৬৯তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা
নাসির আহমেদের কবিতা
জীবনঘনিষ্ঠ মৃত্যুর নন্দনশিল্প
সুমন সরদার
নাসির আহমেদের কবিতা
কাব্যালোচনার জন্যে কেউ কবিতার নির্মাণশৈলীর চমৎকারিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চান। আবার কেউ কবিতার আত্মানুসন্ধানে মনোযোগ দিতে চান। কেউ-বা মনে করেন, কবির দেশ, সময়, সমাজব্যবস্থা, কবির বাস্তব অভিজ্ঞতা, প্রতিভার মাত্রা প্রভৃতি অনুসন্ধানের মাধ্যমে কবিতার সমগ্র তাৎপর্য উদ্ধার সম্ভব। কবি নাসির আহমেদের কবিতা আলোচনা করতে এর যে কোনো মত গ্রহণ করলেই তাঁর কবিতার নিগূঢ় প্রদেশে অবগাহন করা যায়।
কেননা তিনি কবিতা নির্মাণে আজীবন সহজাত। সহজাত ভঙ্গিতেই রচিত তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় ছন্দ, চিত্রকল্প, বাক্-ভঙ্গি এবং বিন্যাসের কারুকাজ। সহজাত গুণটির সঙ্গে শিল্প-ভাবনার পরিপক্কতা তাঁর কবিতায় যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা।
বাংলা কবিতা এক জায়গায় থেমে নেই। সময়ের সঙ্গে, যুগের সঙ্গে কবিতার বিষয় ও নির্মাণশৈলীর পরিবর্তন ঘটেছে। কবি নাসির আহমেদ এ দু’স্তরেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন সফলভাবে।
নাসির আহমেদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আকুলতা শুভ্রতার জন্যে’ (১৯৮৫) থেকে ‘আমি স্বপ্ন তুমি রাত্রি’ (১৯৯১) পর্যন্ত চারটি কাব্যগ্রন্থের মূল উপজীব্য প্রেম ও উজ্জ্বল দিনের আকুতি। ‘বৃক্ষমঙ্গল’ (১৯৯৬) কাব্যগ্রন্থে এসে পূর্ববৈশিষ্ট্যের মধ্যে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। বিষয়, ভাব ও নির্মিতিতে এক লক্ষণীয় বাঁক নিয়েছে তাঁর কবিতা।
আর অষ্টম কাব্যগ্রন্থ ‘বিধ্বস্ত শহর ছেড়ে যেতে যেতে’ (২০০০)-এ এসে তিনি অন্য এক কবি-ব্যক্তিত্ব। এখানে এসে এমন এক বাঁক নিয়েছে তাঁর কবিতা, তরুণতম কবির শিল্পভাবনার অগ্রভাগে তিনি অবস্থান করছেন।
এর পর ‘গোপন তোমার সঙ্গে’, ‘ভয়াবহ এই নির্জনতা’, ‘গলে যাচ্ছে আকাঙ্ক্ষার মোম’, শ্রাবণের দুঃখপদাবলী’, ‘স্কপ্নে পাওয়া’সহ আরো বেশ কয়েকটি গ্রন্থে হয়েছেন তিনি আরো ঋদ্ধ। এ কার্যকরী পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে তাঁর স্বভাবজাত কবিত্বশক্তির কারণে।
প্রধানত তিন পর্বের প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থগুলোতেই তিনি খেলেছেন নানা ভাব-বিষয়ের খেলা। পরের পর্ব আগের চেয়ে পূর্ণতা পেয়েছে—এমন সরলীকরণের কোনো সুযোগ নেই। এ পর্ব বিভাজন তাঁর কাব্যের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। কি শিল্প-ভাবনায়, কি বিষয়ে, ছন্দে, চিত্রকল্পে কিংবা নির্মিতির অনন্য সাধারণ প্রতিভা গুণে তিনি ব্যাপক পাঠক ও সমালোচকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন।
