থামছে না পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু, নেই সচেতন করার উদ্যোগও। সরকারি-বেসরকারি সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ না-থাকায় থামানো যাচ্ছে না পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু। নীরব এ মহামারীর মূলে রয়েছে সচেতনতার অভাব।
জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে।
আর উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রামকে এ দিক দিয়ে ‘সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপ্রবণ’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা-ইউনিসেফের কর্মকর্তারা।
এ জেলায় গত পাঁচ বছরে শুধু বন্যার পানিতে ডুবে ৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৫৭ জনই ছিল শিশু।
চলতি বন্যায় পানিতে ডুবে এরই মধ্যে ১৪টি শিশুসহ ১৯ জনের মৃত্যু খবর এসেছে।
পানিতে ডুবে দেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হলেও, এর প্রতিকারে সরকারি-বেসরকারি কোনো সুনির্দিষ্ট কার্যকর কর্মসূচির কথা বলতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
কুড়িগ্রাম শিশু ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহানা আক্তার পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু ঠেকাতে আলাদা করে কোনো কর্মসূচি না-থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন,
জেলায় দুস্থ মহিলা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় অন্য অনেক বিষয়ের মতো পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়েও নারী ও কিশোরীদের সচেতন করা হয়।
তবে করোনাভাইরাস সংকট শুরুর পর তাও বন্ধ রয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা এম এ বকর বলেন, তাদের কর্মকাণ্ড মূলত শহরকেন্দ্রিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বিশ্বে সবচেয়ে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু বাংলাদেশে
ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস, জন হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট, দি সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বা সিআইপিআরবি এবং
আইসিডিডিআরবি‘র এক যৌথ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৪০টি শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। জনসংখ্যার অনুপাতে এই সংখ্যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
আর দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কুড়িগ্রামে সবচেয়ে বেশি।
এ-কথা জানিয়ে ইউনিসেফের রংপুর অফিসের চাইল্ড প্রটেকশন অফিসার জেসমিন হোসাইন বলেন, আমরা আমাদের শিশুদের বাঁচার সুযোগ করে দিতে পারছি না।
পানিতে ডুবে মারা যাওয়া কমানো না-গেলে দেশে শিশু মৃত্যুর হারও কমানো যাবে না মন্তব্য করে জেসমিন বলেন,
বন্যা ছাড়াও দুই ঈদ উৎসবের সময় শিশুরা পানিতে ডুবে বেশি মারা যায় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
শিশুদের পানিতে নামার কিছু কারণ
মূলত শিশুরা পানি দেখে আবেগতাড়িত হয়ে যায়। পানিতে নামার তীব্র আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
তারা ঝুঁকির কথা না-ভেবেই আর একেবারে অবুঝ শিশুরা তো না বুঝেই পানির দিকে ছুটে যায়। এটা ন্যাচারাল। আমরা রিসার্চ করছি, রিভিউ করছি।
ইউনিসেফের এই কর্মকর্তা বলেন, যেখানে একটি শিশুও না খেয়ে মারা যায় না, সেখানে বাবা-মা খেয়াল না-রাখার কারণে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।
এ জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। পরিবার শুধু নয়, প্রতিবেশীদেরও সচেতন করতে হবে।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রামে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ইউনিসেফ কিছু কাজ করছে জানিয়ে জেসমিন বলেন, গত বছর সাঁতার শেখার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে।
কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ বছর কাজের অগ্রগতি হয়নি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এএফএডির (আফাদ) নির্বাহী পরিচালক সাইদা ইয়াসমিন অকপটেই স্বীকার করলেন, বন্যা কবলিত শিশুদের সুরক্ষায় দৃশ্যমান কোনো কাজ নেই।
শিশু মানব সম্পদ রক্ষায় জিও কিংবা এনজিও কারোই সুনির্দিষ্ট প্রকল্প, বাজেট কিংবা পরিকল্পনা নেই। সবার দৃষ্টি রিলিফ, ভাঙন প্রতিরোধ, উদ্ধার ও পরিবারের অন্যান্য সম্পদ রক্ষায়।
মৃত্যুর মিছিল দেখে এখন ফিল করছি কিছু একটা করতে হবে।
পরিবারের সবার সচেতনা ও বাড়িতে শিশুদের নিরাপত্তা জোরদার করলে অনাকাঙ্ক্ষিত এ মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব মনে করেন তিনি।
আরেক বেসরকারি সংস্থা সলিডারিটি’র নির্বাহী পরিচালক এস এম হারুন অর রশিদ লাল বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত শিশুদের রক্ষায় সত্যিকার অর্থে কোনো কাজ নেই।
কুড়িগ্রামের ডিসি রেজাউল করিমও মনে করেন, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে ব্যাপক গণসচেতনতার বিকল্প নেই।
এবারের বন্যায় এ পর্যন্ত পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুদের বেশিরভাগের বয়স পাঁচ বছরের নিচে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের সাঁতার শেখার বয়সও হয়নি।
কাজেই অভিভাবকদের সচেতনতা দরকার সবার আগে।
কুড়িগ্রামে নতুন যোগ দেওয়া এই ডিসি বলেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজ নেই।
আমরা সরকারের সব দপ্তর এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেব; যাতে আগামীতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পায়।
কয়েক বছরের তথ্য
কুড়িগ্রাম ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের বন্যায় এ জেলায় ২১ জনের মৃত্যু হয়; এর মধ্যে ১৬ জন ছিল শিশু।
