
খুচরো কথা চারপাশে
দাড়ি-গোঁফ নামচা
সুনীল শর্মাচার্য
দাড়ি-গোঁফ নামচা
আজ সকালে ভাবছিলাম, আমরা কী চাই! ভাবতে ভাবতে দাড়ি কাটতে গিয়ে অসাবধানে গোঁফ উড়ে গেল! যা! কী হবে? পুরোটাই উড়িয়ে দিয়ে ভাবলাম, গোঁফ না-থাকলে কি হয়? দাড়ি-গোঁফ কী সুস্বাস্থ্যের প্রতীক? তবে গোঁফ-দাড়ি রাখাটা ব্যক্তিরুচির ইচ্ছে!
দেখি, বৈষ্ণবরা অনেকেই গোঁফ-দাড়ি রাখেন না; আবার অনেক ভেকধারী বৈষ্ণবদের দাড়ির শেষে একটা গিট বেঁধে রাখতে দেখি। অনেক মুসলিম ভাইদের গোঁফ-দাড়ি রাখেন নূরানী সৌন্দর্যে।
আসলে গোঁফ-দাড়ি কেবল ধর্মীয় নয়, মূলত সামাজিক ও ব্যক্তিগত ভাবনার সঙ্গে যুক্ত। নারীদের কেশদাম ক্ষতিকর প্রমাণিত হলেও, তাঁরা নিশ্চয়ই কেশশূন্য হবেন না!
আসলে, মাথায় বড় চুল-দাড়ি-গোঁফ রাখাটা বাড়তি ঝামেলা। গোঁফ-দাড়ি-চুল পরিচ্ছন্ন না-রাখলে রোগ হওয়াই স্বাভাবিক। তবু এও সত্যি, যতই ক্ষতি হোক, অনেকেই গোঁফ শূন্য হতে পারবেন না।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর স্মারক সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনেকে তাঁর দাড়ি ছিঁড়ে নিয়েছিলেন। তবু রামকৃষ্ণ, ঋষি অরবিন্দ, ফ্রয়েড, টলস্টয়, হোমার দাড়িবিহীন ভাবা যায় না।
একদা শিবসেনা প্রধান ঠাকরে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কংগ্রেসকে হটিয়ে দাড়ি কামাবেন।
কত রকমের দাড়ি। উনিশ শতকের বিশেষ পর্বে চাপ দাড়ি ছিল প্রগতিশীলতার লক্ষণ। ফ্রেঞ্চকাট শুরু ১৬৪০-৫০ নাগাদ। এর বড় প্রচারক মাইকেল। আছে গোলাকার, ছাগ (কেবল চিবুকে একগুচ্ছ) ছাঁটা, খোঁচা, ফিলজফার মার্কা দাড়ি। আছে কাঠবিড়ালির লেজের মতো দাড়ি, ইম্পিরিয়াল দাড়ি, আরো কতো কি!
তুর্কি সমাজে অভিজাতদের থেকে আলাদা করার জন্য গোলামদের দাড়ি কামিয়ে দেওয়া হতো। দাড়িহীন সমাজে অসম্মানের পাত্র ছিল। অপরাধীদের কড়া শাস্তি ছিল দাড়ি কামিয়ে দেওয়া।
দাড়ি যৌবনের প্রতীক। শুক্রাশয় থেকে নির্গত টেস্টোস্থেরন হরমোনের প্রভাবে কেবল পুরুষদেরই দাড়ি গোঁফ হয়।
আমাদের সমাজে মেয়েদের দাড়ি গজালে টিটকারির সম্মুখীন হতে হয়। বিরল ক্ষেত্রে ওভারির মধ্যে টেস্টিকিউলার টিস্যুর পরিমাণ অধিক হলে ও করতে টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে মেয়েদের দাড়ি গজাতে শুরু করে।
মায়ানমারের ম্যাটফুন নামের নারীর শরীর ছাগলের মতো চুলে ঢাকা। তার সন্তানদেরও ওই অবস্থা।
শোক পালনের সময় অধিকাংশ সম্প্রদায় দাড়ি-গোঁফ রাখেন।
অষ্টাদশ শতকের শুরুতে পিটার দ্য গ্রেটের রাজত্বকালে রাশিয়ায় দাড়ি রাখার জন্য দৈর্ঘ্য অনুযায়ী কর দিতে হতো। দাড়ি নিষিদ্ধ করেছিলেন আলেকজাণ্ডার ও তাঁর পিতা ফিলিপ।
রোমান যুবকরা প্রথম দাড়ি-গোঁফ দেবী ফরচুনার নিকট উৎসর্গ করতো। এই জন্য দেবীকে ‘ফরচুনা বারবারা’ বলা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে রোমের রাজা লুসিয়াস টার্কুইনিয়াস প্রিভাকাস প্রথম ক্ষুরের ব্যবহার করেন।
প্লিনি বলেছেন, স্কিপিও আফ্রিকেনাস (২০৬-১৮৪ খ্রি.পূ.) প্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রতিদিন দাড়ি কাটতেন। তিনিই প্রথম রোমে দাড়ি কামানো শুরু করেন।
ইরানে একসময় দাড়ি না-রাখাই ছিল আমিরি স্টাইল। ভারতে বাদশাহের মধ্যে প্রথম দাড়ি কামান আকবর। জৈন ও বৌদ্ধরা দাড়ি-গোঁফ রাখেন না।
নরওয়ের হান্স ল্যাংমেথের (ল্যাং সেট) ১৭.৫ ফুট লম্বা দাড়ি ছিল। মারা যান ১৯২৭ সালে। ওই দাড়ি সংরক্ষিত আছে। কলকাতার শিবশঙ্কেরের ছিল ৮০ ইঞ্চি দাড়ি।
যারা দাড়ি রাখেন, সারা জীবনের চর্চা ধরলে ৫/৬ বছর এর পেছনে ব্যয় হয়। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক দাড়ি-গোঁফ চর্চা প্রতিযোগিতা হয়।
একবার দাড়ি অলিম্পিক হয়েছে অস্ট্রিয়ায়। এই শিল্পে ১৭ টি বিভাগে প্রতিযোগিতা হয়। দাড়ি মুখে ঘা বা দাগ আচ্ছাদন করে। দাড়ি অনেক ঘাটতি পূরণ করে—উচ্চতা কম, আওয়াজ সরু ইত্যাদি। ব্যক্তিত্ব বাড়ে।
আব্রাহাম লিঙ্কন নাকি দাড়ি রাখার জন্য নারীদের ভোট বেশি পেয়ে জিতেছিলেন। হাক্সলি বলেছেন, দাড়ির যৌন উত্তেজক ক্ষমতা আছে।
সুতরাং দাড়ি-গোঁফের ইতিহাস দীর্ঘ। এদের ত্যাগ করা অসম্ভব। সকালে গোঁফ উড়িয়ে ভাবছি, দাড়ি-গোঁফযুক্ত ব্যক্তিদের পরিচ্ছন্ন থাকা অবশ্যই অধিক জরুরি।
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
গল্প
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
22 thoughts on “দাড়ি-গোঁফ নামচা”