shubhobangladesh

সত্য-সুন্দর সুখ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবসময়…

রাত ভোর হতে আর কত দেরি

How late it is from dawn to night
How late it is from dawn to night

রাত ভোর হতে আর কত দেরি

আফরোজা অদিতি

রাত ভোর হতে আর কত দেরি

শালা হারামির বাচ্চা ।

প্রকাশক ও সম্পাদকের ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে শুয়ে থাকা কুকুরটাকে লাথি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গালি দেয় সে। কুকুরটা কুঁইকুঁই করে সরে যায়। কুকুরটা তার এতো সাধের ঘুমের ব্যাঘাত কেন ঘটলো—সেটা জানার ব্যর্থ চেষ্টা শেষে নেমে পড়ে রাস্তায়। ঘুমের মাঝে হাঁটছে, টলছে, আস্তে আস্তে এলোমেলো পা ফেলছে কুকুরটা। কুকুরটার হাঁটা দেখে মায়া হয় ওর।

মানুষ তো এমনই। কিছু করতে না-পারার বেদনায় যখন বিক্ষুব্ধ হয় মন, তখন মনের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে কোনো বস্তু বা কোনো নিরীহ মানুষ বা পশুর উপর। ওরও এখন সেই অবস্থা । প্রকাশককে কিছু বলতে না-পারার যন্ত্রণার সমস্ত ঝাল ঝাড়লো ওই নিরীহ-নির্বোধ ঘুমন্ত প্রাণীটির উপর। কী করবে এখন? মাথায় কিছু আসছে না। বুকের ভেতর কিছু করতে না-পারার যন্ত্রণা কুঁরে কুঁরে শেষ করে দিচ্ছে ওকে। করার কিছুই নেই ওর। ভেতরে শুধু ফুঁসে উঠছে রাগ। সিঁড়ির শেষ ধাপে দপদপিয়ে পা ফেলে দাঁড়িয়ে চোখ রাখে ঘড়িতে।

রাত দুইটা ।

রাস্তায় নেমে আসে। মধ্যরাতের শহর। মাথার ওপর শুক্লা তিথির চাঁদ। পূর্ণিমা আসতে দুইদিন দেরি এখনো। গ্রাম হলে এখন থই থই জোছনায় ভাসতো চারদিক। সবুজ গাছ-গাছালির ফাঁকে উঁকি দিতো চাঁদ, আর চাঁদের গা চুঁইয়ে গড়িয়ে পড়া আলোয় ভেসে যেতো গ্রামের পথঘাট। কিন্তু শহর এখানে রাস্তায় জ্বলে নিয়ন বাতি। নিয়ন বাতির আলোর ভেতর হারিয়ে যায় চাঁদের আলো। এখানে চাঁদের সঙ্গে হাঁটা যায় না।

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে ওর। প্রতি পূর্ণিমাতে থইথই জোছনায় বাবার হাত ধরে হেঁটেছে নদীর ধারে কখনো, কখনো কাশবনের ভেতর। মনের ভেতর উপচে পড়া খুশিতে বাবাকে বলেছে, বাবা দেখো চাঁদও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। বাবা হেসে মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়েছে। বাবার আদর মনে পড়ছে।

আকাশ নীল। পরিবেশ দূষণের কারণে নীল আকাশ খুবই কম দেখা যায়। আজ আকাশ নীল থাকায় তারা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সাদা মেঘ। সাদা মেঘ ইচ্ছা মতো উড়ে উড়ে ঢেকে দিচ্ছে কখনো চাঁদ কখনো তারাদের। শরতের নির্মল আকাশ ভালো লাগে সবসময়।

আকাশের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ মেঘের সঙ্গে চাঁদ আর তারাদের লুকোচুরি দেখে। চাঁদের লুকোচুরি আজ আর ওর মনে কবিতার জন্ম দিচ্ছে না। তবে কী ওর মন মরে যাচ্ছে? মনের এলোমেলো ভাবনায় বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ও। মনের বিক্ষিপ্ততার জন্য এই নির্মল সুন্দর আকাশ বেশিক্ষণ মনযোগ ধরে রাখতেও পারে না ওর ।