নাসির আহমেদের কবিতার মূল সুর প্রেম। কবিতায় প্রেম অনুষঙ্গের প্রতি তাঁর যে তন্ময়তা—তা সাধারণ পাঠকের অনিবিড় পাঠেই ধরা পড়ে। কিন্তু তাঁর সমগ্র কবিতা পাঠে এ-মত সাদামাটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
ডি এইচ লরেন্সের সমগ্র রচনার শেকড়েই যৌন-মিলনের প্রসঙ্গ ঘুরে-ফিরে এসেছে। কিন্তু লরেন্সের রচনায় যৌনতার সহজাত পথের আড়ালে কিংবা তলদেশে পৌঁছলে আর এক ঈঙ্গিতপূর্ণ রহস্যঘেরা জগত দেখতে পাওয়া যায়। এর আলোতে অবগাহন করে দিক্ভ্রান্ত জীবন পায় সত্যের ভিত্তি।
নাসির আহমেদের কবিতায় ডি এইচ লরেন্সের রচনাশৈলী অনুপস্থিত থাকলেও, গভীরতার নিশ্ছিদ্র আলয়ে ঈঙ্গিতপূর্ণ রহস্যতা উপস্থিত। তিনি প্রেমের কবিতার আড়ালেও, রেখে যান ইহ ও পরলৌকিক যুগল সুর-মুর্ছনা।
অনেক সমালোচকের দৃষ্টিতে কবি নাসির আহমেদ প্রেমিক-কবি। তিনি ব্যক্তি হিসেবে কতটুকু প্রেমিক, তার উপস্থাপনা আপাতত আমাদের বিবেচনা বহির্ভূত। কিন্তু কাব্যক্ষেত্রে তাঁর আত্মোপলব্ধির বাতাবরণে যে রশ্মি ছড়িয়েছেন, তার চুলচেরা বিশ্লেষণে কারো কার্পণ্য গ্রহণযোগ্য নয়।
নাসির আহমেদের কাব্য নিরীক্ষায় এক গোপন বার্তা ধরা পড়ে। তিনি কবিতার চরণে ভর করে যাই বলতে চান না কেন, যে বিষয়কেই স্পর্শ করুন না কেন—তাতে থাকে এক ধরনের প্রেমের প্রলেপ।
নিটোল ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি দ্রোহ, নিসর্গ, মৃত্যুচেতনা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জীবনের জয়গান, দার্শনিক অভিজ্ঞতা, নস্টালজিক আবহ প্রভৃতি তাঁর কবিতার রূপবৈচিত্র্য হিসেবে আমাদেরকে আন্দোলিত ক’রে এক সুখ-বিষণ্ন অন্তরালে ঠেলে দেয়।
প্রেমার্ত কবি নাসির আহমেদ নারীর প্রয়োজনকে কাব্যভাবনায় নিয়ে এসেছেন সুন্দরভাবে। চাদরের প্রতীকে নারী বা প্রেমিকা সম্পর্কে তাঁর ভাবনা এরকম—
‘তবু যেন গ্রীষ্ম নয়, বর্ষা বা শরৎ নয়, বসন্তও নয়
আমার অস্তিত্বে এই চরাচর শুধু সেই শীতার্ত প্রান্তর—
ক্ষুধা ও তৃষ্ণার মতো অপ্রাপ্তির দুঃসহ বরফ
আদিগন্ত জমে ওঠে নিত্য যার বুকে
আর সেই সহ্যাতীত শীতে
একান্ত চাদর ছাড়া বিকল্প পোশাক নেই কোনো।’
(শীতার্ত চরাচরে/ আকুলতা শুভ্রতার জন্যে)
কাব্যচর্চার প্রথমভাগে রচিত এই কবিতার বিষয়বস্তুতে তিনি অনড় থেকেও বাঁক নিয়েছে তাঁর কবিতা। চাদরের বিকল্প কোনো পোশাক তাঁর ছিল না। এই চাদরের বিকল্প এখনো তাঁর নেই। আর এ সময়ের চাদর হলো তাঁর কাব্যে নিত্যনতুন বিষয়ে সৌন্দর্য-ভাবনা।
নাসিরের প্রেমিকসত্ত্বার আকুলতা শুধু নারী ও ভালোবাসার প্রতি নয়। তাঁর ভালোবাসা উথলে উঠে আলিঙ্গন করে নন্দতত্ত্বের চিরকালীন মেঠোপথ। নিষ্ঠুরতা তিনি পছন্দ করেন না, পছন্দ করেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এ থেকে তাঁর ত্যাগী মনোভাবের বৈশিষ্ট্যও প্রকাশিত হয়—
‘গোলাপ ছিঁড়ে নেয়া নিষ্ঠুরতা নেই
আমার এই হাতে
তবে কি শূন্যতা হৃদয়ে এতকাল? রিক্ত থাকে টব
এমন দিনে রাতে?
ফুটলে ফুল কিছু তোমরা ছিঁড়ে নিও।
আমি তো মুগ্ধতা দু’চোখে মেখে শুধু
তৃপ্ত চিরদিন দৃশ্যে, গন্ধেই
যেমন কবি তার কাব্য-লক্ষ্ণীকে সাজিয়ে মুগ্ধ সে
স্বপ্ন-গহনায়; প্রণয়ী আমরণ শব্দে-ছন্দেই।’
(ফোটাতে দাও ফুল/ আকুলতা শুভ্রতার জন্যে)
আগেই বলা হয়েছে, ‘বৃক্ষমঙ্গল’ গ্রন্থে এসে তাঁর কবিতা নতুন কাব্যভাবনায় উপনীত হয়েছে। বহুপথ হেঁটে তিনি ক্লান্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বৃক্ষছায়ায়, সমর্পণ করেছেন চিরসবুজ প্রকৃতির কাছে। এ সমর্পণ বৃক্ষসৌন্দর্যতত্ত্বের পত্তন ঘটিয়েছে—
‘বহুদূর থেকে আজ এসেছি এখানে এই জোনাক বাগানে
দীর্ঘ ধু ধু পথে সুরকি-কাঁকরে
বিক্ষত পায়ের চিহ্নে পথের দূরত্ব লেখা আছে
… … …
ঠোঁটের উষ্ণতা দাও, ক্লোরোফিলে সিক্ত করো
চুম্বনবঞ্চিত দাহ—অনল পিপাসা
দীর্ঘ অনিদ্রার জন্যে লতাগুল্মে পাতা ও পল্লবে
নিবিড় রাত্রির শয্যা বিছাও এবার।’
(বৃক্ষমঙ্গল : ১/ বৃক্ষমঙ্গল)
এই ‘দীর্ঘ অনিদ্রার জন্যে’ ‘নিবিড় রাত্রির শয্যা বিছাও এবার’-এর অভ্যন্তরে মৃত্যু কিংবা আত্মবিচ্ছিন্নতার সুর ঝংকৃত।
নাসির আহমেদ তাঁর সমগ্র কাব্যকর্মের সিঁড়িতে প্রেম-ভালোবাসার মোচড়ে মোচড়ে বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হয়েছেন। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ কখনো কখনো তীব্র হয়ে মৃত্যুচিন্তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। তাঁর এই মৃত্যুচিন্তাকে নতুন মোড়কে সাজিয়েছেন কাব্যকলার সিঁথানে।
মৃত্যুচিন্তার নবরূপায়নে তিনি একজন নিরন্তর শব্দশ্রমিক। কাব্যপ্রেম দিয়ে আত্মবিচ্ছিন্নতা কিংবা মৃত্যুচিন্তাকে সজ্জিতকরণের ব্যাপারটি অন্যান্য আলোচ্য বিষয়ের প্রথম ধাপে উঠে আসতে সময়ের ব্যাপারমাত্র।
জন্মের সঙ্গে মৃত্যুর একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। যার জন্ম আছে তার মৃত্যু আছে। এটাই প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম। আর এ রকম একটি মৌলিক বিষয়ের কাব্যপ্রিয়তা পাওয়া সহজাত। সময়ের সঙ্গে উপলব্ধির রূপবদলে কবিকূল চলমান থাকবেন—এটাই স্বাভাবিক। এ সম্পর্কে নিরন্তর প্রবাহিত বাদানুবাদের অনেক জরুরি বিষয় উত্থাপন করেন মনীষীগণ।
কোনো কবিই তাঁর সময়ের ঘটনাপ্রবাহ থেকে প্রভাবমুক্ত হতে পারেন না। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সংস্কার প্রভৃতির প্রতি কবি থাকেন সংবেদনশীল। নাসির আহমেদ সত্তর দশকের কবি। তিনি তাঁর সময়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখে মুক্তির চেতনায় যেমনি শাণিত হয়েছেন, উজ্জীবিত হয়েছেন; তেমনি উপলব্ধির আগুনে জ্বলেছেন পরবর্তী পর্যায়ের রাজনৈতিক ট্রাজেডি ও কপটতা দেখে।
পুরো সত্তর ও আশির দশকে সামাজিক অস্থিরতা ধারণ করে তিনি উপলব্ধির পর্দায় লেপন করেছেন ঋদ্ধানুভূতির রঙ। সে কারণে নাসির আহমেদ তার কবিতায় কী-এক কষ্টে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও চূড়ান্তভাবে মৃত্যুর রঙ নির্ধারণে ব্যস্ত থেকেছেন—প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি।
সমাজ-সংসারে বসতবাড়ি নির্মাণ করে শুধু আধুনিক কবিরাই এতে আক্রান্ত হননি। বাংলাকাব্যের আদিপর্বের চর্যাপদেও সমাজবিন্যাসের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট বাঙালি জীবনের আত্মবিচ্ছিন্নতাবোধের উচ্চসুর ধ্বনিত হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, মনসামঙ্গল কাব্য প্রভৃতিতে ধর্ম ও রাজনীতির প্রভাবে সমাজ জীবনের বিভিন্ন সার্থক বিষয়ের পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবোধের চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে।
এভাবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচনা-পর্যন্ত ব্যাপ্তি লাভ করেছে বিচ্ছিন্নতাবোধের অনল। আধুনিক অথচ ত্রিশপূর্ব কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—এই বিচ্ছিন্নতাবোধ কিংবা মৃত্যুচিন্তাকে নতুন মাত্রা দান করেছেন। তবে এও সত্য, উপর্যুপরি যুদ্ধ-বিগ্রহে পরাজয়ের ফলে তাঁর মানসগঠনে নিষ্ক্রিয় অবসাদ এবং বাউলতত্ত্বের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মৃত্যুচিন্তা যে রূপ পরিগ্রহ করে তাতে রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন ঋদ্ধ।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। তাঁর মতে, মানবাত্মা ব্রহ্মাত্মারই অংশ। দেহবেষ্টিত আত্মা ইহত্যাগের পর তা সীমাহীন এক পরমাত্মায় লীন হয়ে যায়। এক কথায় সীমা ও অসীমের সংযোগ সাঁকো হিসেবে মৃত্যু অনিবার্য।
‘জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম, মরণ তো নহে তোর পর
আয় তারে আলিঙ্গন কর। আয় তার হাতখানি ধর।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই কাব্যাংশের মাধ্যমে মরণভীতিকে জীবনের সঙ্গে লীন করেছেন। মৃত্যুকে জীবন ও মহাজীবনের বিকল্পহীন পথের মর্যাদা দিয়েছেন। জন্ম ও মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ সমান ভালোবাসা দিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন, জন্ম এবং মৃত্যু একে অপরের পরিপূরক।
কবি নাসির আহমেদও রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির রশ্মির আগুনে পুড়েছেন কখনো কখনো। যেমন—
‘আমার জন্ম এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে
রূপান্তর; এক নাম থেকে শত নামে।
আমি সেই অবিনাশী অদৃশ্য বাতাস
জন্ম-পুনর্জন্ম নিয়ে চলেছি অনন্ত-অসীমে,
আমার মৃত্যু নেই’
এবং
‘রক্তে নেচে উঠেছে স্বপ্নের নদী, মিটেছে অপূর্ণ সব সাধ
চৈত্রের মৃত্তিকা ফেটে উঠেছে আষাঢ়েঢেউ তীব্র কলরোল
মৃত্যুদণ্ড মেনে নিই, সাজাও ফাঁসির ফাঁসকল!’
(মৃত্যুদণ্ড/ বিধ্বস্ত শহর ছেড়ে যেতে যেতে)
এভাবে মৃত্যুদণ্ড মেনে নেননি ত্রিশের কবিরাও। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মৃত্যুকে দেখেছেন সংহাররূপে। তিনি কালিদাস কিংবা মাইকেলের কাব্যের মতো প্রিয়জনের মৃত্যুতে হতবিহ্বল চিত্র নয়, বরং অকিঞ্চিতভাবে মৃত্যুর উদার ও বিস্তীর্ণ আকাশের কাছে মৃত্যুপূর্ব অসমাপ্তিতে জরাজীর্ণ থেকেছেন। যেমন—
‘কাল রাতে
এ-সংকীর্ণ সংসারের নির্বোধ সংঘাতে
চীর্ণ, দীর্ণ হৃদয় আমার
মৃত্যুর ঘনান্ধকারে খুঁজেছিল নির্বাণ উদার
কণ্টকিত শয়নীয়ে শুয়ে।’
(মৃত্যু/ ক্রন্দসী)
কিংবা—
‘অনুমতি দাও আরও কিছুকাল থাকি
বিশাল বিশ্বে, বিস্ফারি দুই আঁখি;
ডেকো না, মরণ, এখনই সন্নিধানে’
(অসময়ে আহ্বান/ প্রাক্তনী)
কবি অমিয় চক্রবর্তীও মৃত্যুকে নিশ্চল স্তরের পরিসমাপ্তি বলে মেনে নেননি। তিনি মৃত্যুকে এক মহত্তর উপলব্ধি এবং গভীরতম অস্তিত্ব বলে স্বীকার করেন। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও মনে করেন, আত্মা অবিনশ্বর।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, আধুনিক কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া মৃত্যুকে ঠিক এমনি করে অন্য কোনো কবি দেখেননি। তিনি কবিতায় দেহের মৃত্যুর ওপর আত্মার জয় ঘোষণা করেছেন।
‘…শূন্যচারী
চলি ঐশ্বর্য জীবনে।’
(নিরবধি/ অনিঃশেষ)
অমিয় চক্রবর্তীর এ ধরনের উচ্চারণ কেবল রবীন্দ্রনাথকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
কবি নাসির আহমেদ ত্রিশের কবিদের মতো মৃত্যুকে শুধুমাত্র মহত্তর উপলব্ধি এবং গভীরতম অস্তিত্ব বলেই মেনে নিতে চান না। তিনি মৃত্যুকে কখনো কখনো দূরে ঠেলে দিয়ে পুনর্জন্মের কীর্তন করেছেন।
অন্যদিকে, কবি জীবনানন্দ দাশ কমলালেবুর অবয়বে পুনর্জন্ম আশা করেছেন।
‘একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে’
(কমলালেবু/ বনলতা সেন)
পুনর্জন্মের জন্য কেবল আর্তি নয়, নাসির আহমেদ পুনর্জন্মকে বিশ্বাসে ধারণ করেছেন—
‘কে বলে মানবজন্ম শতাব্দী-বলয়ে বন্দী? পুনর্জন্মের গান
লতিয়ে লতিয়ে ওঠে রক্তকণিকায়।
কালজয়ী সৃষ্টির রহস্যময় অমরতার দর্শনে যখন মগ্ন হই
ভোরের নির্জনতায় ওই আয়নার ভেতরে দেখি চতুর্মাত্রিক
একটি জীবন প্রবাহের ওপর দিয়ে
তাড়া খাওয়া শেয়ালের মতো পালিয়ে যাচ্ছে মৃত্যু!
