নাসির আহমেদ-এর দশটি কবিতা
.
করোনার ছুটিশেষে
করোনাতে ইসকুল বন্ধ
ছুটি পেয়ে আহ কী আনন্দ!
দিন যায় মাস যায় ছুটিতে
ঘরে বসে ভাই-বোন দুটিতে
খুনসুটি কতো খেলা খেলেছে
চার দেয়ালেই ডানা মেলেছে।
হঠাৎ খবর এলো গতকাল
ইসকুলে ছুটি আর কতকাল!
এ মাসেই খুলে দেবে সরকার
ইসকুল- লেখাপড়া দরকার।
এই শুনে ভাই-বোন চিন্তায়
দিন তো যাবে না তাক ধিনতায়!
থেমে গেল আনন্দ- বাঁশিটি
ফুরোলো ঠোঁটের সেই হাসিটি।
মা বলেন, ওরে তোরা বোকা কি!
বিদ্যা ধরবে গাছে থোকা কি?
সুন্দর জীবনটা গড়তে
ইসকুলে যেতে হয় পড়তে।
পড়া আর খেলা দুই-ই চাই রে
না-পড়া লোকের দাম নাই রে।
নাসির আহমেদের কবিতা
এমন বিচ্ছিন্নতা কখনো দেখিনি
খাঁ খাঁ শূন্যতাই বুঝি আরাধ্য পৃথ্বির!
সব যোগাযোগ ছুঁয়ে
ভীষণ আতঙ্ক বসে আছে,
তাই সম্পর্কের রাশ টেনে
যত দূরে থাকা যায়—
সেই প্রতিযোগিতায় মেতেছে সভ্যতা।
এই দুঃসময় আগে পৃথিবী দেখেনি, এরকম সুসময়ও প্রকৃতি দেখেনি দীর্ঘকাল।
যখন আতঙ্কে ঘরে ঘরে বিচ্ছেদের সুর ; তখন পাখিরা রাজপথে
নির্ভয় বিহারে,
সুনীল আকাশে শুভ্র মেঘমালা হাসে।
এই বৈপরীত্যে আজ নিজেকে অচেনা মনে হয়
কী নির্মম বাস্তবতা
বিচ্ছিন্ন করেছে আমাদের
রক্তের বন্ধন, তবু কেউ যেন কারো নই আর
বেঁচে থাকা ছাড়া যেন কিছুই চাওয়ার নেই এই দুঃসময়ে!
সম্পর্ক নিবিড় ছিল—যেমন গাছের সঙ্গে পাতা
অথবা ফুলের সঙ্গে ফল,
আজ সব আত্মীয়তা ভুল!
সরে গেছ তুমিও তো স্পর্শাতীত দূরত্বে এখন
পিপাসা বাড়াতে শুধু ভিডিওতে ছবি হয়ে আসো।
এমন দূরত্বে আর কখনো থাকিনি কোনোদিন
চন্দ্র ও সূর্যের মতো ভয়াবহ দূরত্ব এখন আমাদের
আলোর ভেতরে যেন আলো নেই, নিষ্প্রাণ জীবন।
এ কেমন মহাশক্তি সভ্যতাকে স্তব্ধ করে দিলো!
মহাশূন্যতার দিকে যাবার আগেই বলি;
প্রভু হে হয়েছে বেশ
নিষ্ঠুর বিচার, আজ পরিত্রাণ চাই।
নাসির আহমেদের কবিতা
প্রতিটি প্রত্যাশা আজ
একদিন চেয়েছি কিছু মমতার মতো স্নিগ্ধ রোদ
সামান্য জোৎস্নার শুভ্র কুচি
চেয়েছি কিছুটা অন্তরঙ্গতার সূক্ষ্মতম বোধ
এবং কিঞ্চিৎ নতি, যেমন জুতোর দিকে মুচি।
একদিন তৃষ্ণায় খুব সামান্য প্রত্যাশা ছিল জল
চেয়েছি তৃষ্ণার্ত চোখ এবং সামান্যতম দয়ার্দ্র হৃদয়
চেয়েছি গোধূলিলগ্ন রক্তিম আভার ঝলোমল
সেদিন সামান্য কিছু দাওনি দ্বিধায়, বৃথা ভয়।
আজ সব খুলে দিচ্ছ অসীম প্রভায়
কিন্তু তৃষ্ণা মরে গেছে, মুছে গেছে রোমান্টিক বোধ
সে কি ফিরে আসে আর যে সময় যায়!
