
ছয়টি কবিতা
নাসিমা খাতুন
নাসিমা খাতুনের ছয়টি কবিতা
জন্মান্তর
আজকাল প্রতিটা মৃত্যুর মাঝে
নিজের লাশ খুঁজে পাই,
চামড়ার গোপনে শুনি মৃতের গন্ধ।
.
প্রতি মুহূর্তে দাফন হই
একেকটা শবের কবরে,
নির্লিপ্ত চোখে অনবরত রোপন
করি কবরের মাপ,
একে একে দাফন করি
নিজের অসংখ্য শরীর।
.
শত শত লাশের অঙ্গীকার বুকে নিয়ে
শবের গর্ভে পুনরায়
দেখি নিজের পুনর্জন্ম।
.
আগাছা
আগাছার আবাদ হয় সন্তর্পনে অন্তর্জালে,
ফরমালিনে বা কীটনাশকে লকলকিয়ে
গজিয়ে উঠে চেতনার উঠোন বাড়িজুড়ে।
এতো দিকবিদিক মাথা চাড়া দিয়ে উঠে যে
নিজেকেই আর দেখা যায় না আগাছার ভিড়ে।
.
ডুবে যাই, হারিয়ে যাই—
খুঁজে পেতে বেগ হয় বড্ড বেশি
কোনো কাস্তে নেই, শাবল নেই, কুড়োল নেই
কী দিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট করি বুকের পাঁজর?
.
উঠোনজুড়ে রোপন করতে চাই শুধুই বিশুদ্ধতাকে—
চাই পলির আবাদ, প্রত্যাশার আবাদ, আলোর আবাদ,
দেবে কেউ একমুঠো বীজের সন্ধান আমাকে?
.
মুখোশ
মুখের ত্বকে ভদ্রতার কারুকাজ
খুবসুরতে সাধুতার তৈলচিত্র—
কৌশলী লৌকিকতায় দিব্যি সহবাস,
আদতে পশুত্বের চেহারায়
আমার গোপন বসবাস।
.
তোমার সাথে পাতানো ভালোবাসার মিথ্যে উল্লাস,
ভেতরে ভেতরে নিজের প্রোটোপ্লাজমের সাথে
নিজের গোপন ফন্দির আলাপ।
.
অসীম রেখায় সসীম বৃত্তের গোলক ধাঁধাঁ,
বাতির নিচে অন্ধকারে বন্ধ্যা সূর্যমূখীর চাষ।
.
প্রতিনিয়ত ইবলিশের ফর্মুলায়
হরহামেশা মুখস্ত করে যাচ্ছি
ধোঁকাবাজি দিনযাপনের
ডুপ্লিকেট রোজনামচা।
.
পোড়া আলো
একটি নেশার পেয়ালা ঠোঁটে ছুঁইয়ে
বুদ হয়ে বসে আছি নৌকার গলুইয়ে,
মাস্তুল হাতে নিরুদ্দেশের পথে অচেনা নাবিক।
.
জলসার মাতাল আসরে বেহুঁসে নেচে যাচ্ছি
একরোখা হ্যামিলিয়নের স্বৈরতান্ত্রিক ইশারায়।
.
পথে যেতে খড়কুটোর সাথে দেখা,
যেন আস্ত একটা বিলাপের মঞ্চ।
উত্থান-পতনের পৈচাশিক বিরাম চিহ্নের
তীর্যক হাসি বুকে নিয়ে বসে আছে দেবতার আসনে।
হস্তরেখায় ফেরি করছে কালের মহাযাত্রা।
.
দূরে নিবু নিবু পোড়া হারিকেনের গন্ধ,
আমি খোঁড়া গাধার পিঠে চড়ে অফুরান দৌঁড়াচ্ছি
ভাঙা আলোর হাতে দিন-রাত্রির
সমস্ত ক্ষতগুলি জমা দেবার নেশায়।
.
প্রতিবিম্ব
গতকালের মরা স্বপ্নের ক্যানভাসে
ছোপ ছোপ রক্তের জলছায়ারা মৃত্যু পথযাত্রী।
কিছু কিছু উপকারী প্রদীপ আয়নায়
নিজেদের মুখ দেখছে আত্মতুষ্টির বিষাদে।
.
ব্যবহারিক ক্লাসের আদিম কঙ্কালগুলি
লাশকাটা ঘরে নির্বাক বসে আছে
নিজেদের মৃত্যুর সার্টিফিকেট লিখবে বলে।
.
খাটিয়াটা মৃতের মুখশ্রী মুঠোয় পুরে
লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে বসে
অনবরত পাঠ করছে গুণিতক সংখ্যার কবিতা।
.
এই সন্ধ্যার অবেলায় সারি সারি মৃতেরা
জানাজা করছে বিবেকের লাশ ঘিরে,
ইমাম এক ছদ্মবেশী মুসাফির,
দু’চোখ কপালে ঠেকিয়ে আঙুলে
গুণে যাচ্ছে শিশুবেলার নামতা—
‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।’
.
দহন
দিনরাত কালিঘাটের শ্মশানে নিজেকে পোড়াই,
চিতায় তুলি কতবার হৃদয়ের অস্থিমজ্জা।
মাথার উপরে কাকের ঠা ঠা শব্দ,
মগজের কুয়ো পারে বারবার নিজেকে
বিদায়ের ফুল চন্দনে সাজাই
তবুও পোড়া দেহ আবার জেগে ওঠে—লালসার স্ফুলিঙ্গে।
.
একটা নাছোরবান্দা স্বপ্ন হেঁটে যায় প্রভাতের হাত ধরে,
পিছু ফিরে আড়চোখে চেটে খায় পুড়ে যাওয়া দেহ,
খুঁড়ে খুঁড়ে আঁচলে তুলে নেয় ভস্ম হওয়া ছাই।
তবু ফেলে যাওয়া একমুঠো অস্থিমজ্জা
আবার উঠে দাঁড়ায়—লালসার স্ফুলিঙ্গে, আবার, বারবার…
.
এ দহনে পোড়া ছাই পুড়ে হয় খাক,
তবুও তার মৃত্যু নেই, জরা নেই, ক্লান্তি নেই,
বুকের গোপন কপাট খুলে বেদনার অলিন্দে
বারবার জেগে উঠে—লালসার বীজ হাতে।
জ্বলে পুড়ে ছারখার হতে প্রতিবার জন্ম নেয়—
ভস্মীভূত স্বপ্ন, বাসনার পোড়া দহন।
…………………
পড়ুন
কবিতা
2 thoughts on “নাসিমা খাতুনের ছয়টি কবিতা”