ভারতীয় বাঙালি ও ভাষাদিবস
সুনীল শর্মাচার্য
ভারতীয় বাঙালি ও ভাষাদিবস
‘জানেন দাদা বাংলাটা ঠিক আসে না’—বলে গর্ব অনুভব করা ভারতীয় সেইসব বঙ্গ-সন্তানেরা, যারা বাচ্চাদের না-রাখেন—ভিকি, গুঞ্জা, ডোনা, আঞ্জেল, লিটন, যারা ‘আর্লি টু রাইজ, আর্লি টু বেড’ রাইম মুখস্ত করে বড় হয়ে, বেলা দশটায় ঘুম থেকে উঠে, কলঘরে গিয়ে দাঁত না-মেজে—ওয়াশরুমে টুথব্রাশ করে, পায়খানার বদলে পটি করে, দাড়ি না-কেটে সেভ করে, শাওয়ার বাথ সেরে বেডরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে, ডাইনিং টেবিলে গিয়ে জলখাবারের বদলে ব্রেকফাস্ট করে দিন শুরু করে—সেই বাঙালির বাচ্চারা, স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক, একাল সেঁড়ে হয়ে ‘মানুষ’ হচ্ছে।
—সরি! ভুল বললাম—অসামাজিক, অমানবিক, আত্মসর্বস্ব, বদমেজাজি স্বার্থপর হয়ে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বেড়ে উঠছে। এদের তিন কুলে সবাই থেকেও, কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই—দাদা, দিদি, পিসি, মাসী, কাকিমা, জেঠিমা, মামীমা থাকলেও, কে কার খবর রাখে!
অবশ্য ভাইয়া, বুয়া, আঙ্কল, আন্টি, মম, মামা, মাম্মি, ড্যাড, ড্যাডি আছে। হাজার কয়েক ফেসবুক ফ্রেণ্ড আছে, তারো বেশি ফ্যান-ফলোয়ার, হোয়াটসয়্যাপ চ্যাট করার বন্ধু আছে। আর বাড়িতে আছে—টম, জিমি, রকি নামের নেড়ি থেকে স্পিজ জাতের পোষ্যরা—যারা কাম, গো, সিট ডাউন কম্যান্ড বোঝে—বাংলাটা বোঝে না।
যাদের যৌবনে ব্রণ হয় না, পিম্পলস হয়, যারা পিৎজা, পাস্তা, কোক কালচারে অভ্যস্ত—সেই
থাই ছেঁড়া জিনস পড়া বঙ্গ সন্তানসন্ততিরা ক্যালেন্ডারে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটা এলেই,
‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো…’ গান গেয়ে বাংলা ভাষার জন্য কেঁদে অস্থির হয়ে একাডেমি
চত্বরের সামনে মিছিল করতে ছুটে যায়, রাত জেগে শুঁটকি মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খায়।
‘আ মরি বাংলা ভাষা’ কবিতাটা কে যেন লিখেছে? এখন মনে পড়ছে না, একুশে ফেব্রুয়ারির আগে গুগলে সার্চ করে দেখে নেবে। একুশের মিছিলে ভিড়ের মধ্যে গলা মেলাবে,
বলবে—‘আমি বাংলায় কথা বলি, বাংলায় গান গাই।’
কিন্তু বলবে না এই একটা দিনের জন্যই আমাদের এত বাংলা ভাষা প্রীতি, এই একটা
দিনের জন্যই বাংলা ভাষাকে নিয়ে আমাদের এত মড়াকান্না! এই একটা দিনের জন্য বাংলা
ভাষার জন্য কেঁদে কেঁদে ক্যামেরার সামনে ফটোসেসন করা।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ বলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে, মিছিল করবে, শহীদ বেদীতে মালা দেবে। বাকি ৩৬৪ দিন এদের বাংলাটা ঠিক আসে না, আসবে না!
বাংলা ভাষার জন্য এদের অবজ্ঞা অশ্রদ্ধা অনীহা সর্বজনবিদিত! এরাই পশ্চিমবঙ্গের আজকের বাঙালি প্রজন্ম! তথা ভারতীয় বাঙালি!!
এরা দক্ষিণারঞ্জনের ঠাকুরমার ঝুলি পড়েনি। জীবনানন্দ, হরপ্রসাদ, কবিকঙ্কন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ, হেম-মধু-বঙ্কিম-নবীনদের এরা ভুলে গেছে। এই মনীষীদের একটা রচনার নামও এরা উচ্চারণ করতে পারবে না!
ভারতীয় বাঙালি ও ভাষাদিবস
এই প্রজন্মের দুই শিক্ষার্থীর কথোপকথন শুনুন :
—কেন যে বেঙ্গলি সাবজেক্টেটা আছে। বোগাস। আবার তার এগজাম! মাই ফুট।
—ছোটবেলায় জানলে কিছুতেই মাম্মিকে এই সাবজেক্টটা অপ্ট করতেই দিতাম না।
বাংলা ভাষায় কিছু ইংরেজি হিন্দি খিস্তি মেশানো শব্দ নিয়ে এ-প্রজন্ম বিন্দাস আছে।
এফ এম রেডিও’র অনুষ্ঠান পরিচালক—সরি! রেডিও জকি, কি অদ্ভুত বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান করে। দু’ঘণ্টার অনুষ্ঠানে এক লাইনও বাংলা বাক্য থাকে না!!
কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে এলেই এদের বাংলা ভাষার কথা মনে পড়ে। এরা ভাষা শহীদ রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার ইত্যাদি কটা নাম নাকি ভুলতে পারে না।
রাজনীতি ব্যবসায়ী নেতামন্ত্রীরা, এফ এম রেডিও থেকে খবরের কাগজের মধ্যে কম্পিটিশন চলে কে কতটা একুশে ফেব্রুয়ারি প্রেমিক তার প্রমাণ দিতে।
সব শিয়ালের এক রা—আমি কি ভুলিতে পারি!!? কিঁউ কি এটা দিয়ে তো পাবলিক টানা যাবে!
ভারতীয় বাঙালি ও ভাষাদিবস
২
১৯৬১ সালের ১৯ মে স্বাধীন ভারতে আসামের বরাক উপত্যকায় শিলচরে বাংলা ভাষার সম্মান বজায় রাখতে অহিংস ভাষা সত্যাগ্রহীদের ওপর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর গৌহাটিতে উপস্থিতিতে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহার নির্দেশে আসাম রাইফেলস গুলি চালিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে ভাষা সত্যাগ্রহী ১৩ জন বাঙালিকে খুন করেছিল—এ তথ্য আজ কারো মনে রাখার প্রয়োজন নেই।
এই অহিংস বাংলা ভাষা সত্যাগ্রহীদের খুন করার উদ্দেশ্যে মাথায়, বুকে চোখে গুলি করা হয়েছিল। এই ভাষা আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ নারী শহীদ ১৪ বছরের কমলা ভট্টাচার্যের চোখে গুলি করা হয়েছিল।
এদের কথা কেউ মনে রাখে না। এই ভাষা শহীদদের নিয়ে সামান্যই আলোচনা হয়। শুধু ঋষিন মিত্র একা দীর্ঘদিন শিলচরের এই ভাষা শহীদদের স্মরণ করে গেছেন!
যাই হোক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে একুশে ফেব্রুয়ারি, লেট আস সেলিব্রেট। বাকি ৩৬৪ দিন পশ্চিমবঙ্গে কিংবা ভারতের যেখানে যেখানে বাঙালি আছেন, সেখানে বাংলা ভাষা কোথায়? ভাবতে লজ্জা লাগে!!
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
নিহিত মর্মকথা : সুনীল শর্মাচার্য
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প: সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মতামত
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হাল্কা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
রাজনীতি বোঝো, অর্থনীতি বোঝো! বনাম ভারতের যুবসমাজ
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
ভারতের CAA NRC নিয়ে দু’চার কথা
ভারতের এবারের বাজেট আসলে অশ্বডিম্ব, না ঘরকা না ঘাটকা, শুধু কর্পোরেট কা
ইন্ডিয়া ইউনাইটেড বনাম সেলিব্রিটিদের শানে-নজুল
10 thoughts on “ভারতীয় বাঙালি ও ভাষাদিবস”