
খুচরো কথা চারপাশে
ধুতি হারালো তার কৌলীন্য
সুনীল শর্মাচার্য
ধুতি হারালো তার কৌলীন্য
কথায় বলে অশন, বসন, ব্যসন। এই জেটযুগে বাঙালির অশন-কালচারে পরিবর্তন হয়েছে সহজবোধ্য কারণেই। কিন্তু বসনে যে পরিবর্তনের ছোঁয়া, তার কারণ নিয়েই বিতর্ক। যুগটা ফ্যাশনের। প্যান্টের নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখে সত্যি অবাক হতে হয়। শহরাঞ্চলে ধুতি পরিহিত ভদ্রলোক এখন প্রায় আঙুল দিয়ে গোনা যায়।
ক’দিন আগে এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ওঁর কথায়, শার্টপ্যান্টের স্বাচ্ছন্দ্য ধুতি-শাড়িকে ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে। সত্যি কি তাই? ধুতির ব্যাপারে না-হলেও পরিসংখ্যান বলছে—যতই সালোয়ার-কামিজ জনপ্রিয়তা অর্জন করুক, এখনো আশি শতাংশ নারী শাড়ি-পরিহিতা।
দমফাটা গরমে চিঁড়েচ্যাপটা ভিড়ে যদি শাড়ি পরিধান করা যায় এবং শালীনতা বজায় রাখা যায়, তবে এ যুক্তি খাটবে কি?
ধুতি পরার নিয়ম জানলে নিশ্চয় এ-কথা বলা যেত না। যে লোকটি খেজুর গাছে বা তাল গাছে সড়সড় করে চড়ে, তার পরনেও কিন্তু ধুতিই দেখেছি।
স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে বাংলার বিপ্লবীদের প্রতিটি অভিযান—বিনয়-বাদল-দীনেশের রাইটার্স বা মাস্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন বাদ দিলে সকলের পরনে মালকোঁচা মারা ধুতিই ছিল সে আমলের দামাল বিপ্লবীদের পোশাক। সে ক্ষুদিরাম বসু বা প্রফুল্ল চাকীই হোন বা পেভ-ডগলাস নিধনকারী বিমল দাশগুপ্তই হোন।
তা ছাড়া রাইটার্স অভিযান বা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সাহেবি কেতার পোশাকের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ পুলিশকে বিভ্রান্ত করা। রবীন্দ্রনাথ বলতেন—স্টাইল হলো মুখশ্রী, ফ্যাশন হলো মুখোশ।
স্টাইল বলতে তিনি ধুতির স্টাইলের কথা বলেছেন কি-না জানা নেই। তবে বাঙালির পোশাকের আভিজাত্য এসেছে ঠাকুরবাড়ির পোশাক নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকেই। এই পোশাক সচেতনতা এসেছিল প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর—সবারই সৌজন্যে।
রবীন্দ্রনাথের মেজদা প্রথম আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুযোগ্যা সহধর্মিনী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীই আজকের বহুল প্রচারিত সামনে কুঁচি দেওয়া বোম্বাই ঘরানার শাড়ি পরার রীতি চালু করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ধুতিটাকে কুঁচিয়ে পাজামার মতো করে পরার চল চালু করেছিলেন স্বদেশিয়ানা ও সাহেবিয়ানার মিল করে।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের অন্তঃপুরেই শিক্ষিত করার জন্য দরকার পড়েছিল ব্রাহ্ম সমাজের শিক্ষকদের। বাইরের পুরুষদের সামনে স্বাচ্ছন্দে বেরোনোর তাগিদেই এলো শাড়ির সঙ্গে সায়া, সেমিজ ইত্যাদি।
বাঙালির নিজস্ব পোশাক কি জানতে চাইলেই বোধ হয় ধন্ধে পড়তে হবে। কেউ বলবেন, পায়জামা-পাঞ্জাবি। এটাতে মোগল-পাঠানের গন্ধ আছে। কেউ বলবেন, ধুতি-পাঞ্জাবি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কথা বাদ দিয়ে তারও আগে বাঙালির ইতিহাস ঘাটলে স্বনামধন্য বাঙালি হিসেবে চলে আসে ৫০০ বছর আগের চৈতন্য মহাপ্রভু তথা নদীয়ার নিমাইয়ের কথা। নিমাইয়ের যে পোশাকের কথা জানতে পারা যায়—ধুতির সঙ্গে উড়নি, যাকে উত্তরীয় বলা হয়। সেটাই বোধ হয় আদি ও অকৃত্রিম বাঙালি পোশাক।
তবুও প্যান্টের এত কদর কেন? ব্রিটিশ বিতাড়নে বাংলা তথা বাঙালির অবদান অনস্বীকার্য। তার আগে এই বাঙালিই বুঝেছিল—যদি দু’কলম ইংরেজি শিখে নেওয়া যায় এবং সাহেবি কেতায় প্যান্টালুন পরা যায়, তবে মুন্সিগিরি ঠেকায় কে?
বনেদি কলকাতার বাবু কালচারের যুগে মধ্য কলকাতার বৌবাজার থেকে উত্তর কলকাতার বনেদি পাড়া শোভাবাজার, বাগবাজারের বাঙালি তাই ধুতি ছেড়ে কোট-প্যান্টে অভ্যস্ত হলো। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ছে।
ইংরেজ চলে যাওয়ার সময় সাহেব-মেমরা চাঁদপাল ঘাটে জাহাজে চড়ছেন, বিদায়-বেলায় তাঁদের জন্য কী দিয়ে যাচ্ছেন—এ-কথা কলকাতার বাবু-বিবিরা জিজ্ঞেস করায় এক মেমসাহেব ছুঁড়ে দিলেন হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ আর সাহেব দিলেন কোট, প্যান্ট আর টাই।
বাঙালি সেই থেকেই অভ্যস্ত হলো কোট-প্যান্টের আভিজাত্যে। ধুতি হারালো তার কোলীন্য। ধুতির কদর এখন শুধু বিয়ের ছাঁদনাতলায় বা শ্রাদ্ধ-শান্তির তর্পণে। তাই এখন ছুঁচোর কেত্তন কদাচিৎ দেখা গেলেও, কোঁচার পত্তন দেখতে পাওয়া ভ্যাগ্যের ব্যাপার।
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প: সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হাল্কা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
রাজনীতি বোঝো, অর্থনীতি বোঝো! বনাম ভারতের যুবসমাজ
13 thoughts on “ধুতি হারালো তার কৌলীন্য”