রাংটিয়া সিরিজ
জ্যোতি পোদ্দার
.
এই অরণ্য আর যুগলকিশোর কোচদের নয়।
এই অরণ্য এখন আমীন করাত কলের লিজের চাতাল।
ট্রাকভর্তি উডলগ
ট্রাকভর্তি উডলগ
ট্রাকভর্তি উডলগ
করাতের করালে স্লিম ফর্সা ইউক্লিপটাস ইলেক্ট্রিক পুল হচ্ছে।
ছোট ছোট লাকড়ির আঁটি হচ্ছে
বস্ত বস্তা কুড়া হচ্ছে
ঝিমঝিম মাথা ধরা করাতের ঘড়ঘড় উপচে পড়ছে চারদিক।
ইলেক্ট্রিক পুলে পুলে বাত্তি আর বাত্তি
আর বাত্তিতে বাত্তিতে বাত্তিঅলা লোকের
এবার হাট বসবে পঞ্চবটির আন্ধার করা ঝোপে
ভোর হবার আগে বনমোরগ গলায় তুলবে ভোরের কীর্তন
ঝোপের আড়ালে আর কালো কালো ঝোপ নেই
কেবল বাত্তি আর বাত্তি
আর ঘুমহীন লাল বনমোরগ ভোরের
আগেই গলায় তুলে নিচ্ছে ভোরের কীর্তন
ওঠো ওঠো কোচনারী
তোমার মরদকে টাউনে মহাজনের মুদি দোকানে পাঠাও
গায়ে গতরে এখনো বান আছে
শরীরে শরীর ঘষলে এখনো জ্বলে আগুন
ও কোচনারী গতর খাটাতে তারে টাউনে পাঠাও।
রাংটিয়া সিরিজ
২
আমার পাশে যুগল কোচ আমার পাশে জাসেং ঘাগ্রা
আমার পাশে রফিক মজিদ
যুগল আমার প্রাত্যহিকতা জানে
জাসেং আমার প্রাত্যহিকতা জানে
আমি জানি না যুগল কোচদের নিকানো উঠানে
গোল বৃত্তের ভেতর যৌথতার উদ্দাম উৎসব
রফিক মজিদও জানে না জাসেঙের ওয়ান্না
অথবা ইস্টার সানডে কিভাবে বিনীত হয়
ক্রিশবিদ্ধ জেসাসের পাদপদ্মে
আমার ভাষা যুগলও জানে জাসেংও জানে।
গড়গড়ে আ মরি বাংলাভাষা
যুগল কিংবা জাসেঙের বলার ঢঙ ভালো লাগে
আহা! কী সুন্দর আচিকের সুরে বাংলাভাষা
আমাদের কানে সুধার মতো লাগে।
অথচ আমরা পড়শীর ভাষা জানি না।
আমরা পড়শীর মাটির ঘরে বাতায় বাঁধা ছিক্কায়
ঝুলে থাকা দরার কথা জানি না
ঊণ পড়শী সংখ্যার চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা
কখনো সমস্তপদ কখনো ক্ষুদ্র
কোথাও কোনো পূর্ণাঙ্গ চরিত্র নেই।
কস্মিনকালেও পূর্ণ নয় আমার মতো
কস্মিনকালেও পূর্ণ নয় রফিক মজিদের মতো
জলে ভিজে ভিজে
কান্নায় ভিজে ভিজে
বিন্নী ধানের চিড়ে ফুলেফেঁপে বেঢপ শরীরের মতো
যুগল কোচ জাসেং গারো মৃত নয় মৃতবৎ
শরীর আছে রা নেই
ভাষা আছে চিৎকার নেই
নকশীর ফ্যাকাশে লাল মাটি জানে
কতগুণ কান্না ঝরে
পাহাড়ি ছড়ায় আর পড়শী বোবা কান্নায়।
রাংটিয়া সিরিজ
৩
আমার এক বন্ধুকে একবার মান্দারের ডাল দিয়ে খুব পিটিয়েছি।
বন্ধু শত্রু হলে পিটিয়ে আরাম।
রাগের ঝাল মিটিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্যে পিটিয়েছি।
বন্ধুত্বের চাতাল নির্মাণ ছাড়া
বন্ধুতার উল্টাপিঠে মান্দারের ডাল কোনো আঁচড় কাটে না।
রোদের ভেতর রক্তরাঙা মান্দারের ফুল
হাসতে হাসতে
নাচতে নাচতে
শরীরে গড়িয়ে পড়লেও, আমি কিন্তু কাঁটা মান্দারের ডাল ভেঙে
পিটিয়ে পিটিয়ে বন্ধুতাকে নিঃশেষে বিভাজ্য করেছি।
যোগের পাঠ শিখিনি বলে কোনোদিন
রক্তরাঙা মান্দারের ফুল আমি তুলিনি।
লালে লালে লাল গাছতলা রক্তবর্ণা মান্দারের ফুল
আমার জন্য কেঁদেছে শুধু।
.
৪
বৃক্ষের চামড়া তুলে চৌকোনা ঘরে লাল রঙে
এখনো এখানে লেখা হয়নি হাজার পঞ্চাশ
অথবা হাজার সত্তর?
অথবা আবার হতে পারে হাজার নব্বুই?
এই বিটে বৃক্ষের সংখ্যা কত?
আমি জানি না।
কোনো মান্দাই জানে না।
সাহেব রেঞ্জার এই বিটের বৃক্ষশুমারিতে
যে সংখ্যা খতিয়ানে লিখে গেছেন
তার চেয়ে বাড়েনি বৃক্ষ
মানুষের পাশে মানুষ বেড়েছে উর্ধ্বমুখী শুধু
আর অরণ্যে কমেছে কোচ আর শুকরের পাল।
দুই বিটের মাঝে শূন্যতাও ভরেছে বৈদেশি গাছের
উপনিবেশ—গজারি বৃক্ষের পাড়া।
যদিও লালমুখা সাহেব তার প্রিয়টুপি নিয়ে চলে গেছেন।
সাহেবের লালবাংলো এখন রেঞ্জার অফিস
রেঞ্জার সাহেব টাউনে থাকেন
আর ছেলেমেয়ে বউ রাজধানী
এই বিটের সংখ্যা কত?
বৃক্ষের চামড়া তুলে চৌকোনা ঘরে লালরঙে
এখনো এখানে লিখিনি
হাজার পঞ্চাশ
হাজার সত্তুর
এখানে এখনো কিছু বৃক্ষ ব্যক্তিগত।
রাংটিয়া সিরিজ
৫
ধুন্দল ফুল যখন গোল হলদে পাঁচ পাপড়ি নিয়ে ফুটে
আমি প্রতিদিন বৃত্তের মতো গোল
পাঁচ পাপড়ির কাছে যাই
সবুজ ঝাকরা খাজ কাটা পাতার কাছে যেতেই
আমাকে লতিয়ে নিয়ে
জড়িয়ে জড়িয়ে ছড়ায় আর ছড়ায়
আমি বাবা বাবা ডাক শুনি
ছেলের ভয়ার্ত কান্নার ভেতর বাবা বাবা ডাক শুনতে শুনতে
আমি ক্রমশ গোল বৃত্তের মতো পাঁচ পাপড়ির
ফুলের কেন্দ্র ডুবে যাচ্ছি আর ডুবে যাচ্ছি
আব কাঁপা কাঁপা জলের কম্পনে ভেসে যাচ্ছে
ভেসে যাচ্ছে বাবা বাবা তুমি কই তুমি কই
শিশিরে শিশিরে মাঠঘাট আর পাকা সড়কের পাড়ে দূর্বা ঘাস
একটু একটু করে স্নাত হতে হতে
ভেজা ভেজা নরম শরীরে বুটিবুটি জলভরা বল
কোনোটি ফুটছে কোনোটি ঝড়ছে—টুপটাপ টুপটাপ মাত্রাবৃত্ত ছন্দে।
.
