খুচরো কথা চারপাশে
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে
সুনীল শর্মাচার্য
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে
ভাবছিলাম—জাত, ধর্ম, অর্থ, প্রতিপত্তি, বংশমর্যাদা ইত্যাদির বৈষম্য চিরকালই দুটি কোমল হৃদয়ের একাত্ম হওয়ার অন্তরায়। আদিম থেকে আধুনিক যুগের পরিবর্তনে বদলায়নি অভিভাবকত্ব, সাবালক সন্তানদের হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে তাদের নিয়ন্ত্রণ।
রোমিও বর্তমান ঘটনা প্রবাহ একই স্রোতে বইছে! সেই স্রোতের মুখে কত ভালোবাসার স্বপ্ন যে তলিয়ে গেছে, কে তার খবর রাখে! তারই মধ্যে সেলিম-আনারকলি, রোমিও-জুলিয়েট, লায়লা-মজনু ইত্যাদি চরিত্রগুলো অপূর্ণ প্রেমের ইতিহাসে যেন শুধুই দৃষ্টান্ত।
তবে বর্তমানে মিডিয়ার দৌলতে এই ধরনের প্রেমের অপরাধে প্রাণদণ্ডের অমানবিক ঘটনা ‘অনার কিলিং’ শিরোনামে প্রকাশ্যে আসছে। উত্তর ভারতে ঘুরতে গিয়ে এই পরিভাষাটির সঙ্গে আমার পরিচয়।
কারণ একদিকে সমাজের উচ্চ থেকে নিম্ন সকল স্তরেই এমন বর্বরতা বিরল তো নয়ই, বরং ক্ষেত্র বা ব্যক্তি বিশেষে পুলিশ ও গ্রাম পঞ্চায়েত অর্থাৎ প্রশাসন দুনিয়ার অপর সকল অরাজকতাকে তুচ্ছ জ্ঞানে অবজ্ঞা করে হঠাৎ সমাজ সংস্কারের কর্তব্যে ব্রতী হয়ে ওঠে।
সাবালক প্রেমিক-প্রেমিকাকে হাত কড়া পড়িয়ে অভিভাবকের হাতে তুলে দেয় নিধনের উদ্দেশ্যে। জনসমক্ষে সেই প্রেমকে সমাধিস্থ করে অভিভাবক সগর্বে প্রমাণ করেন, সন্তানের চেয়েও বংশ-মর্যাদা বা অর্থের অহঙ্কার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রায়শই এহেন ‘অনার কিলিং’-এর খবরে অধুনা বাজার চলতি ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ নামক ভূতটি আমার ঘাড়ে ভর করল। বিদেশ-বিভুঁইয়ের পরোয়া না-করে অনুসন্ধানে মত্ত হলাম। অনুসন্ধানে জানতে পারলাম—শহরে অর্থ, বংশ, সামাজিক প্রতিপত্তি প্রভৃতির বৈষম্যের কারণে যুবক-যুবতীর প্রেম দণ্ডণীয় অপরাধ বলে গণ্য হলেও, গ্রামের ব্যাপারটা একটু আলাদা।
হরিয়ানায় সামাজিক রীতি অনুসারে একই গ্রামে বসবাসকারী ছেলে-মেয়ের বৈবাহিক সম্পর্ক মেনে নেওয়া হয় না। স্থানীয় মানুষের মতে, শিশুকাল থেকে গ্রামের মধ্যে পাশাপাশি ঘর-উঠোনে বেড়ে ওঠা তো ভাই-বোনেরই মতো। নাই-বা হলো রক্তের সম্পর্ক।
সেখানে পরস্পরের প্রতি প্রণয়ের অনুভূতি অনুচিত, অবৈধ এবং সামাজিক অপরাধ, যার শাস্তি প্রাণদণ্ড! এই তথ্য সংগ্রহের পর আরো অনুসন্ধান করলাম। অনুসন্ধানে আমার বন্ধু দিবাকর রায় (যে দীর্ঘদিন কর্মসূত্রে এখানে আছেন) আমার সঙ্গে থেকে সাহায্য করল।
আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, পাড়ায় পাড়ায় দাদাদের বয়ঃসন্ধিতে রোমিও হয়ে ওঠায় কোনো বাধা নেই। পাশাপাশি বাড়ির কিশোর-কিশোরী শুধুমাত্র দৃষ্টির মাধ্যমেই অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে যায়। একই বাড়ির একতলা-দোতলায় ছেলে-মেয়ে সিঁড়িতে প্রেমপত্র বিনিময় করে।
তরুণ শিক্ষকের ছাত্রী নির্বিঘ্নে পাত্রী হয়ে যায়। এ তো জলভাত। এমনকি, আমার পরিচিত এক পরিবারে তো মাসতুতো-পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে প্রেম ও পরিণয় যেন পরিবারটির ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, অর্থাৎ ঘটেই চলেছে।
তাই লঘু পাপে গুরু দণ্ড হলেও, অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষগুলোর মধ্যে সুস্থ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের এই প্রয়াস আমায় নাড়া দিলো। ভাবতে বাধ্য করল, গ্রাম্যরীতি অমার্জিত হতে পারে, কিন্তু অশুভ নয়।
প্রতিবেশী ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিবাহ অবৈধ নয়। অথচ সামাজিক, আইনি এবং সর্বোপরি চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিক থেকেও একই পরিবারের ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিবাহ শুধু অনুচিত নয়, অবৈধ জেনেও আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে এই ধরনের ঘটনা কখনো গোপনে, কখনো সোচ্চারে, বিক্ষিপ্তভাবে হলেও ঘটছে।
তারা পরিবারে ও সমাজে দম্পতি হিসাবে স্বীকৃতিও পাচ্ছে। এতে সমাজ কলুষিত হলেও, সভ্যতার নিরিখে অন্তত অপরাধ বলে চিহ্নিত হচ্ছে না। একে কী বলা যায়—উদার মানসিকতা, না বোধহীন মানসিকতা?
অথবা শিক্ষার মোড়কে সমাজকে অগ্রাহ্য করার ঔদ্ধত্য—না আধুনিকতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা? নাকি রাবীন্দ্রিক ধারায় অনুপ্রাণিত আমাদের মন এভাবেই বিশ্বাস করে—‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে!’
অথচ অত্যন্ত আধুনিকমনস্ক হয়েও, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কোনো সীমা লঙ্ঘন করেননি। সমাজের প্রতি তাঁর দায়িত্ব অক্ষুণ্ন ছিল। তা না হলে ‘নষ্টনীড়’-এর পরিণতিটা অন্যরকম হতো।
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প: সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হাল্কা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
রাজনীতি বোঝো, অর্থনীতি বোঝো! বনাম ভারতের যুবসমাজ
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
ভারতের CAA NRC নিয়ে দু’চার কথা
13 thoughts on “প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে”