shubhobangladesh

সত্য-সুন্দর সুখ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবসময়…

সূর্য কোনে কোন সময় লাল রং রূপ পায়?

sun sometimes red

sun sometimes red

এমন প্রশ্ন নিশ্চয়ই আপনার মনেও জেগেছে—সূর্য কোন কোন সময় লাল রং রূপ পায়? অথবা সূর্যের রং কেন লাল হয়? আপনি কি সম্প্রতি সূর্যোদয়ের সময় আলাদা কিছু লক্ষ্য করেছেন?

আবহমান কাল ধরে এটাই সত্যি। এটাই আমরা জানি, সূর্য যখন ওঠে কিংবা অস্ত যায়, তখন কখনো কখনো তার রং হয় লাল। ওই লাল সূর্যের আভায় আকাশেও তখন অপূর্ব রক্তিম বা কমলা রং ধরে, কখনো বা তার মধ্যে বেগুনি আভায় দেখা যায়।

কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না কেন সময়ে সময়ে সূর্য এই লাল রং ধারণ করে?

গোধুলি বেলার এই রংয়ের খেলা নিয়ে কত গান বাধা হয়েছে, কত কবিতা লেখা হয়েছে, এ নিয়ে রোমান্টিকতার ও শেষ নেই। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে শুদ্ধ ও শুষ্ক এক বিজ্ঞান।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, সম্প্রতি পৃথিবীর কোনো কোনো জায়গায় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়টাতে নানা রংয়ের বিচ্ছুরণ আকাশকে অপূর্ব দৃশ্যময় করে তুলেছে। আকাশে এখন লাল সূর্য আর রংয়ের খেলা দেখা যাচ্ছে আগের তুলনায় বেশি।

তাই আবহমান কালের এই রোমান্টিক আলোর জগতের পেছনে বিজ্ঞানের বাস্তবতা কী, সে-কথাই জানা যাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে।

আলোয় ভুবন ভরা

পৃথিবীর কোন কোন জায়গায় সম্প্রতি সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়টাতে নানা রংয়ের বিচ্ছুরণ দেখা গেছে—যা আকাশকে অপূর্ব দৃশ্যময় করে তুলেছে। আকাশে এমন অপরূপ দৃশ্যের একটা ব্যাখ্যা হলো র‍্যালে স্ক্যাটারিং—পদার্থবিদ র‍্যালের নীতি অনুযায়ী বিচ্ছুরিত আলো ভেঙে ছড়িয়ে পড়া।

গ্রেনিচের রয়াল মিউজিয়ামের জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ব্লুমার বলছেন, এটা হলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দিয়ে সূর্যের আলো যখন প্রবাহিত হয়, তখন সেটা যেভাবে আমাদের চোখে ধরা দেয়।

বিষয়টা বুঝতে গেলে প্রথমে আলোর উপাদানটা জানতে হবে। আমরা চোখে যে আলো দেখি তাতে আমরা জানি সাতটা রং আছে—লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, গাঢ় নীল এবং বেগুনি।

ব্লুমার বলছেন, সূর্যের রংয়ের ক্ষেত্রে এই হেরফের ঘটে যখন সূর্যালোক ভেঙে ছড়িয়ে যায়। যখন আলো কণাগুলো ভাঙে সেগুলো সমানভাবে ভাঙে না—অধিকাংশ সময় ভাঙে এলোমেলো ভাবে।

আলোর মধ্যে প্রত্যেকটা রংয়ের ওয়েভলেংথ বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা, আর সে কারণেই তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্যানুযায়ী তাদের রংয়ের তীব্রতায় কমবেশি হয়।

যেমন বেগুনি রংয়ের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম, আর লালের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি। ফলে কোন রং কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে প্রবাহিত হচ্ছে, তা নির্ধারণ করবে—আমরা কীভাবে সেই রংগুলোর বিচ্ছুরণ প্রত্যক্ষ করব।

এর পর আমাদের আবহাওয়া মণ্ডলের বিষয়টা বুঝতে হবে। যে আবহাওয়ামণ্ডল বা বায়ুমণ্ডলে রয়েছে নানাধরনের গ্যাসের স্তর, যার মধ্যে রয়েছে অক্সিজেনও, যেটাতে আমরা শ্বাস নিই এবং যেটা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।

ছড়িয়ে পড়া বিচ্ছুরিত আলো

সূর্যের আলো যখন বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন তা বেঁকেচুরে এবং ভেঙে যায়, যেন একটা প্রিজম বা ত্রিভুজাকৃতি স্ফটিকের মধ্যে দিয়ে সেটা যাচ্ছে। এর কারণ বায়ুমণ্ডলে যেসব গ্যাস রয়েছে, তার প্রতিটার ঘনত্ব আলাদা।

এ ছাড়া বায়ুমণ্ডলে অন্য যেসব কণা রয়েছে, সেগুলোর কারণে ভেঙে যাওয়া আলোর কণাগুলোর প্রতিফলন তৈরি হয়।

সূর্য যখন অস্ত যায় বা ওঠে, তখন সূর্য রশ্মি আবহাওয়া মণ্ডলের সবচেয়ে উপরের স্তরে একটা বিশেষ কোণ থেকে ধাক্কা মারে এবং সেখান থেকেই শুরু হয় সূর্যের আলোর ‘ম্যাজিক’।

সূর্যরশ্মি এর পর যখন উপরের স্তর ভেদ করে ভেতরে ঢোকে, তখন সেই স্তর নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে শুষে নেয় না, বরং সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে প্রতিফলিত হয়।

ব্লুমার আলো বলছেন, সূর্য যখন দিগন্তের নিচের দিকে অবস্থান করে, তখন নীল আর সবুজ রং ভেঙে যায় এবং আমরা কমলা এবং লাল রংয়ের আভা দেখতে পাই।

এর কারণ, আলোর যে রংগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট (যেমন বেগুনি এবং নীল) সেগুলো বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো, যেমন কমলা এবং লালের চেয়ে বেশি ভেঙে যায় এবং এর ফলে আকাশে নানা রংয়ের আলোর অসাধারণ বিচ্ছুরণ আমরা দেখি।

আকাশ লাল দেখায় কেন?

আবহাওয়া মণ্ডলে যখন বালুকণা থাকে, তখন আকাশে আমরা লাল বা গোলাপী রংয়ের আভা দেখতে পাই বেশি, ঠিক যেমন দেখা যায় মঙ্গল গ্রহের আকাশে

দেখে মনে হতে পারে, সূর্যের কিছু পরিবর্তনে এমনটা ঘটছে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। এটা শুধু দেখার রকমফের।

পৃথিবীর কোথায় আপনি আছেন, তার ওপর নির্ভর করবে সূর্যের কী রং আপনি কীভাবে আকাশে দেখবেন। যেখানে আপনি আছেন—সেখানে বায়ুস্তরের অবস্থানুযায়ী সূর্যের আলো আকাশকে আলোকিত করবে।

ব্লুমারের বক্তব্য, ধূলোর মেঘ, ধোঁয়া এগুলোও আকাশের আলোর বিচ্ছুরণের ওপর প্রভাব ফেলে।

আপনি কোথায় আছেন, ক্যালিফোর্নিয়ায় না বাংলাদেশ বা ভারতে, নাকি চিলে বা অস্ট্রেলিয়ায় কিংবা আফ্রিকার কোথাও, অথবা লাল বালুর কাছাকাছি এমন কোনোখানে—তার ওপর নির্ভর করে আলো প্রতিফলন ঘটায়। তা ছাড়া বায়ুমণ্ডলের যেসব কণা—সেগুলো আপনার বায়ুমণ্ডলে কী পরিমাণে এবং কতটা সক্রিয় অবস্থায় আছে, আর পাশাপাশি আপনি যেখানে আছেন—সেখানে আবহাওয়ার পরিস্থিতি কী। আর সেটার ওপরই নির্ভর করবে আকাশ আপনি কীভাবে দেখছেন।

ব্লুমারের ব্যাখ্যা : এটা কিছুটা হয় মঙ্গল গ্রহের মতো। যখন লাল ধূলিকণা বাতাসে বেশি থাকে, তখন মনে হয় আকাশের রং গাঢ় গোলাপী।

আপনি এমনকী যদি মরুভূমি থেকে অনেক দূরেও থাকেন, তাহলেও আকাশের এই নাটকীয় রং আপনি দেখতে পাবেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায়ই সাহারা মরুভূমির বালুকণা আবহাওয়া মণ্ডলের উপরদিকের স্তরে উঠে সেখানে অবস্থান করে। সেখান থেকে ওই বালুকণার স্তর ইউরোপ এমনকী সাইবেরিয়া বা আমেরিকা পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারে।

নতুন করে কিছু ঘটছে?

লকডাউনের কারণে আমরা প্রকৃতির দিকে নজর দেবার সময় পাচ্ছি বেশি। হয়তো যা ঘটছে, তা আশ্চর্য হবার মতো কিছু নয়। কিন্তু যেটা বদলেছে—তা হলো আমরা অনেক জিনিস কিছুটা ভিন্নভাবে দেখছি।

ব্লুমার বলছেন, আমরা দেখেছি, লকডাউনের পুরো সময়টাতে মানুষ প্রকৃতির দিকে, আকাশের দিকে বেশি নজর দিয়েছে, কারণ মানুষের অন্য কিছু করার বিষয়াদি—এ-সময় অনেক কম ছিল।

ব্লুমারের যুক্তি : সিনেমা, থিয়েটার, বিনোদনের বেশিরভাগ পথ বন্ধ থাকায় আমরা বাসায় থেকেছি বেশি, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছি বেশি।

তিনি আরো বলছেন, এ ছাড়া আকাশে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় এবং দূষণের মাত্রা কম থাকায়—মানুষ আকাশে তারা দেখার চেষ্টা করেছে বেশি, অর্থাৎ আকাশের দিকে নজর দিয়েছে আগের তুলনায় বেশি।

বহুবৈচিত্র্যের রংধনু

আকাশে রংধনু, জোড়া রংধনু, পরিষ্কার নীল আকাশ, সবকিছুর পেছনেই আছে র‍্যালে স্ক্যাটারিং তত্ত্ব।

পদার্থবিজ্ঞানী র‍্যালে আলোকরশ্মির ভেঙে ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়া নিয়ে যে তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন, তাতে দিনের মাঝামাঝি সময়ে আকাশ কেন আলো বেশি নীল দেখায়—তারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

সূর্য যখন আকাশে মাথার ওপরে থাকে, তখন তার রশ্মি আবহাওয়া মণ্ডলের একটা অখণ্ড স্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেখানে বিভিন্ন স্তরের মধ্যে প্রভেদ না-থাকায় এই আলো ভেঙে যায় না। আবহাওয়া মণ্ডল এই রশ্মিকে শুষে নেয়, ফলে আমরা আলোর যে রং দেখি তা মূলত নীল।

কিন্তু আবহাওয়া মণ্ডলে বদল ঘটলে সেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়।

সূর্য আকাশে থাকা অবস্থায় যদি বৃষ্টি হয়, তখন প্রতিটা বৃষ্টি-বিন্দুতে আলোর কণা বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিভক্ত হয়ে যায় এবং ভেঙে যাওয়া আলোর প্রতিটা রংয়ের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুযায়ী তার প্রতিসরণ দেখা যায় আবহাওয়া মণ্ডলে।

উনবিংশ শতাব্দীতে পদার্থবিদ লর্ড র‍্যালে সূর্যকিরণ এবং বায়ুমণ্ডল নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আকাশের রং কেন নীল—তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

—ডেস্ক শুভ বিজ্ঞান। সূত্র : বিবিসি, বাংলা

About The Author

শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে থাকুন...