রক্তে টলে ক্লান্তি আজ, সামান্য কথায় বাড়ে ক্রোধ।
নদীর কল্লোল ছিল একদিন নৌকো ভাসাবার
আজ নদী মরাস্রোত ধু ধু বালিয়াড়ি
সেদিন সম্মতি যদি দিতে একবার
তাহলে কি হতো আজ সময়ের এত বাড়াবাড়ি!
যেখানে থাকার কথা আমরা সেখানে কেউ নেই
প্রতিটি প্রত্যাশা তাই পদে পদে হারিয়েছে খেই।
নাসির আহমেদের কবিতা
বিশ্বাসের বাঁধন ছিঁড়ে গেলে
জীবনানন্দের কথা—তবু মনে হয়, যেন এইমাত্র উচ্চারিত হলো
কোন ঋষির কণ্ঠ থেকে—নক্ষত্রেরও মরে যেতে হয়।
আমি সেই অমোঘ সত্যের মুখোমুখি আজ—মনে হয় নক্ষত্র
কেন, আরো বড় কোনো গ্রহ-উপগ্রহ তাও ম্লান ধুলায় ধূসর
উড়ে যাবে আমাদের একুশ শতকীয় এই দীর্ঘশ্বাসে।
আমাদের সূর্য সমান স্বপ্ন, সমুদ্র সমান আবেগ
কী সহজে মিথ্যে হয়ে যায়!
এই শতাব্দীর শেষ পূর্ণ সূর্যগ্রহণের কালে, আমি তো
দেখলাম মাত্র চার মিনিট ব্যবধানে কীভাবে দিন ঘুটঘুটে
রাত হয়ে যায় আর লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলে মাত্র চার মিনিটে
তারপর দিন ধীরগতি শেষে ফিরে যায় রাত্রির কাছেই।
আমার কিংবা আমাদের তো ফেরাও হয় না কোনো একান্ত
নিবিড় প্রিয় তারাভরা রাত্রির কাছে।
নক্ষত্র মানেই মনে হয় আমার মা-বাবা ভাইবোন আর প্রিয় স্বজনেরা ফুটে আছে—যারা ছিল, এই নক্ষত্রও কি দ্রুত মরে যায়, ঝরে যাবে!
এইসব ভেবে এই বর্ষণমুখর রাতে আমার আর ঘুম আসে না। বিশ্বাসের দৃঢ় বাঁধনগুলো ছিঁড়ে যেতে থাকে। শৈশব-কৈশোর থেকে ধার করে আনি কত প্রিয় সম্পর্কের মতো মধুর বিশ্বাসগুলো, অথচ থাকে না।
বৃষ্টি এসে মুছে দেয়, অশ্রুপাত মুছে দেয়, নক্ষত্রের ভরা রাতে
মায়ের রূপকথাগুলো, সন্ধ্যার জোনাকিগুলো, গন্ধরাজ ফুলগুলো—সব, সব মুছে দেয়। আমরা কি কখনো জানি আমাদের প্রত্যেকের বুকের মধ্যে এতো জমাট বাঁধা মেঘের দাপট!
নাসির আহমেদের কবিতা
বরিশাল
জীবনানন্দের বরিশাল শহরের কোমর জড়িয়ে
যে নদী চলেছে দূরপথে নীরবে কালের স্রোতে ভেসে
আমি সেই নদীতীরে চাই আমার স্বপ্নের অধিষ্ঠান
তুমি কি সম্মতি দেবে নারী—কবিতার বনলতা সেন?
বরিশাল স্বপ্ন ছুঁয়ে থাকে, বরিশাল ঘুমে জাগরণে
কীর্তনখোলার তীরে বসে
স্বপ্ন শুধু তোমাকেই ডাকে।
উত্তুরে হাওয়ায় শীত নামে ঝাউবনে শিশির ঝরিয়ে
সেইখানে গান হয়ে ওড়ে
চিলের ডানার সোনারোদ।
কীর্তনখোলার বাঁকে বাঁকে জীবনানন্দের কবিতারা
বসে থাকে আশ্চর্য রমণী!
আমার বিস্ময় শুধু জাগে
আমি কি কবিতা ভালোবেসে
না কি শুধু তোমার আগ্রহে
এই শহরের প্রেমে মজে এখানে চেয়েছি অধিষ্ঠান!
এই জিজ্ঞাসার সদুত্তর আমার নিজেরই জানা নেই
মুকুন্দ দাসের গানে মজে বিদ্রোহ পতাকা তোলে মনে?
এ শহরে কেউ একা একা রাতজেগে আমাকে কি পড়ে
জানি না কিছুই কোন মোহে
বরিশালে মগ্ন আজো মন!