মৃত্যুহীন অথবা মৃত্যুঞ্জয়ী একটি অবিকল প্রতিকৃতির
মধ্যে বেঁচে আছি আমি ও আমার শিশুকন্যা’
(অবিনাশী জীবনের গান/ বিধ্বস্ত শহর ছেড়ে যেতে যেতে)
নাসির আহমেদের মৃত্যুবিষয়ক কাব্য পাঠান্তে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তিনি তাঁর মস্তিষ্ক-নিঃসৃত মৃত্যুচিন্তা অত্যন্ত সচেতনভাবে কাব্য-শরীরে স্থাপন করেন। কখনো কখনো তিনি মৃত্যুর কাছে নিজেকে শর্তহীন সমর্পন করেছেন।
মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট থেকে যে বিচ্ছিন্নতাবোধের উৎপত্তি—সেই আগুনেও তিনি কম জ্বলেননি। যেমন—
‘রাত্রির শয্যায় কারো বাহুডোরে থেকেও যে কী ক’রে মানুষ
এমন নিঃসঙ্গ হয়! হতে পারে জনারণ্যে মরুপথচারী
জেনেছি সে অসম্ভব সত্যকেও আজ।’
(দুরারোগ্য/তোমাকেই আশালতা)
জীবনানন্দের দুঃখবোধ কখনো কখনো নাসির আহমেদকে প্রভাবিত করেছে, আলোড়িত করেছে
‘বিধ্বস্ত শহর ছেড়ে যেতে যেতে’ কাব্যগ্রন্থের ‘হাসপাতালে উল্কাঝড়ের রাতে’ কবিতায় নিয়তির অবয়বে মনে না পড়া এক বিপজ্জনক মুখকে দায়ী করে কবির অসুস্থতা বিধৃত হয়েছে।
যে মুখ কবিকে ঠেলে দিয়েছে অতল অন্ধকারে, মৃত্যুর মুখোমুখি—
‘…আমারও মায়ের মুখ মনে পড়ে যায়।
মা এখন কোন্ দূর সৌরলোকে গলন্ত নক্ষত্র! জানা নেই।
চোখ ভিজে আসে। মনে পড়ে প্রয়াত পিতার মুখও
শুধু মনে পড়লো না একবারও সেই বিপজ্জনক মুখ
যে আমাকে ঠেলে দিয়েছে এই অতল অন্ধকারে আর
শতাব্দীর শেষ সৌরঝড়ের রাতেও যে আছে গভীর
ঘুমে, কামে-ঘামে সিক্ত একাকার।’…
একদিন হয়তো কবি এই নিয়তির মুখোশ উন্মোচন করবেন কোনো এক কবিতায়।
নাসিরের আরো অনেক কবিতায়ই মৃত্যুর কথা বিভিন্নভাবে বলেছেন। মৃত্যুকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, আবার অন্যভাবে গ্রহণও করেছেন। মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতর হয়ে কাউকে দায়ী করেছেন অকপটে।
বিশেষভাবে নাসির আহমেদ বিভিন্ন বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ কবিতায় প্রেমের সুমিষ্ট ফলের বীজ ছড়িয়ে দুঃখবোধ কিংবা মৃত্যুকে নানা রঙে সাজিয়েছেন। অনেক কবিতায় মৃত্যুপূর্ব ও পরবর্তী বন্দনাতে ব্যাপ্ত থেকেও এক অপূর্ণতা তাঁর নিজের কাছেই ধরা পড়েছে।
‘ঝরাপাতার নৃত্যকলা’ কাব্যগ্রন্থের ‘অকথিত’ কবিতায় আধ্যাত্মিক রসে স্নাত হয়ে কবি নাসির আহমেদ লালন শাহকে প্রশ্ন করেছেন—
‘হায়রে লালন ভাঙলি না এই ভেদ
বুকের মাঝে কে আসে যায়?’
…………………
3 thoughts on “নাসির আহমেদের কবিতা : জীবনঘনিষ্ঠ মৃত্যুর নন্দনশিল্প”