২০১৮ সালে পানিতে ডুবে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া না-গেলেও, ২০১৭ সালে ৩০ জনের মৃত্যু হয়, যাদের ২০ জনই ছিল শিশু।
এর আগে ২০১৬ সালে ছয়টি শিশুসহ ৮ জন এবং ২০১৫ সালে একটি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যই জেলা প্রশাসনের এই দপ্তর প্রকাশ করে থাকে। সরকারি এ তথ্যে, বন্যায় শিশুর জীবনের ঝুঁকির বিষয়টি স্পষ্ট।
চলতি বন্যায় মৃত্যুর তথ্য
চলতি বন্যায় মৃত্যুর তথ্য দিয়ে কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, গত ২০ জুন থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত কুড়িগ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে ১৪টি শিশুসহ ১৯ জন।
ওই ১৪ শিশুর মধ্যে ছয়টি মেয়ে ও আটটি ছেলে।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য বিশ্লেষণ করলে এসব শিশুদের পানিতে ডোবার কয়েকটি কারণ উঠে আসে।
১৯ জুলাই উলিপুরে গুনাইগাছ ইউনিয়নে গুনাইগাছ পূর্বপাড়া গ্রামে লাদেন (৭) খেলতে গিয়ে সবার অগোচরে বাড়ির পাশের পুকুরে পড়ে ডুবে যায়।
চলতি বন্যায় কুড়িগ্রামে প্রথম পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ২০ জুন।
সেদিন নাগেশ্বরী উপজেলার মোল্লাপাড়া গ্রামে আরাফাত আলী (৭) বাড়ির পাশের ডোবায় ডুবে মারা যায়। সেও খেলতে গিয়েছিল।
এ ছাড়া বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে সবার অগোচরে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায় কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসা ইউনিয়নের কথা রায় (২),
চিলমারী উপজেলার থানাহাট ইউনিয়নের বজরা তবকপুর গ্রামের সুচরিতা (২) এবং নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লবেরখাস ইউনিয়নের ব্রক্ষতর গ্রামের লামিয়া খাতুন (২)।
পরিবারের লোকজনের অগোচরে বাড়ির উঠানের পানিতে পড়ে মারা যায় উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চিড়া খাওয়া গ্রামের মুন্নি (১৮ মাস),
নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের চৌদ্দঘুরি গ্রামের মাহিন (১৭ মাস), উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের জানজাইগীর গ্রামের মুক্তাসিন (১৪ মাস)।
কৌতুহলবশত বন্যার পানি দেখতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায় চিলমারী উপজেলার বড়াইমারি চর গ্রামের শান্ত মিয়া (১০), কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানার জাহিদ (১২),
নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লবেরখাস গ্রামের কেয়া আক্তার মীম (১০) এবং উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের চর বাগুয়া গ্রামের বায়েজিদ (৮)।
বন্যার পানিতে গোসল করতে গিয়ে ডুবে মারা যায় নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়নপুরের মোল্লাপাড়া গ্রামের আমির আলী মোল্লার ছেলে বেলাল হোসেন (৫)।
আর শখের বশে মাছ ধরতে গিয়ে মারা যায় চিলমারী উপজেলার সবুজপাড়া গ্রামের রাকু (১৫)।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু : জনসচেতনতার মাধ্যমে থামানো সম্ভব
পানিতে ডুবে এ ১৪ শিশুর মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জেলার সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, শুধুমাত্র জনসচেতনতার মাধ্যমে এ মৃত্যুর মিছিল থামানো সম্ভব।
তিনি জানান, স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সব চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ের সব কর্মী যাতে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি শিশুদের সতর্ক রাখতে অভিভাবকদের সতর্ক করেন, সে পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।
তবে শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ প্রচার চালালে চলবে না। জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, জনপ্রতিনিধিসহ সব পক্ষকে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে সচেতনতার কাজটি করতে হবে।
সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করলে ‘ভালো ফল’ পাওয়া যেতে পারে বলে আশা এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার।
ঠাকুরগাঁওয়ে বন্যার পানিতে নেমে ২ শিশুর মৃত্যু
ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলায় বন্যার পানিতে নেমে দুই শিশু মারা গেছে।
আজ বুধবার (২২ জুলাই ২০২০ বিকালে ধর্মগড় ইউনিয়নের ভরনিয়া আনসারডাঙ্গী গ্রামে একটি কালভার্টের নিচে শিশু দুটির লাশ পাওয়া যায় বলে জানান রাণীশংকৈল থানার ওসি আব্দুল মান্নান।
এরা হলো ভরনিয়া আনসারডাঙ্গী গ্রামের আনারুল হকের ছেলে রুবেল মিয়া (১২) ও একই গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে রাজেল মিয়া (১০)।
রুবেল ভরনিয়া ফুঁলকুড়ি কিন্ডারগার্টেনের ছাত্র, রাজেল এখনো বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি।
ওসি আব্দুল মান্নান জানান, ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদী, পুকুরসহ গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন খাল-বিল পানিতে ডুবে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে ওসি বলেন, দুপুর ১টার দিকে রুবেল, রাজেলসহ সাত শিশু গ্রামের একটি কালভার্টের নিচে গোসল করতে নামে। এক পর্যায়ে রুবেল ও রাজেল গভীর পানিতে তলিয়ে যায়।
তাদের সঙ্গে থাকা অন্য শিশুদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে তাদের খুঁজে পায়নি।
পরে রাণীশংকৈল ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে কালভার্টের নিচ থেকে রুবেল ও রাজেলের লাশ উদ্ধার করে।
বন্যার পানিতে তলিয়ে নিহত দুই শিশুর লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে ওসি জানান।
—আহসান হাবীব নীলু, কুড়িগ্রাম
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা
করোনায় আরো ১৭৮ জনের মৃত্যু
টানা ২০ দিন পর দৈনিক মৃত্যু দুইশ’র নিচে ১৯৭ জন
করোনায় আরো ২১৫ জনের মৃত্যু