বরিশাল তুমি জেগে থাকো,
ডাক দিলে কাছে টেনে নিও
নিভৃতে জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট
বলবো তুমিই ছিলে প্রিয়।
নাসির আহমেদের কবিতা
বিভ্রান্ত হৃদয়
দেখা নেই কতদিন? দিন মাস বছর নয়—যেন মহাকাল! এই অসীম
বেদনাবোধ আমার বুকের মধ্যে দাবানল টেনে আনলো হঠাৎ। চোখের পাতায় শিশির গড়ায়, ভেবে কষ্ট হয়, খুব কষ্ট। সূর্য এসে সেই
শিশির বিন্দু মূহূর্তে মুছে ফেলার নামই তো প্রখর ভালোবাসা।
আমি সূর্যের সত্যে দেখি শিশির আর ভালোবাসার আনন্দের ক্ষণস্থায়িত্বকে।
হয়তো কারও চোখের তারায় ছায়া হয়ে আছে। হয়তো নেই। হয়তো কাঁপে
তরুপ্ললব কোথাও চোখের আড়ালে স্মৃতির দমকা হাওয়ায়। অদেখার দিনে
সেই দিনগুলো কাছে টানে? মুগ্ধতার মৃত্যু নেই। মরীচিকা অভিমান হতে পারে।
হায় ভালোবাসা! কবিতার আহার্য তুমি এমন সর্বভূক কবিতার কাণ্ড
সে খেয়েছে কবির জীবন-স্বপ্ন—তুমি কি জানো না কবিতার মৃত্যু নেই! সেখানেই
তোমার অধিষ্ঠান, স্পর্শের অতীত ওই নীলিমা যেমন। তবে কেন চাইতে হয়
এমন আর একটা জীবন, তোমার সঙ্গে পরিচয় না হওয়া সেই নির্বিঘ্ন জীবন!
দেখার জন্য চাই এমন আয়না—যা দিন-মাস বছরেও কোনো দূরত্ব রচনা
করতে পারে না।সেই ভাঙা আয়না নিয়ে বসে আছো তুমি, হায় বিভ্রান্ত হৃদয়!
নাসির আহমেদের কবিতা
আষাঢ়-শ্রাবণ
ঘনকালো মেঘ জমে আসে, হঠাৎ আকাশ থমথমে যেন শোকবিহ্বল আমার মায়ের মুখ।অব্যক্ত এই মেঘ
বৃষ্টি নয়। এই ঘনকালো মেঘ আকাশের এককোণে যেন আধুনিক সানগ্লাস-পরা অহংকারী তরুণীর মুখ।
বৃষ্টিহীন মেঘ দেখে তোমার খরার মতো নির্মোহ তাচ্ছিল্য আজ খুব মনে পড়ে। এমন বিষণ্ন সন্ধ্যায় লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে ঘামতে ঘামতে চলে যাই
সেই কবেকার দূর সবুজ গ্রামের মুষলধারার বৃষ্টি ছুঁতে;
মা আমার প্রতীক্ষায় সন্ধ্যাবাতি জ্বেলে বসে থাকতেন পথ চেয়ে,
মা এখন মেঘের চেয়েও দূরবর্তী কোনো শূন্যতার নাম, আষাঢ়-শ্রাবণ আর বর্ষা সৌন্দর্য নয়, বর্ষা আজ বৃষ্টিহীনতার প্রহসন। এমন বিষণ্ন ভারি মুহূর্তের কাছে ফিরে আসে আমার শূন্যতাগুলো ভিজিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন।
অথচ আশ্চর্য তুমি নির্বিকার মেঘ! একফোঁটা বৃষ্টি নেই; একফোঁটা সত্য নেই তোমার সৌন্দর্যে সজীব শ্যামল নিসর্গের।তুমি যেন বিউটিপার্লারে বৃষ্টির মেকাপ নিয়ে বৃষ্টি সেজে বসে আছো আজ।
নাসির আহমেদের কবিতা
চৈত্রের চিঠি
চৈত্রের ধু-ধু রোদে টলমল দাহ
মরীচিকা শুধু জলের গল্প বলে
জলের আদলে রৌদ্রের কী প্রবাহ!
রৌদ্রে-জ্যোৎস্না প্রহেলিকা হয়ে জ্বলে
চৈত্রের শেষে ফুরোবে দেনার ভার
হালখাতাজুড়ে আশার শস্য বোনা
ফুরোলো চৈত্র, হালখাতা তবু তার
নতুন পাতাটি তোমাকেই খুললো না।
স্বপ্নে তোমার চৌচির মাঠজুড়ে
বৃষ্টির ধারা ঝরঝর সারারাত
বাস্তব শুধু খরায় গিয়েছে পুড়ে
দগ্ধ কৃষক তোমারই কপালে হাত।
তবু গেয়ে ওঠো বৈশাখী আবাহন
আসবে বৃষ্টি হালখাতা খোলা সন।
নাসির আহমেদের কবিতা
পতনের শেষ সিঁড়িতে
মানব তুমি তো সৃষ্টির সেরা ছিলে হে
সহ্যের শেষ সীমানা ছাড়িয়ে আজকে
অধঃপতনের শেষসিঁড়ি পার হচ্ছো
তাই তো তোমার দুর্যোগ এত চরমে!
লুটপাট আর হিংস্রতা দিয়ে পূর্ণ
করেছো তোমার লোভের সকল পাত্র
হিমালয়-সম অন্যায় অবিচারে আজ
চাপা পড়ে গেছে মানবতা আর ন্যায়বোধ।
পরাশক্তির মারণাস্ত্রের মহড়া
যুদ্ধবিমান, পরমাণু বোমা, ধ্বংসের
নষ্টকাণ্ডে মানবতা কেঁদে মরলে
কী করে সহ্য করবেন মহাস্রষ্টা!
সহ্যশক্তি হারিয়ে হয়তো আজকে
ধ্বংস-শপথ নিয়েছেন নিজে স্রষ্টা
নতুন পৃথিবী গড়বেন তিনি তবে কি!
না-হলে এমন মৃত্যুর বিভীষিকা হয়?
অনাহার আর ভোগ-লিপ্সার দ্বন্দ্বে
দুনিয়া যখন বৈপরীত্যে ধুঁকছে
তখন পৃথিবী কী করে থাকবে শান্ত
ধ্বংসের বাঁশি বাজবেই ক্রুর ছন্দে।
ধর্মের নামে হানাহানি খুন-ঝরানো
মধ্যযুগীয় রাজকীয় লাম্পট্যে
যখন অন্ধ ভোগ-
লিপ্সায় মত্ত
তখন কী করে পুরনো পৃথিবী টিকবে!
হয়তো নতুন পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে
অসহায় করে তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে
অদৃশ্য এক ভাইরাসে কত শক্তি!
তুমি তার কাছে খুবই সামান্য, তুচ্ছ।
নাসির আহমেদের কবিতা
কী আশ্চর্য তবু তুমি
দীর্ঘ অদর্শনে আমি চাপাপড়া হরিৎ ঘাসের বন আজ
সবুজ হারিয়ে দগ্ধ হলুদ বিবর্ণ রঙে উন্মুক্ত যখন
তখন ওঠেনি চাঁদ বাঁশবাগানের ফাঁকে সোনালি মুদ্রার রহস্য ছড়িয়ে, তাই বসন্ত বাতাসে কাঁদে একা আড়বাঁশি।
এখনো ফেরার বুঝি হলো না সময়! এত রুক্ষতার পর
রবীন্দ্রনাথের মতো কী করে বিশ্বাস রাখি তোমার ওপর!
যদি গান হতে, তবে হয়তো রিমিক্স পেয়ে যেতাম তোমার,
তাও তো সম্ভব নয়। প্রেম কি রিমিক্স হয়? প্রশ্নে মর্মাহত।
নিঃসঙ্গ স্বপ্নকে বলি, নিরুদ্দেশ নামহীন ফুলের স্বভাবে
নেমে যাও ঘোর ছিঁড়ে বাস্তবের রুক্ষ ধু ধু পথে জলতরঙ্গের মৃদু মুগ্ধতা ছড়ানো নীল রাতে
মেঘের আঁচল বেয়ে নেমে আসা জোৎস্না নেই আজ।
তাহলে কী করে প্রেম কবিতার মাত্রা পাবে শিল্পের দাবিতে, আলোর অধিক তীব্র কী নিবিড় অন্ধকারে ডুবেছি দু’জন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষকে আকাশ করে ভরা পূর্ণিমায়!
মনে পড়ে কবে অবগাহন করেছি? মনে না পড়াই ভালো।
নৈঃশব্দ্যের ছুরি দিয়ে জবাই করেছো কবে প্রগলভ হৃদয়
কী আশ্চর্য তবু তুমি আমার সকল দুঃখে আজো বরাভয়।
2 thoughts on “নাসির আহমেদের দশটি কবিতা”