
খুচরো কথা চারপাশে
মিসেস আইয়ার
সুনীল শর্মাচার্য
মিসেস আইয়ার
একদা কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত অপর্ণা সেনের ছবি ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ সামনে রেখে তর্ক জমলো—অপর্ণার ছবিতে সেই অর্থে গ্রেট ছবি বলা যায় কি না! ব্রাজিলীয় ছবি ‘নিৎসে ইন তুরিন’-এর নির্বাক দার্শনিক অভিব্যক্তির সঙ্গে অপর্ণার ছবির কোনো তুলনা চলে কিনা কিংবা মার্কো বেচিসের ছবির ইমাজিনেশন-প্যাশনের সঙ্গে এর তুলনা হয় কিনা, এ-সব প্রসঙ্গ সরিয়ে তর্ক গড়াল অন্যদিকে—এ ছবির ঘটনা কি আদৌ বাস্তব?
সময়টা ছিল সত্তর দশক। আর সেই দশকটাকে ‘মুক্তির দশকে’ বদলে দেওয়ার স্বপ্ন সেদিনকার অনেক যুবক-যুবতীর মতো ছুঁয়ে দিয়েছিল আমার এক মামাকেও। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া আমার সেই মেধাবী মামার খুব কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল ওই কলেজেরই সহপাঠী রিয়াজ।
গ্রাম থেকে আসা রিয়াজের নিত্য আসা-যাওয়া ছিল আমার ভাটপাড়া মামার বাড়িতে। এক সময় রিয়াজ আমার মামার সঙ্গে বৈঠকখানা ঘরে থাকতেও শুরু করে। ইতোমধ্যেই পুলিশের নজর পড়েছে রিয়াজের ওপর।
আমার দিদা (মায়ের মা) রিয়াজের এই থাকা একেবারেই মানতে পারেননি। মহিলা বিধবা হন ৩০ বছর বয়সে। কুলীন ব্রাহ্মণ বংশে বিধবা নারীর পক্ষে মুসলিম রিয়াজের বাড়িতে অনুপ্রবেশ মেনে নেওয়াটা কিছুতেই সম্ভব ছিল না।
তবু তাঁর অনিচ্ছাকে উপেক্ষা করেই বাইরের বৈঠকখানা ঘরে রিয়াজের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল আমার মামার সঙ্গে। এরই মধ্যে একদিন আমার মামার বাড়ি ঘিরে ফেলল পুলিশ। তাদের দাবি, রিয়াজকে তুলে দিতে হবে তাদের হাতে।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আমার মামা জানায় যে, রিয়াজ বাড়িতে নেই। স্বভাবতই পুলিশ বাড়ি সার্চ করতে চায়। বাড়ির ভেতরে সবাই যখন রিয়াজকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় অধীর, তখন আমার সেই দিদা এক অদ্ভুত আচরণ করে বসেন।
রিয়াজকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেন তাঁর ঠাকুরঘরের বড় আসনটায়। তার পর সব ঘর তল্লাসি সেরে পুলিশ যখন ঠাকুরঘরেও ঢুকতে যাবে, এমন সময় দরজা আগলে দাঁড়ান সেই বৃদ্ধা।
অত্যন্ত দৃপ্ত ভঙ্গিতে পুলিশের মুখের ওপর বলেন, ‘আমি কুলীন ব্রাহ্মণ বংশের বিধবা, আপনারা এরকম ভাবার স্পর্ধা পান কীভাবে যে আমার ঠাকুরঘরে কোনো মুসলমান ছেলে ঢুকতে পারে।’
তাঁর সেই তেজ দেখে পুলিশ আর ঠাকুরঘরে ঢোকার দরকার মনে করেনি। সেদিন বেঁচে গিয়েছিল রিয়াজ।
কোন্ জাদু, কোন্ মন্ত্রবলে যেন সেদিন আমার দিদা মুহূর্তেই ভেঙে ফেলেছিলেন সাম্প্রদায়িক সমস্ত দেওয়াল। আর এভাবেই সিনেমার মিসেস আইয়ারও বাস্তবের আমার দিদা এসে দাঁড়িয়ে যান একই বিন্দুতে।
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প: সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
12 thoughts on “মিসেস আইয়ার”