shubhobangladesh

সত্য-সুন্দর সুখ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবসময়…

বাংলা

Bangla; Golpo; Abhijit Chaudhuri

Bangla; Golpo; Abhijit Chaudhuri

Bangla; Golpo; Abhijit Chaudhuri

বাংলা

অভিজিৎ চৌধুরী

‘বাংলাদেশ’ তখনো নাম হয়নি। সবাই বলতো—পূর্ব পাকিস্তান। মেজ পিসি চিঠিতে লিখতো—এবার শঙ্খ নদীতে বান এসেছে। ঘর-দোর সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আবার মেজ পিসি কয়েক মাস পরেই লিখতো—আমরা ভালো আছি, ‘মা’।

আমার কাজ ছিল ঠাকুরমাকে পিসির চিঠি পড়ে শোনানো। চিঠির অন্তঃস্থলে কিছু থাকলেও, আমাকে স্পর্শ করতো না। আমি অনেক অংশ বাদ দিয়ে পড়ে গেলে—ঠাকুরমা টের পেয়ে যেতো। অন্য কাউকে দিয়ে চিঠিটা পড়াতো।

কখনো কখনো শুনতাম পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষাটাই থাকবে না। সবাইকে উর্দু ভাষায় লিখতে, পড়তে হবে।

বাবাকেও অবশ্য হিন্দি আদ্য, মধ্য পরীক্ষা দিতে হয়েছে—সরকারি চাকরি রক্ষা করতে, যদিও বাবা মনে-প্রাণে হিন্দি ভাষাকে ঘৃণাই করত মনে হয়।

‘হিন্দি’ ভাষা হিসেবে ক্লাস এইট অবধি আমরাও পড়েছিলাম। বিস্তর নম্বর পাওয়া যায়। আর বিচিত্র সব শব্দকে স্ত্রী-লিঙ্গ হিসেবে ধরা হয় ।

উর্দু দূর থেকে দেখেছি। উল্টো করে লেখা শুরু। ‘শায়েরি’ পড়লে বেশ লাগে ।

আমাদের ঘরে যে বাংলা ভাষাটা বলা হতো, সেটা কিন্তু একেবারে ওপার বাংলার। বাবা জলকে সব সময় ‘পানি’ বলতো। কাককে ‘কাওয়া’ আর পায়রাকে ‘কবুতর’।

ঠাকুরমা মারা যাওয়ার পর পরই পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার ডাক দেয়া হলো। শুরু হলো ভয়ঙ্কর যুদ্ধ।

মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল। প্রচুর মানুষ আমাদের পাড়াটায় এলেন। ছিন্ন-বস্ত্র, চোখের তলায় গভীর কালো দাগ।

ওঁরা নাকি সব বর্ডার পার করে এসেছেন। যুবক যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শুনতাম।

এভাবে কোনো এক শীতের সকালে রোদ্দুরে ‘ওম’ নিতে নিতে জানা গেল—স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ।

আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। এক লহমায় পাড়াটা খালি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। অনেকেই চলে গেল।

রয়ে গেল বাবলু-দা।

অতো যে যুদ্ধ হচ্ছে, ছিন্নমূল মানুষদের লাঞ্ছনাও তো কম হয়নি; কিন্তু তার মধ্যেও তো বিয়ে হলো মেজ-মামার। সানাই বাজল, নতুন বউয়ের শাড়ির গন্ধে মাতাল হলো হাওয়া।

তবে ওঁদের আটকানো গেল না—নতুন বাংলাদেশে ওঁরা চলে গেলেন, আর বাবলু-দা এখানকার বাংলা গানের প্রেমে আটকে গেলেন।

মন দিলে না বঁধূ…

শচীন কর্তার গান চমৎকার নাকি সুরে গাইতেন। সেই গানের প্রেমে পড়ে গেল—এপার বাংলার প্রিয়াংকা মহসিন।

বাড়ি থেকে পালিয়ে ওরা বিয়ে করল।

বিয়েতে ঘটা কিছু করতে পারল না, কিন্তু আমরা নিমন্ত্রণ খেতে গেলাম। খুব অল্প কয়েকজন। পিঁড়িতে বসে কাঁসার থালায় খেলাম। ভাত, মাংস আর রসগোল্লা।

বদলে যাচ্ছিল দিন। ক্রমশ এই বাংলায় আমরা টের পেলাম—দেশি সাহেবদের দাপটে বাংলা ভাষাটাই হারিয়ে যাচ্ছে।

ব্যাঙের ছাতার মতন ইংলিশ মিডিয়ম স্কুল গজিয়ে উঠতে থাকল। তখন আমি বেকার বলে ওসব স্কুলের ছেলে-মেয়েদেরও পড়াতাম ।

ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ভাষা নিয়ে কেউ পড়লে নতমুখে থাকে। আলোর বদলে যাবতীয় অন্ধকার তাদের ঘিরে ধরে।

শুধু একদিনই এখানেও আলো জ্বলে বাংলা ভাষার, আর সেই দিনটার নাম একুশে ফেব্রুয়ারি।

যক্ষ্মায় মারা গেল বাবলু-দা। হঠাৎ-ই। হয়তো রোগটা ভিতরে ছিলই, আড়াল করে রেখেছিল।

বাবলু-দার মৃত্যুর পর প্রিয়াংকা মহসিন ইংল্যান্ডে চলে গেলেন। আর যোগাযোগ ছিল না।

বাংলা : অভিজিৎ চৌধুরী

বেশ কয়েক বছর পর আমি একটা সরকারি প্রশিক্ষণে ইংল্যান্ডে গেছি।

লন্ডন শহরটাকে অনেকটা কলকাতার মতনই মনে হয়। গোথিক স্ট্রাকচারের সব বাড়ি।

একদিন ইনস্টিউটের অধিকর্তাকে বললাম, ইংল্যান্ডের গ্রামগুলি দেখলে হয় না।

তিনি বললেন, সম্পন্ন গ্রাম দেখবেন। ওখানে খামারবাড়ির মালিকেরা ঘোড়ায় চড়ে যাতাযাত  করেন।

আমি বলে বসলাম, বাংলা ভাষার কোনো স্কুল এখানে আছে!

বলে একটু সংকোচ হলো ।

আমাদের ইনস্টিউটের অধিকর্তা স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন।

তিনি বললেন, আমার বিবি এখানে একটি বাংলা গানের স্কুল চালান। রবীন্দ্র-সংগীত, নজরুল-গীতি, আধুনিক বাংলা গান শেখানো হয়। যাবেন?

আমি বললাম, নিশ্চয় যাবো ।

শীতের সকালে লন্ডনে বরফ কামড় তো স্বাভাবিক। সঙ্গে ছিল কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। ক্যাবে উঠতেই ঠাণ্ডা যেন কামড় বসাতে থাকল ।

অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই রোদ উঠল। গম ফলেছে মাঠজুড়ে। মেপল গাছ বরফে ঢাকা, কিন্তু রোদ পড়তেই ঝলমল করে উঠল ।

একটা সুন্দর স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। লাল-সাদা পাথরের উঠোন ।

রবীন্দ্র-সংগীত গাইছিলেন একজন প্রবীণা।

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা…

বিদেশে বাংলা গান শুনে মনটা ভিজে উঠল।

আমার ইনস্টিউটের অধিকর্তাটি অত্যন্ত তরুণ।

তিনি বললেন, আপনাদের পশ্চিম বাংলার ভাষায় বোধহয় শাশুড়ি বলে। তিনি গাইছেন।

এবার তিনি ওঁর কাছে নিয়ে গেলেন ।

বললেন, আম্মা, ইনি ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন। বাংলা ভাষার স্কুল খুঁজছিলেন।

প্রবীণা স্মিত হাসলেন। তিনি যেন আমার অনেক অনেক দিনের চেনা—লন্ডনের টেমস নদীকে ছাপিয়ে, সাত সমুদ্র তেরো নদীকে ছাপিয়ে—তাঁর সেই চিরচেনা মুখমণ্ডলে অপূর্ব, অনির্বচনীয় এক আলো নিয়ে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে—একটি ভাষা। তার নাম ‘বাংলা’।

About The Author

শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে থাকুন...