আজ চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে ও। কেন দিবে না। সত্যি কথা, উচিত কথা বললেই দেখতে পারে না কেউ আজকাল। প্রকাশকও এর বাইরে না। পত্রিকার কাটতির জন্য শিশু অপহরণ, পরকীয়ার জন্য খুন—এ জাতীয় খবর ছাপার বিপক্ষে ও। ওর মনে হয় এসব খবর যতো কম ছাপানো যায় ততো মঙ্গল। কিন্তু এই কথা ভালো লাগেনি প্রকাশকের।

শেয়ার বাজার ধসের নেপথ্য-কথা লিখতে চেয়েই আজকের এই বিপদ। অনেক পত্রিকায়ই শেয়ার-খবর ছাপছে। এখনকার খবরই তো শেয়ার বাজার। কত মানুষ পথে বসবে ঠিক আছে। কত মানুষের কান্না দেখেছে, দেখেছে বিক্ষোভ, ক্ষোভ। একদিন ঠিক হবে এই বাজার, কিন্তু যারা তাদের পুঁজি হারাবে তাদের কী হবে। এই কথায় প্রকাশক আরো রেগে গিয়ে বললো, সবার দায়ভার কী তোমার কাঁধে দেওয়া হয়েছে?

না। তা নয়। তবুও পত্রিকার তো সত্যনিষ্ঠতা আছে। 

সে বিষয়ে তোমার ভাবতে হবে না।

না ভাবলে কাজ করবো কেন?

না করলে পথ দেখো।

প্রকাশকের ব্যবহার কয়েকদিন ধরেই ভালো লাগছিল না ওর। এতোদিন এক-আধটু কথা কাটাকাটিতে মনে কিছু করেনি, কিন্তু আজ মুখের উপর না বলে দিলো, বললো, ভালো না-লাগলে অন্য পথ দেখো।

এতো সহজে আজ এ-কথা বলে দিলো ওকে! কেমন করে বললো তাই ভাবছে; এই পত্রিকার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে খেটেছে। পত্রিকার আজকের পজিশন শুধুমাত্র ওর জন্যই। শুধুমাত্র কি এই পত্রিকার জন্য, ওই লোকটার জন্য কী করেনি ও।

যখন ওই লোকের পাশে কেউ ছিল না, তখন তো ওই ছিল তাঁর আশেপাশে। ওই ছিল একমাত্র ভরসা ওই অকৃতজ্ঞ লোকটার। কথায় আছে না ‘পার হলেই পাটনি শালা’।

আর কাজের কথা! দশমিনিটে পোস্টএডিটোরিয়াল লিখে দিয়েছে। অনুবাদের প্রয়োজন ডাক পড়েছে ওর। গদ্য লিখতে হবে প্রস্তুত এই অধম। কোনো কিছুতেই কার্পণ্য করেনি কখনো। চটজলদি করে দিয়েছে সব। কারো সাক্ষাৎকার নিতে হবে চলে গেছে ও।

শুধু কি এই? গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ যা কিছু সংগ্রহ করা দরকার—সবকিছু ওরই দায়িত্বে। কখনো না করেনি, পথ খরচাও চায়নি কখনো।

তখন কত প্রশংসা ওর। সবখানেই শুধু ওরই কথা—যার সঙ্গে দেখা হতো তাকেই বলতো, ওর মতো ছেলেই হয় না। ওর বুকে যেমন আছে তেজ, আছে সাহস, তেমনই আছে শব্দের ভাণ্ডর। আর শব্দগুলো খুবই তীক্ষ্ণ, যেন শব্দ নয়—এক-একটা বুলেট।

কিন্তু আজ! এতো কিছুর পরেও তো আজ নেই ওর জায়গায়! পত্রিকায় স্থান নেই, মূল্যায়ন—তা দূরের কথা! কিছুই হয়নি, কিছুই নেই! বন্ধুরা ঠিকই বলতো, এতো ভালো ভালো নয়। আজ ওর মনে হচ্ছে ঠিকই। ‘কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরালেই পাজী’ প্রবাদটি অভিনবভাবে খেটে গেছে ওর জীবনে।

আজকাল মানুষ কি এমনই হয়ে গেছে। যে যেমনভাবে সুবিধা করতে পারে সুযোগ পায়, তেমনই ভাবে ব্যবহার করে শোষণ করে একে-অন্যকে। ও সেইভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, হয়েছে শোষিত—না কি নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছে ও? নিজেকেই প্রশ্ন করে জবাবও দেয় নিজেই। না কক্ষনো না।

কাজ করতে ভালো লাগতো ওর তাই কাজ করেছে। লাভ-ক্ষতির বিচার করেনি, করেনি বেতনের পরোয়া। শুধু চেয়েছে মূল্যায়ন। একটু সম্মান। কাজ করে এটুকু কে না চায়। মানুষ হিসেবে একজনের যেটুকু প্রাপ্য, সেটুকু সকলেই চায়। মানুষ মাত্রেই তার নিজস্ব বোধ থাকে, থাকে সম্মান এবং তা থাকবেই।

হাঁটতে থাকে ও।

চারদিক শান্ত। মাঝে মধ্যে নিরবতা ভেঙে দিচ্ছে মধ্যরাতের রিকশার ঘণ্টাধ্বনি। কোনো রিকশা সওয়ারি নিয়ে যাচ্ছে, কোনোটা খালি।

ও হাঁটছে। পাশে ফুটপাতে শুয়ে আছে একটা পরিবার। দুই বাচ্চা আর স্বামী-স্ত্রী। ওদের ঘুমন্ত মুখে নিশ্চিন্তের একটা ভাব ফুটে আছে। এতোটা নিশ্চিন্ত হয় কি করে এরা। আসলে খোয়াবার যদি কিছু না থাকে, তা’হলে বুঝি নিশ্চিন্ত হওয়া যায় এতোটাই। ওরা ছিন্নমুল। এরকম ছিন্নমুল মানুষ আরো আছে এ শহরে। শুধু এ শহরে নয়, আছে অন্য শহরেও। ওদের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয় ও; আর ভাবে—ও কি তবে আজ এই ছিন্নমুলের দলে।

আরো কিছুদূর যেতেই দেখে দুই গাঁজারু কলকেতে দম দিচ্ছে। ওদের একটু দূরে শুয়ে আছে এক কিশোরী। এলোমেলো চুলে ঢেকে আছে মুখের একপাশ। সরে গেছে বুকের ওড়না। লোলুপ দৃষ্টিতে সেদিকে দেখছে মাতাল দুজন।

ভেতরে রাগ ফুঁসে উঠছে আবার। ইচ্ছা করছে এক ঘুঁষিতে নাকটা ফাটিয়ে দিতে ওদের। উপড়ে নিতে ওদের চোখ। আজ ওর এমন হচ্ছে কেন? মনের মধ্যে বাড়ছে হিংস্রতা। বাড়ছে ক্রোধ। এমন তো হয়নি কখনো।

প্রশ্ন করে নিজেকে। আজ রাগ করছো কেন? এ বিষয়ে এতোদিন লেখনি কেন? এ পথে তো আগেও গিয়েছো? কেন ভাবোনি এ বিষয়ে?

তাই তো, গতকালও গিয়েছে এ-পথে, কিন্তু এ-কথা তো মনে হয়নি। অথচ এসব কথা মনে হচ্ছে আজ। তবে কি এই কয়েক ঘণ্টায় পাল্টে গেছে ওর মন, পাল্টে গেছে নিজেও। আজকে কী সে একেবারেই অন্যরকম। আজ ওর চাকরি নেই। ওর মন তাই আজ এক বেকারের মন। এই ফুটপাতে থাকা লোকগুলোর সঙ্গে আজ একটুকুও তফাত নেই ওর।

পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায় ও। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করে। পকেট হাতড়ে ফেরে। না নেই। সিগারেট নেই। রাস্তার ওপারে দোকানটা, যেখান থেকে সবসময় সিগারেট নেয়, সেটা এখনো খোলা। এখনো জ্বলছে দোকানের আগুনমুখো দড়িটা।

রাত একটায় বন্ধ হয়ে যায় দোকান, আজ খোলা এখনো। পায়ে পায়ে দোকানে গিয়ে সিগারেট নিয়ে দাম দিতে গিয়ে দেখে পকেট শূন্য। টাকা নেই। তিন মাসের বেতন পায়নি। খবর না-ছাপার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বকেয়া বেতনও চেয়েছিল বলেই তো আজ ওর এই অবস্থা।

বেতন তো নেই-ই, চাকরিটাও নেই। সিগারেট ফেরত দিয়ে পাগলের মতো হাসতে থাকে। দোকানি চেনে ওকে। এরকম তো নয় ছেলেটা! আজ কী হয়েছে ওর! কেন ওর হাসিতে এতো বিষন্নতা? কেন ওর হাসিতে শুধু চিরে যাচ্ছে এই মধ্যরাতের প্রহর? চিরে যাচ্ছে ওর সমগ্র হৃদয়, ভেঙে যাচ্ছে ওর জীবন?

অবাক দোকানি বলে, ভাইসাব কী হইছে?

দোকানির কথা শুনে হাসি বন্ধ করে। বলে, না না কিছু না ।

আবার পথে নামে ও। শালার চাকরি। শালা হারামির বাচ্চা, তোর চাকরির মুখে…। খিস্তি শুনে অবাক হয় নিজেই। আজ বারবার কেন যে এতো খারাপ কথা মুখ দিয়ে বের হচ্ছে। এমন তো ছিল না কখনো। নিজের মনে ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটে।

ও থাকে মেসে, কিন্তু আজ মেসে ফিরতে ইচ্ছা করছে না ওর; উদ্দেশ্যহীন হাঁটে। নিজের মনের সঙ্গে কথা বলে নিজে।

চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ভালো করেছে। কেন ছাড়বে না? পত্রিকায় হোক আর যেখানেই হোক একটা নামহীন বড়সড় পোস্ট দিয়ে রাখলেই হলো নাকি? কি নাম? না, নির্বাহী সম্পাদক! যার শুধু কাজ আছে, আর আছে জবাবদিহিতা। যে কাজে ওর কোনো হাত নেই তার জন্য ওর কেন জবাবদিহি করতে হবে।

নিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে লেখা জোগাড় করে, বিজ্ঞাপনের জন্য করে দৌড়ঝাঁপ, কিন্তু ফল কী দাঁড়ায়! কোনো কোনো মাসে পত্রিকা বের হয়, কোনো মাসে বের হয় না। কখনো কখনো এক-দেড়শ ছাপা।

লেখা, বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য যাতায়াতের খরচ ছাড়াও লেখক এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে ওর মানসম্মান নিয়ে টানাটানি। কারণ, ও তো নির্বাহী সম্পাদক। গালভরা নাম। উঃ!

ভালো করেছে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। একজন অসৎ লোকের অধীনে কাজ করার চেয়ে না-খেয়ে থাকা অনেক ভালো, অনেক সুখকর। খুব ভালো করেছে। মুখের ওপর না বলেছে, ইস্তফাপত্রও সেই সঙ্গে রেখে এসেছে।

ও হাঁটছে। ওর সঙ্গে হাঁটছে মধ্যরাতের চাঁদ। পায়ের তলে একটা ইটের টুকরা পড়েছে। সেটাকে ফুটবলে শট দেওয়ার মতো করে লাথি দিলে—ওটা ঠং শব্দ করে রাস্তার অপর দিকে গিয়ে পড়ে।

এবার রাগ হয় নিজের পরে। ইদানীং ওর কারো সঙ্গে বনছে না। খুব অল্পে রেগে যাচ্ছে। কেউ খারাপ কিছু করলে রাগ হচ্ছে, তোড়ফোড় জবাবও দিচ্ছে তাকে। ওকে যেন পাবলিক গার্জেন রাখা হয়েছে।  

আরে বাপ লোকে অসৎ হয়েছে, তাতে তোমার কী? অন্যে খারাপ কাজ করছে, তাতে তোমার কী এলোগেল? মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ডুবে যাচ্ছে মানুষ ডুবে যাক, যাক! ডুবতে ডুবতে তলিয়ে যাক তোমার এতো লাগে কেন?

অন্ধ প্রতিবন্ধী সমাজটার বোধদয় হচ্ছে না তোমার কী তাতে? তোমার মতো তুমি করেকম্মে খাও। হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দাও। তা না পাবলিক গার্জেন! এবার বোঝ ঠেলা। কত জিগার কত আঠা।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে নিজেকেই নিজে গালি দেয়। এই হারামি তোর সৎ হতে বাধা আছে নাকি? অন্যে অসৎ হলে, তোকেও অসৎ হতে হবে—কোন কেতাবে লেখা আছে! ব্যাটা হারামি বিটলামি করার আর জায়গা পাও না, তাই না।

মনের ভেতরের সৎ মানুষটা মাথা তোলে। জবাব দেয় বলিষ্ঠ কণ্ঠে। না, অন্যে অসৎ হলে ওকেও অসৎ হতে হবে নট দ্যাট। কিন্তু কয়দিন থাকতে পারবে সৎ। এই অবক্ষয় আর নৈতিকতাবিহীন সমাজে কতদিন ওর মূল্যবোধ আর নৈতিকতা আঁকড়ে ধরে থাকতে পারবে ও?

অনিশ্চিত জীবন নিয়ে কয়দিন ভালো থাকতে পারে মানুষ। এই বিষয়টা নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে ছিল ও। কিছু কথা কানে যেতেই চমকে ওঠে। আবে, শালা কী আছে বাইর কর। সামনে পাশে পিস্তল, চাকু হাতে পথ আটকে দাঁড়িয়েছে চারজন। ওর চোখে হাত দিয়েছে ওরা। জ্বলে যাচ্ছে চোখ। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না।

এ্যাই কে তোমরা, কী চাও?

চুপ, চিল্লাবি না কইলাম। ফুটা কইরা দিমু।

ও চিৎকার করে না। চোখ ডলতে ডলতে বলে, দেখো ভাই আমার কাছে কিছুই নেই।

নাই ক্যান শালা ।

দেখো ভাই, চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এই মূহূর্তে আমি পথের ভিখেরি, একটা কানাকড়িও নাই। টাকা যা কিছু জমিয়েছিলাম, তা শেয়ারে লাগিয়েছিলাম, অন্তত মাসের খাওয়া, মেস ভাড়া চলবে। কিন্তু এখন সে টাকাও…

এ্যত্তো কথা কইস ক্যান শালা, চোপ!

চারজনের একজন পিস্তল কোমরে ধরে রাখে, অন্যজন পেটে ধরে রাখা ছুরিতে চাপ দেয়। অন্য দুইজন ওর পকেট হাতড়ায়। মানিব্যাগ বের করে।

শালার ব্যাগে কিছু নাইকা দোস্ত। কথা বলেই ব্যাগ পায়ের তলায় ফেলে বলে, জুতা খোল।

কিছু না পেয়ে ঘড়ি কলম জুতা নিয়ে চলে যায় ওরা। কিছুদূর গিয়ে ফিরে এসে কলম দিয়ে বলে, লে বাবা তোর কলম, এ কাম আমা গো না। শালা…

ওরা চলে যেতেই মানিব্যাগ কুড়িয়ে ফুটপাতে বসে পড়ে। ক্ষুধা লেগেছে। পেটের ভেতর ক্ষুধায় পাক খেয়ে যাচ্ছে। বমি পাচ্ছে। মনে পড়ে আজ সারাদিন খাওয়া হয়নি। পকেট খালি, পেটে ক্ষুধা, চাকরি নেই—সব মিলিয়ে ওকে নির্জীব করে তোলে। হাঁটতে ইচ্ছা করছে না। বসে পড়ে ফুটপাতে।

