খুচরো কথা চারপাশে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হালকা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
সুনীল শর্মাচার্য
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট
ভক্তরা যেভাবে লম্ফঝম্ফ করে চীনা দ্রব্য বয়কট, সাথে সাথে এমন ভাব করলেন : এখন চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবেন! আমি বিশ্বাসী : ভারত সৈনিক নিধনের প্রতিশোধ নিক। সত্যি সত্যি ভারত আত্মনির্ভর হয়ে উঠুক; সমস্ত বিদেশিপণ্য ব্যবহারে বয়কট হোক।
বিষয়টা এতো হালকা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন। চীন নিয়ে ভেবে, রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। কারণ পরিস্থিতি, বাস্তবতা এই করোনাকালে সত্যিই কঠিন। যুদ্ধও। কোনো দেশই সত্যিকারের যুদ্ধ চাইবে না। অর্থনীতি, বৈদেশিক অবস্থান জটিল।
তাই ভক্তদের বলি, ভারত-চীন যুদ্ধও হবে না। চীনা Product বয়কটও হবে না। এই সহজ সত্যিটা মাথায় ঢুকিয়ে নিন। কারণটা সহজ। অর্থনীতি। ওষুধ থেকে মুখে মাস্ক, পিপিই, মোবাইল থেকে ল্যাপটপ, মেট্রোর রেক থেকে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, হাজার হাজার জিনিসের কাঁচামাল বা finished প্রোডাক্ট সব চীন থেকে আসে। এমন-কি আপনি যে অনবরত হাতে সানিটাইজার দিচ্ছেন, তার raw chemical পর্যন্ত।
আমরা যে কথায় কথায় পেটিএম করি, সেখান থেকে বাড়ি বসে খাবারের অর্ডার দেওয়ার কোম্পানি Zumato, সর্বত্র চীনা লগ্নি। বাড়ির টর্চ থেকে ঘুড়ির মাঞ্জা, দেওয়ালির আলো থেকে ঘরের ড্রইং রুমের লাফিং বুদ্ধ, সব চীনা মাল।
ওরাও জানে, আমাদের দেশের জন্য জিনিস তৈরি করে ওদের কোটি কোটি গরিব শ্রমিকের পেট চলে। কারণ বহু শ্রমিক কাজের বিনিময়ে শুধু দু-মুঠো খেতে পায়। টাকা পায় না বা পেলেও যৎসামান্য।
তাই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বা ওদের সেনাবাহিনী PLA তারাও ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। আমরা সস্তায় চীনা মাল কিনে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করি। এভাবেই ট্রেডিং করে দেশের কোটি কোটি মানুষের পেট চলে। আর এই সব অর্ডার দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের কোটি কোটি টাকা কাটমানি দেয় চীনের ব্যবসায়ীরা।
চীনের ব্যবসায়ীদের হাতে এখন অনেক অনেক টাকা। তাই চীনের ব্যাংককে ভারতে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে RBI। আচ্ছা বলুন তো, অনিল আম্বানি যে কোটি কোটি টাকা বিদেশি ঋণ পেয়েছিল—যা শোধ করতে পারেনি, তা কোথাকার? চীনের।
শুধু ব্যবসা নয়। এখন পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলেমেয়েরা ওখানে এমবিএ, ডাক্তারিও পড়তে যাচ্ছে। আসলে কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্রী দেশটায় অনেকদিন ধরেই capitalism-এর চাষ হচ্ছে। সেই চাষে ওরা ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি তো বটেই আমেরিকাকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। না-হলে পৃথিবীর অন্যতম ধনী আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য তথা নেতা হয়!
স্পষ্ট করে শুনে রাখুন, আপনি যতই চিৎকার করুন, চীনের বিরুদ্ধে মোদি, সোনিয়া, মমতা, বিমান বা বিজয়ন কারো কিছু করার নেই। কেউ কিছুই করতে পারবেন না। হাত-পা এমন বাঁধা।
মোদ্দাকথা, এটা irreversible process। অন্তত ১০ বছরের মধ্যে উল্টো দিকে যাওয়া সম্ভব নয়। বরং সীমান্তে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব থাকলে মানুষের মন করোনার অতিমারী আর তীব্র বেকারি, অর্থ সঙ্কট থেকে ওই দিকেই যাবে।
মিডিয়াও সারাদিন ওই খবরই দেখাবে। তাই ২০ জন শহীদ জওয়ানের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েও বলছি, লাদাখ সীমান্তে কী হচ্ছে—তা নিয়ে আপনার বেশি ভাববার দরকার নেই।
নিজের কথা ভাবুন। পরিবার বা পাড়ার কথা ভাবুন। কী করে করোনার হাত থেকে বাঁচবেন, আমফানে বিধ্বস্ত দক্ষিণবঙ্গের মানুষদের পাশে কি করে দাঁড়ানো যায়, তাই নিয়ে ভাবুন।
পাড়ায় পাড়ায় কি গাছ লাগাবেন, তাই নিয়ে ভাবুন। পাড়ার পুকুরগুলোকে পরিষ্কার প্লাটিক-মুক্ত রাখুন। পারলে সুন্দরবনে গিয়ে ম্যানগ্রোভ লাগিয়ে আসুন। তাতেই মঙ্গল। আমার, আপনার, সবার।
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প: সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হালকা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
13 thoughts on “ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট”