতা দিয়ে শুরু, এখনো এই পেশাতেই যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেই তাঁর জীবন। তাই তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতার সম্পাদনা ছাড়াও ‘আমার সঙ্গে শেখ মুজিবের দেখা হবে আজ’ শিরোনামে কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে ২০২০ সালে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে আছে—সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব (১৯৯৩), শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ : মুজিব হত্যা মামলা, বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন, কানাডার কাশিমপুরে খুনি নূর চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু : ১০০ কবির ১০০ কবিতা।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : তৃষ্ণার্ত জলপরী (১৯৮২), তবু কেউ কারো নই (নাসিমা সুলতানার সাথে যৌথ, ১৯৮৫), অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো (১৯৮৭ এবং ১৯৮৯), শহরের শেষ বাড়ি (১৯৯১), ঘাতকের হাতে সংবিধান (১৯৯০), একি কাণ্ড পাতা নেই (১৯৯৫), দ্রবীভূত গদ্যপদ্য (১৯৯৯ এবং ২০০১), ঐক্যের বিপক্ষে একা (২০০০), মুক্তিযুদ্ধের পঙক্তিমালা (২০০১), এলোমেলো মেঘের মন (২০০০), নির্জনে কেনো এতো কোলাহল (২০০০), পরের জায়গা পরের জমি (২০০৪), নিদ্রার ভেতর জেগে থাকা (২০০৪), ঘৃণিত গৌরব (২০০৫), কবিতাসমগ্র (২০০৬), নীড়ে নিরুদ্দেশে (২০০৮), সাতে নেই, পাঁচে আছি (২০১২), রবি ঠাকুরের প্রাইভেসি (২০১৫), পাখিদের গ্রামে আজ একটি গাছের সাথে সাক্ষাৎ করার কথা (২০১৭), ফেরোমনের গন্ধে নেশাগ্রস্থ প্রজাপতি (২০১৭), তোমার বাড়ি কত দূর (২০১৭), প্রেমের আগে বিরহে পড়েছি (২০১৮), সঙ্গমের ভঙ্গিগুলো (২০১৯), পাখিদের অবিবাহিত জীবন (২০২০)।
…………………
পড়ুন
গীতিকবিতা
প্রবন্ধ-গবেষণা
নাসির আহমেদের কবিতা : জীবনঘনিষ্ঠ মৃত্যুর নন্দনশিল্প
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের তিন মিনিটের কবিতা
মতামত
শাহীন সরদার : কবিতার গানে তাঁর বেঁচে থাকা
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা
সুনীল শর্মাচার্যের দশটি কবিতা
নাসিমা খাতুনের কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের কবিতা