মনের ভেতর টগবগ করছে রাগ। চাকরি ছেড়েছি বেশ করেছি। এমন লোকের চাকরি করার চেয়ে না করা ভালো। মাত্র তো একটা পেট, খেয়ে-না-খেয়ে চলেই যাবে। বউ বালবাচ্চা তো নেই। চিন্তারও কিছু নেই। মা-বাবাও নেই যে দায়িত্ব-কর্তব্য থাকবে। একলা মানুষ। চাকরি করতেই হবে এমন কোনো কথা ত্রিলোকের কোথাও কোনো জায়গায়, কোনো কেতাবে লেখা নেই।

ওর মনে প্রশ্ন আসে। যদি ছেলে-মেয়ে বউ থাকত, থাকত মা-বাবা, তাহলে কি এভাবে হুট করে চাকরি ছাড়তে পারতো? পারতো না! মানুষের নিজের ওপর যতোখানি না মায়া থাকে, নিজেকে না যতো ভালোবাসে তার থেকে স্ত্রী, সন্তান-সংসারের ওপর মায়া ভালোবাসা টান থাকে বেশি।

ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে থাকে দায়িত্ব-কর্তব্য। স্ত্রী, সন্তানের মুখ চেয়ে মানুষকে অনেকসময় মন না-চাইলেও অনেক কাজ করতে হয়। ওদের ভালো রাখার জন্য করতে হয়।

বাল্মিকীও একসময় তার পরিবার-পরিজনদের জন্য ডাকাতি করেছে। পরিবার পালনের দায়িত্ব কেবলমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির। সে নারী হোক কিংবা পুরুষ। ন্যায় কিংবা অন্যায়, যে পথেই সে রোজগার করুক—এসবের দায়ভার শুধুমাত্র তারই। পরিবারের আর কারো নয়।

ওর আর ভাবতে ইচ্ছা করে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে টহলরত পুলিশ এগিয়ে আসে। একজন পরিচিত। কী ব্যাপার ভাই। অসুস্থ নাকি? এভাবে বসে আছেন। যান বাড়ি যান। যা দিনকাল পড়ছে, কী থেকে কী হয়ে যায়, তা বলা যায় না। না চিনলে আপনাকে সাংবাদিক বলে কেউই রেহাই দিবে না।

না না, ঠিক আছে। চলে যাচ্ছি। উঠে দাঁড়ায়। ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে পুলিশ চলে যায়। ও হাঁটতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। বসে পড়ে। তার পর শুয়ে পড়ে। রাত কত হবে। অভ্যাস মতো হাত উল্টিয়ে দেখে ঘড়ি নেই। ম্লান হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটে। নিয়ে গেছে ওরা।

ক্ষুধায় এসিড ফর্ম করেছে। আলসারের ব্যথা বেশ কয়েকদিন ধরেই অল্প অল্প হচ্ছিল। আজ সুযোগ পেয়েই হানা দিয়েছে। মানুষের মতো অসুখও সুযোগ সন্ধানি হয়ে গেছে, ভাবনাটা মনে আসাতে আবারও হাসি পায় ওর। যন্ত্রণা হচ্ছে। পানি খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সঙ্গে পানি নেই।

হেঁটে গিয়ে পানির সন্ধান করবে সে অবস্থাও নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু পারছে না। চোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রাণপণ শক্তিতে চোখ খুলে রাখার জন্য চেষ্টা করে পারে না। আবার চেষ্টা করে, নাহ্ পারছে না। আবার, আবার… এবার সফল হয়।

চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে খোলা দৃষ্টি মেলে দিয়ে উচ্চারণ করে ‘রাত ভোর হতে আর কত দেরি…’ আকাশের দিকে তাকিয়ে ভোরের অপেক্ষা করে একালের সৎ-নির্ভীক সাংবাদিক রনিত রায়হান ।

………………… রাত ভোর হতে আর কত দেরি

পড়ুন

কবিতা

আফরোজা অদিতির পাঁচটি কবিতা

গল্প

রাত ভোর হতে আর কত দেরি

ভ্রমণ

গোকুল মেধ বা বেহুলার বাসরঘর

অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণকথা

অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণকথা – ২য় পর্ব

দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও রাণী রাসমণি

দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও রাণী রাসমণি – ২য় পর্ব

About The Author

শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে থাকুন...