৬
সবুজ শাড়িতে শালগ্রাম পাথরের মতো
চকচক করছে মালতি কোচের
একহারা গড়নের পিটানো কালো গতর
ষোড়শী মালতি সাহসী।
ফাটাবাঁশের মতো চটাং চটাং কথা বলতে কাউকে
ছাড়ে না।
চোখ বড় বড় করে চোখের দিকে তাকিয়ে
বিস্ফারিত চোখে মুখে একটানা কথা
বলতে বলতে যেখানে থামল
সেখানে আমার ফুলস্টপ দেয় ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
মালতি কোচ মাধ্যমিক পাশ
কারিতাসের মাঠকর্মী
বুধবারে বুধবারে উঠান বৈঠকে
স্বাস্থঝুঁকি নিয়ে অল্প অল্প গল্প করে করে
স্বল্প স্বল্প ঋণ কিস্তি দিতে না পারলে
চটাং চটাং কথা বলতে কাউকে ছাড়ে না।
.
৭
এই অরণ্যে এলেই আমার ভেতর কে যেন কে যেন
আড়মোড়া ভাঙে
হলুদ পাতার পতন গুঞ্জনে হলুদ পাতার পতন গুঞ্জনে
গুতগুত করতে করতে কালো কালো বন্য
শুকরের দল আমার ভেতর গুতগুত করতে করতে
কংস পাড়ের সোঁতা থেকে
ছোপছোপ অন্ধকার গায়ে মেখে বন্য শুকরের দল
আমার ভেতর আমার ভেতর
গন্ধ শুঁকে শুঁকে খুঁজছে বিন্যস্ত গারো পাহাড়ের তামাম চাতাল
আমার ভেতর হলুদ পাতার পতন গুঞ্জনে
কে যেন কে যেন আড়মোড়া ভাঙে
আমার ভেতর এই অরণ্য আমার ভেতর এই অরণ্য
হাঁটে আর হাঁটে আর হাঁটে
আমি পাখি
আমি কোচ
আমি মান্দাই
আমি পাকুড় গাছের শিরায়
বন্য শুকরের ফিনকি দেয়া রক্ত
গাছে গাছে বান্দিছি আমার পরাণ সুতার বান্ধন
এই অরণ্যের সকলের পরানে পরানে
আমার ভেতর কে যেন আড়মোড়া ভাঙে
পতন গুঞ্জনে আমি উন্মাদ মাতাল
আমার ভেতর সমস্ত অরণ্য টিম্বার কোম্পানির
বিটে বিটে হাঁটে
আর বিটে বিটে হাঁটে
আর চকিদার টিলার ঢেউ খেলানো খাঁজকাটা উপত্যকা খোঁজে।
.
৮
কোচ যুবক কারিতাসে অথবা বাঙালি মুদির
পেটেভাতে খাটা বেগার গতর
খাটতে খাটতে সাদা ফর্সা মুখ তামা-কাঁসা-মুখ
কোচ যুবতী বিউটি পার্রালে মাইনে বান্ধা
বিউটিশিয়ান
কর্পোরেটের মডেল।
বাঙলি নারীর আস্থা আর বিশ্বাসের প্রতীক।
কোচনারী ভ্রুপ্লাক ফেশিয়াল আর ময়েশ্চারাইজার
দারুণ করে—চল্লিশের নারী যেন কলেজ পড়ুয়া।
সকলে কোচ নারীর কেয়ার অফ চায়।
মান্দাই তুমি বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী।
এসো কোচ আমার ঘরে
এসো কোচনারী আমার ঘরে
তোমার অরণ্য তোমার অরণ্য আমার হোক
পাহাড়ের সোঁতা জল আমার হোক
মোটা বালির মোটা লাভ
চিহিদানা বালির চিকন লাভ
লাল কাঁকড় বালির চকচকে লাভ
বিটের পর বিটে বাঙালির খামার হোক
হাইব্রিড লেবুর বাঙালি খামার হোক
মান্দি তুমি কারিতাসে থাকো
মান্দি তুমি পার্লারে থাকো
.
৯
আমার গাছ প্রীতি—টবে লাগানো গাছ প্রীতি।
দুই ফ্লাটের নকশা করছি বলে
উঠানের পরিসর রাখতে পারিনি।
ঘর থেকে নেমে রাস্তা
অথবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘরে ঢোকার রাস্তা।
পর্চ দেড় ফুট বাই ছয় ফুট।
সেখানেই ছোট ছোট টবে ছোট ছোট
ফুল আর ফলের বৃক্ষের বন।
রোদ আর বনের বাতাসে একটু একটু করে
বারান্দার রেলিঙে শুকাচ্ছে
ভেজা ভেজা কাপড় গামছা
আর ক্লিপে ঠাসা বাচ্চাদের
গেঞ্জি প্যান্ট পেটিকোট
আর দেয়ালের কোণে গোলাপী ব্রা।
রাংটিয়া সিরিজ
১০
না না—ঠিকাছে ঠিকাছে যুক্তি ঠিক আছে
ওর হা তোলা দেখেছ?
হাঁটা কিংবা হাত নেড়ে নেড়ে যখন ও কথা বলে
কেমন যেন কেমন যেন তোতলা তোতলা।
থেবড়ানো নাক পিটপিট চোখ আমার একদম পছন্দ না।
আর শজারুর কাঁটার মতো ওর খাড়াখাড়া চুল দেখছো?
স্রেফ ভয়ঙ্কর। আমার বাচ্চারা ওকে দেখলে
চোখ বন্ধ করে রাখে।
: টিয়ের ঠোঁটের মতো তোমার বাঁকানো নাক
তোমাকে যেমন মানিয়েছে ওর পিটপিট চোখও তেমনি।
ও ওর মতো
আমি আমার মতো
তুমি তোমার মতো
দুই চোখ মেলে দেখে অনন্যতা—প্রত্যেকে সুন্দর।
ঠিকাছে ঠিকাছে—সব জায়গায় যুক্তি দিও না।
রাংটিয়া সিরিজ
১১
পুরনো ঘর পুরনো বসত নব্বই ছুঁই ছুঁই বুড়ি বসে বসে হাটে
মস্ত বাড়ি এ-মাথা ও-মাথা ঘর।
মাঝখানের উঠান—ধান শুকাবার উঠান।
বিকেলবেলার গোল্লাছুটের উঠান।
এখনো নিকানো এখনো গোবর ছড়া সকাল বিকাল ঝাট
নব্বই ছুঁই ছুঁই বুড়ি বসে বসে হাঁটে।
বসে বসে হাঁটে।
মস্ত উঠান যেন বুড়ির থানপরা কাপড়ের মতো
ঝকঝকে তকতকে।
কোচকানো শাড়ির পাড়ের মতো উঠানের এককোণে
ময়লা পাতার ঢিপি উঁচু করে রাখা
পুরনো ঘর পুরনো বসত ভেঙে ঝুরঝুর
কিছু শেকড় ধসে গেছে
কিছু শেকড় দেশান্তর
কিছু শেকড় ফ্লাটের কংক্রিটে দাঁড়িয়ে খোঁজে আকাশ
কিছু শেকড় নির্বীজ ভাসমান উলম্বজীবন।
আড়াআড়ির জীবন নেই কোথাও
নব্বই ছুঁই ছুঁই বুড়ি—এ-ঘর ও-ঘর বসে বসে হাটে আর তকতকে উঠান মুচকি মুচকি হাসে।
…………………
পড়ুন
টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী : জ্যোতি পোদ্দার
“আমার এক বন্ধুকে একবার মান্দারের ডাল দিয়ে খুব পিটিয়েছি।
বন্ধু শত্রু হলে পিটিয়ে আরাম।
রাগের ঝাল মিটিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্যে পিটিয়েছি।”
দারুণ!
কি সাবলীল! কি অনাবিল!
সত্যিই মুগ্ধকর!
শুভেচ্ছা…
“মানুষের পাশে মানুষ বেড়েছে উর্ধ্বমুখী শুধু
আর অরণ্যে কমেছে কোচ আর শুকরের পাল।”
কি গভীর! কি গভীর!
শুভ কামনা…
“আমার ভেতর এই অরণ্য আমার ভেতর এই অরণ্য
হাঁটে আর হাঁটে আর হাঁটে
আমি পাখি
আমি কোচ
আমি মান্দাই
আমি পাকুড় গাছের শিরায় ”
কি সুন্দর!
গণমানুষ উঠে আসে বিশাল ক্যানভাসে।
দারুণ। শুভেচ্ছা অনেক…
শুভেচ্ছা নিরন্তর…