shubhobangladesh

সত্য-সুন্দর সুখ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবসময়…

গোকুল মেধ বা বেহুলার বাসরঘর

Gokul Medh - Behular Bashor Ghor

Gokul Medh - Behular Bashor Ghor

Gokul Medh - Behular Bashor Ghor

গোকুল মেধ বা বেহুলার বাসরঘর

আফরোজা অদিতি

বগুড়া শহর থেকে ১০ কি.মিটার উত্তরে এবং মহাস্থান গড় থেকে ২ কি.মিটার দক্ষিণে গোকুল গ্রামে এই ‘গোকুল মেধ’ পুরাকীর্তি অবস্থিত। গোকুল, রামশহর, ও পলাশবাড়ি—এই তিনটি গ্রামের সংযোগস্থলে এই মেধটি অবস্থিত।

এই স্মৃতিস্তুপটি অতীতের অসংখ্য ঘটনার স্বাক্ষর বহন করছে। এটি বেহুলা-লক্ষিন্দরের বাসরঘর বলেও পরিচিত। এই বাসরঘর মেড় থেকে মেধ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মতে, মেধটি আনুমানিক ৭ম শতাব্দী থেকে ১২শ শতাব্দি মধ্যে নির্মিত হয়েছে। কথিত আছে—এখানে বেহুলা-লক্ষিন্দরের বাসর হয়েছিল।

কিন্তু বর্তমান গবেষকদের মতে, এই কীর্তিস্তম্ভটি নির্মাণ করেন দেবপাল এবং এটি ৮০৯ থেকে ৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত একটি বৌদ্ধমঠ। বিভিন্ন সময়ের তথ্যমতে জানা যায়, বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাং তাঁদের ভ্রমণকাহিনীতে—এটিকে বৌদ্ধমঠ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।

ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণগ্রন্থে উল্লেখ আছে, গৌতমবুদ্ধ পুন্ড্রবর্ধনে কিছুসময় (প্রায় তিন মাস) অতিবাহিত করেছিলেন এবং তাঁর স্মৃতিতে সম্রাট অশোক এইস্থানে একটি স্মৃতিস্তুপ বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন; এই স্মৃতিস্তুপে সে-সময় আলোকমালায় সজ্জিত করা হতো।

এই হিসেবে মনে করা হয়, স্মৃতিস্তম্ভগুলিতে বৌদ্ধবাণী প্রচারিত হতো; কাগজ আবিষ্কার না-হওয়ায় স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে বুদ্ধের বাণী খোদাই করে লিখে রাখা হতো। এ ছাড়া ত্রিকোণ বিশিষ্ট কক্ষগুলি বৌদ্ধভিক্ষুদের ধ্যানকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

হয়তো-বা এখানে যজ্ঞের আয়োজন করা হতো, কারণ মেধ অর্থ যজ্ঞ। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থে এই মেধকে একটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এটি নির্মাণ করা হয়েছিল পুণ্ড্রবর্ধনকে বাইরের শত্রু থেকে রক্ষা করার জন্য।

ইটের তৈরি এই স্তুপটি পূর্ব-পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ। এখানে ত্রিকোণ বিশিষ্ট ১৭২টি কক্ষ আছে। এই কক্ষগুলি দেখতে অস্বাভাবিক এবং এর নির্মাণশৈলি এলোমেলো। এই এলোমেলো নির্মাণশৈলীর জন্য এর বোধগম্যতা বিশেষভাবে দুর্বোধ্য হয়ে আছে।

বলা যায়, এই স্তুপটি বাসরঘর নয়। স্তুপটির পশ্চিম অংশে বাসরঘরের প্রবাদ স্মৃতিচিহ্ন আছে এবং পূর্বাংশে রয়েছে ২৪ কোণ বিশিষ্ট একটি চৌবাচ্চাসদৃশ স্নানাগার। ঐ স্নানাগারের মধ্যে একটি ৮ ফুট গভীর কূপ ছিল—যা দেখে মনে করা হয়, বেহুলা-লক্ষিন্দর তাঁদের বাসররাত যাপনের পর কূপের জলে স্নান করে শুদ্ধতা লাভ করেছিলেন।

কিন্তু এই স্তুপ এবং কূপ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে :

  • এটি মহাস্থানগড়ের শেষ ক্ষত্রিয় রাজা পরশুরামের সময়ে অপরাধীদের এই অন্ধকূপে নিক্ষেপ করা হতো।
  • কারো মতে, এটি বৈদেশিক আক্রমণকারীদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য একটি দূরবীণ।
  • আবার অনেকের অভিমত, এটি সম্রাট অশোক দ্বারা নির্মিত বৌদ্ধমঠ।

যাহোক, বেহুলা-লক্ষিন্দরের বাসরঘর—একটি জটিল প্রশ্ন নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে রয়েই গেছে! গবেষকদের মতে, এই বাসরঘর বা মেধ বা মেড়-এর উচ্চতা অধিক ছিল এবং সময়ের বিবর্তনে তা ধ্বসে গিয়েছে।

১৯৩৪-৩৬ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন এই বাসরঘরটি সংস্কার করেন, তখন এর প্রতিটি কক্ষ থেকে আলগা ইট এবং মাটি অপসারণ করেন এবং বামপাশে একটি কক্ষে শিমুল ও বরই গাছ ছিল—যা সংস্কারের সময় কেটে ফেলা হয়।

সংস্কারের সময় এই চৌবাচ্চাসদৃশ্য স্নানাগারের তলদেশ থেকে ইট-বালুর সঙ্গে একটি নরকঙ্কাল পাওয়া যায়। প্রত্নতত্ব বিভাগের মতে, এটি কোনো বৌদ্ধ সন্ন্যসীর কঙ্কাল হতে পারে।

এই কক্ষের কূপের তলদেশ থেকে ১৩টি গর্ত বিশিষ্ট একটি পাথরখণ্ড পাওয়া যায় এবং এই পাথরখণ্ডের মধ্যে উপবিষ্ট ষাঁড়ের প্রতিকৃতি খোদিত একটি স্বর্ণনির্মিত পাত্র পাওয়া যায়। ষাঁড়ের প্রতিকৃতি খোদিত পাথরখণ্ড পাওয়াতে মনে করা হয়, এটি শিবমন্দির; এখানে শিবপূজা করা হতো।

স্মর্তব্য, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দির পর অর্থাৎ সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে এশিয়া মহাদেশে বৌদ্ধধর্ম এমনভাবে বিস্তার লাভ করে—এই কিংবদন্তির বাসরঘর সদৃশ্য বার্মা ও জাপানের বহুস্থানে বৌদ্ধমঠ স্থাপন করা হয়েছিল। পাহাড়পুরেও এইরকম মঠ দেখা যায়।

বাসরঘর খননের মতো মনসা দেবীর বাসস্থান খননকালেও, একটি পাথরের এবং অনেকগুলি ইটের তৈরি মনসামূর্তি পাওয়া যায়। পাথরের মনসামূর্তিতে আটটি সাপ এবং ইটের মনসামূর্তিতে একটি করে সাপ দেবীর মাথার ওপরে ফনা বিস্তার অবস্থায় আছে। কথিত আছে, মনসা দেবীর আটটি সর্পসন্তান ছিল।

বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনী সেনযুগের আগেকার ঘটনা। বাসরঘর মনসা বা পদ্মাদেবীর নির্দয়তার একটি করুণতম উপখ্যান। এই উপাখ্যান মানুষের মনে যুগ যুগ ধরে এমনভাবে গেঁথে আছে, এখনো রাতের শেষপ্রহরে এখানে এসে দাঁড়ালে বাতাসে বেহুলার করুণ স্বরের বিলাপ শুনতে পাওয়া যায় বলেই মনে করা হয়!

বেহুলা-লক্ষিন্দরের জীবনে কী ঘটেছিল, তা জানতে সেই ঘটনা বা উপাখ্যানের ভেতর প্রবেশ করতে হবে। এই উপখ্যান বলতে গেলে দেবতা আর মানুষের লড়াই! এখানে আছেন দেবী মনসা, আছেন আরো দেবতাগণ, আছেন চাঁদ সওদাগর, সনোকা, চাঁদ সওদাগরের পুত্র লক্ষিন্দর, বেহুলা এবং আরো কিছু পরিচিত-অপরিচিত জনেরা!

বেহুলা-লক্ষিন্দরের সংক্ষিপ্ত কাহিনী

লক্ষিন্দরের পিতার নাম চাঁদ সওদাগর এবং মায়ের নাম সনোকা। মহাস্থানগড় থেকে প্রায় তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং বাসরঘর থেকে প্রায় দেড় মাইল পশ্চিমে চম্পা নগরে বাস করতেন। চাঁদ সওদাগরের সাত পুত্র : ত্রিলোচন, দিগম্বর, হরিহর, কৃষ্ণাদাস, বিষ্ণুদাস, গুণ্যকর এবং লক্ষিন্দর। সওদাগর ছিলেন শিবপুজারী। দৃঢ়চিত্তের অধিকারী এবং শিবের পূজা করে ‘হেমতাল’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

হেমতালের এমনি গুণ, যার গন্ধে সাপ কাছে আসে না। হেমতালের গাছ ছোট ছোট পাতা বিশিষ্ট—লম্বায় আখ গাছের মতো, কিন্তু শাল গাছের মতো শক্তপোক্ত।

কথিত আছে, তিনি শুধু ‘হেমতাল’ই পাননি, তিনি ‘মহাজ্ঞান’ শক্তির বর পেয়েছিলেন। এই ‘মহাজ্ঞান’ শক্তির অধিকারী হওয়ার ফলে তিনি সাপে কাটা রোগীকেও ভালো করে দিতে পারতেন। তা ছাড়া তাঁর ওঝা ধন্বন্তরী নামে একজন বন্ধু ছিলেন। 

দেবী মনসার অন্য নাম পদ্মা, তিনি বিষহরী নামেও পরিচিত। এই দেবী বাস করতেন মহাস্থানগড়ের পশ্চিমে কালিদহ সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে। এই দেবী অযোনি সম্ভবা চতুর্ভূজা ও ত্রিনয়নী এবং জন্মেছিলেন কালিদহের পদ্মবনে। তাঁর স্বামীর নাম জগৎকারু মণিরাজ।

এই কালিদহ একটি ঐতিহাসিক দহ বা নদী। মহাভারতে উল্লেখ আছে, যমুনাগর্ভস্থ এই কালিদহে কালিয়নাগের বাসস্থান এবং শ্রীকৃষ্ণ কালিয়নাগের সঙ্গে যুদ্ধ করে বধ করেছিলেন। এটি একটি গভীর নদী এবং এই নদী থেকেই ১০৮টি নীলপদ্ম সংগ্রহ করে সীতা উদ্ধারের জন্য শরৎকালে দেবীদূর্গার পূজার প্রচলন করেছিলেন। যদিও বর্তমানে কালিদহের সে-রূপ আর নেই।

দেবী মনসার জন্ম সম্পর্কে পদ্মাপূরাণে লিখিত আছে, মহাদেব শিব হিমালয়ে উত্তরে অবস্থিত তাঁর বাসস্থান কৈলাসে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কালিদহের তীরে আসন গ্রহণ করেন। সেই সময়ে তাঁর সম্মুখে পার্বতির সৃষ্ট পুষ্পকাননের শোভা ভেসে ওঠে এবং তা দেখে তিনি মুগ্ধ হন, ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী-পার্বতিকে মনে পড়ে এবং বীর্যস্খলন হয়। মহাদেব তা সংরক্ষণের জন্য পদ্মপাতার ওপরে রেখে দেন। কিন্তু একটি পাখি তা খেয়ে ফেলে। পরবর্তী সময়ে ডিম পাড়ে, সেই ডিম পাতালপুরীতে বাসুকিরাজের প্রাসাদে পতিত হয় এবং ডিম থেকে পদ্মার জন্ম হয়।

পদ্মা বাসুকি রাজের ঘরে প্রতিপালিত হন। বাসুকি কন্যা স্নেহ-যত্নে তাঁকে লালনপালন করেন। পদ্মপাতায় জন্ম বলেই তাঁকে পদ্মা নামে অভিহিত করা হয়। আর, বাসুকিরাজ অনন্তের ঘরে প্রতিপালিত বলেই তাঁকে নাগকন্যা বা নাগমাতাও বলা হয়।

পদ্মা দেবী প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে বাসুকিরাজকে তাঁর পিতার কথা জিজ্ঞেস করেন এবং জানতে পারেন তাঁর পিতা মহাদেব। পিতার সাথে দেখা করে তাঁকে বললেন, ‘পিতা, আপনি মহাদেব মানে দেবের দেবতা, জগতপূজ্য। আমি আপনার সন্তান, নাগলোকে জন্ম আমার। যেহেতু নাগলোকে জন্ম আমিও মানুষের পূজা পাওয়ার অধিকার রাখি। তা ছাড়া আমি আপনার সন্তান আর আপনি যদি পূজা পেতে পারেন, তবে আমারও পূজা পাওয়ার অধিকার আছে।’

কন্যার এই কথা শুনে মহাদেব মধুরস্বরে বললেন, ‘তোমার পূজা কেউ করবে না মা। তবে চাঁদ সওদাগর যদি তোমার পূজা করেন, তবে নরলোকে তুমি পূজিত হবে। চাঁদ সওদাগর পূজা না-দিলে কেউ তোমাকে পূজা দিবে না।’ 

এই কথা শোনার পর মনসা এলেন পৃথিবীতে। চাঁদ সওদাগরকে পূজা দেওয়ার কথা বললেন। আরো বললেন, পূজা না-দিলে তুমি নির্বংশ হবে এবং তা করবো আমি। কিন্তু চাঁদ সওদাগর ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি না করে দিলেন এবং হেমতাল-এর লাঠি দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। এমনভাবে মেরেছিলেন যে পদ্মার কোমর ভেঙে গিয়েছিল। পদ্মাদেবী রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে নিজ বাড়িতে ফিরলেন।

কথিত আছে, চাঁদ সওদাগরের ‘হেমতালে’র আঘাতে মনসার কোমর ভেঙেছিল বলেই সাপেরা পুরোটা উঠে দাঁড়াতে পারে না।

এর পর চাঁদ সওদাগর তাঁর ছয় পুত্রকে নিয়ে বাণিজ্যে যান এবং বাণিজ্যশেষে কালিদহ দিয়ে গৃহে ফিরছিলেন। তখন সওদাগরের ছয় পুত্র সাপের কামড়ে মৃত্যবরণ করে এবং পদ্মা মায়াবলে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরীসহ তাঁকেও কালিদহে ডুবিয়ে দেন।

সওদাগর ডুবে গেলেও, কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে ফিরে আসেন। পুত্রশোক এবং ধন-রত্ন হারিয়ে তিনি এত কষ্ট পেলেন, তবুও মনসার পূজা দিবেন না প্রতিজ্ঞা করলেন। সেই সঙ্গে আরো প্রতিজ্ঞা করলেন, দেবীকে এমন শাস্তি দিবেন—যা চিরকাল দেবী ভুলতে না পারে।

স্ত্রীর অনুরোধ-উপরোধ কোনোই কাজে আসল না। তিনি তাঁর স্ত্রী সনোকাকে বুঝালেন, ‘দুঃখ পেয়েছি আমি, তুমিও প্রচুর/ বিধির কৃপায় সব হয়ে যাবে দূর…।’

বেহুলার পিতার নাম মুক্তেশ্বর ওরফে বাসোবানিয়া, মায়ের নাম কমলা। বাসোবানিয়ার ছয় পুত্র ও এক কন্যা। চাঁদ সওদাগরের ধন-জন কিছুই ছিল না বলে বেহুলার পিতা লক্ষিন্দরের সঙ্গে বিয়েতে রাজি ছিলেন না। চাঁদ সওদাগর এই ব্যর্থতার লজ্জায় খুব কষ্ট পেয়ে চলে আসেন।

এদিকে, পদ্মাদেবী স্বপ্নে বেহুলাকে জানালেন লক্ষিন্দরকে বিয়ে করতে। আরো বললেন, লক্ষিন্দরকে বিয়ে করলে তিনি বেহুলার কাছে ধরা দিবেন। বেহুলা তাঁর স্বপ্নের কথা পিতাকে জানালে বিয়েতে রাজি হলেন।

এবারে দেবী মনসা চাঁদ সওদাগরের কাছে এসে জানালেন, ছয় পুত্রকে তো নিয়েছি—এবারে মনসা পূজা না-দিলে বাসরঘরেই একমাত্র পুত্রের মৃত্যু নিশ্চিত। সওদাগর তবুও মনসার পূজা দিবেন না জানিয়ে দিলেন। পূজা না-দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। তিনি বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করলেন এবং বিশ্বকর্মা একজন কর্মাকে পাঠিয়ে দিলেন।

এক রাতের মধ্যে বাসরঘর বানানো হলো। কিন্তু ঐ কর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করলো এবং মনসার কথামতো একটি ছিদ্র রেখে দিলো বাসরঘরের দেয়ালের মেঝের একটি কোণে। চাঁদ সওদাগর শুধু লোহার বাসরঘর বানিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, তিনি বাসরঘরের উপরে ময়ূর, নিচে নেউল এবং অসংখ্য প্রহরী দ্বারা ঐ জায়গাটি নিয়ন্ত্রণ করলেন।

বিয়ের পর বেহুলা-লক্ষিন্দর এখানেই বাসর সাজালেন। বাসররাতে মন্ত্রবলে বেহুলাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন মনসা এবং কালনাগকে পাঠিয়ে মৃত্যু ঘটালেন লক্ষিন্দরের। বাসরঘর থেকে নিজে নিজে বেহুলা বাইরে বের হতে পারে—এমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

ঘুম ভেঙে স্বামীকে মৃত অবস্থায় দেখে তাঁর কান্না ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এর পরে সকলে এসে ওদের বের করে এবং শবসৎকার করতে চায়, তখন বেহুলা লক্ষিন্দরের দেহ কলার ভেলায় ভাসিয়ে ঐ ভেলাতে স্বামীর সঙ্গী সওয়ার হওয়ার জন্য সওদাগরের কাছে প্রার্থনা করে। সওদাগর উভয়কেই সাজিয়ে-গুছিয়ে ভেলায় করে ভাসিয়ে দেয়। ভেলা ভেসে চলে, ভাসতে ভাসতে নেতাই ধোপানির কাছে পৌঁছায়।

নেতাই ধোপানির পিতা হলেন শিব বা মহাদেব। নেতাই ধোপানি ছিলেন একাধারে মনসার বোন এবং উপদেষ্টা। নেতাইয়ের স্বামীর নাম শঙ্খমুনি। তাঁর ধনা নামে একটি ছেলে ছিল। ছেলেটি খুব দুষ্ট। নেতাই তাঁকে কাজের সময় মেরে রেখে দিয়ে পরে আবার বাঁচিয়ে তুলতো।

নেতাই ধোপানি দেবতাদের কাপড় ধুয়ে দিতো। বেহুলার ভেলা যখন ধোপানির ঘাটে থামে, তখন ধোপানিকে তাঁর মৃত ছেলেকে জীবিত করতে দেখে এবং তাঁর কাছে আশ্রয় চায়। নেতাই ধোপানি আশ্রয় দেওয়ার আগে বেহুলার কাছে জানতে চায় সে কে এবং এখানে কী করছে?

বেহুলা কাঁদতে কাঁদতে ধোপানির কাছে তাঁর পরিচয় দিয়ে বলে, ‘ঐ যে আমার ভেলা, ঐ ভেলাতে শুয়ে আছে আমার মৃত স্বামী। বাসররাতে পদ্মাদেবীর কালনাগের দংশনে আমার স্বামী প্রাণ হারিয়েছে। আমার স্বামীকে বাঁচাতে হবে।’

সব ঘটনা শুনে ধোপানি বলল, ‘কালনাগ দংশন করলে সে আর বাঁচে না। কিন্তু তুমি যদি দেবপুরীতে গিয়ে শিবকে নৃত্যে সন্তুষ্ট করতে পার, তবে তোমার স্বামী বাঁচবে।’ বেহুলার সব বৃত্তান্ত শুনে নেতা ধোপানি আশ্রয় দিলো বেহুলাকে।

পরদিন ধোপানি কাপড় ধোয়ার জন্য ঘাটে যাওয়ার সময় বেহুলা তাঁর কাছে দেবতাদের কাপড় ধোয়ার জন্য চাইলে নেতাই বলে, ‘দেবতাদের বসন তো তুমি ধৌত করতে পারবে না। দেববস্ত্র নষ্ট হলে আমি অপমানিত হব।’

বেহুলা অনেক অনুরোধ করে দেববস্ত্র ধুয়ে এনে নেতাইয়ের কাছে দিলে দেবতাদের পছন্দ হলো। শিব ধোয়া কাপড় দেখেই বলল, ‘কে এই বসন ধুয়েছে? ’ নেতাই বেহুলার নাম বলে জানাল, ‘একজন নর্তকী। আমার বাড়িতে নতুন এসেছে, আশ্রয় নিয়েছে।’ নেতাই আরো বলল, ‘সে এই দেবপুরীতে নৃত্য করতে চায়।’

শিব তাঁকে দেবপুরীতে নৃত্য করার অনুমতি দিলো। সকল দেব-দেবীদের রাজসভায় আমন্ত্রণ করা হলো। বেহুলা নেচে সকলকে তুষ্ট করে লক্ষিন্দরের প্রাণ ভিক্ষা চাইল। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর দেবতারা সিদ্ধান্তে এলেন, চাঁদ সওদাগর যদি পদ্মার পূজা না দেয়, তবে সে অপরাধ বেহুলার নয়, লক্ষিন্দরেরও নয়!

তখন স্থির হলো পদ্মাদেবী অর্থাৎ মনসাই যখন লক্ষিন্দরের প্রাণ নিয়েছেন, তখন তিনিই লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিবেন। এই কথা শুনে বেহুলা পদ্মাদেবীকে বললেন, ‘আমি তোমার পূজা দেব, আর আমার শ্বশুরকেও তোমার পূজা দিতে বলব, না দিলে সাধ্য-সাধনা করে বাধ্য করবো।’

লক্ষিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন মনসা। বেহুলা-লক্ষিন্দর বাড়ি ফিরে এলেন। বেহুলা, তাঁর শ্বশুরমশাইকে পূজা দিতে রাজি করালেন। চাঁদ সওদাগর বললেন, ‘আমি পূজা দিব, কিন্তু বাম হাতে পূজা দিব।’ তিনি পূজায় বসলেন এবং বাঁ হাতে পূজা দিতে উদ্যোত হলে মনসাদেবী বলে উঠলেন ‘থাক আমি আমার পূজা পেয়েছি।’

এই হলো বেহুলা লক্ষিন্দরের বাসরঘরের কাহিনী—যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বর্তমানে নরলোকে মনসাপূজা চালু রয়েছে এবং শ্রাবণসংক্রান্তিতে বাম হাতের পরিবর্তে ডান হাতেই মনসাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে স্থানবিশেষে সময়ের ব্যবধান লক্ষ্যণীয়।

বর্ণিত কাহিনী হতে জানা যায়, বেহুলা-লক্ষিন্দর ছিলেন স্বর্গের নর্তক-নর্তকী; তাঁরা হলেন রাজা বাণাসুরের কন্যা ঊষা এবং শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ, অনিরুদ্ধের পিতার নাম কাম। দেবসভায় নাচতে গিয়ে তাল-ভঙ্গের অপরাধে দেবরাজ ইন্দ্রের অভিশাপে মানবরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা মনসাদেবীর পূজা এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই জন্মেছিলেন। তাঁদের কাজ শেষ হয়েছে, তাঁরা চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন—বেদনাবিধুর এক করুণ স্মৃতি এবং ভালোবাসার অমর নিদর্শন।

তাঁরা চলে গেছেন, কিন্তু এই পৃথিবী বহন করছে—তাঁদের অমর স্মৃতি, আর এই পৃথিবীর মানুষ এই স্মৃতির ভেতর ডুবে গিয়ে খুঁজছে এর বিশালতা। বেহুলাকাহিনী সেনযুগের অনেক আগের কাহিনী।

বর্তমান গবেষকদের মতে, বেহুলা-লক্ষিন্দরের বাসরঘর দেবপাল নির্মিত একটি বৌদ্ধমঠ, একটি অকল্পনীয় স্মৃতিস্তম্ভ বা মনুমেন্ট। বেহুলা-লক্ষিন্দরের স্মৃতিবিজড়িত যে করুণকাহিনী, তাতে মনে হয় এখানে হয়তো ছিল বেহুলার বাসরঘর। তা না-হলে এতকাল ধরে পৃথিবীর বাতাসে কেন ভেসে বেড়াচ্ছে বেহুলার দুঃখময় কাহিনী আর কেনই-বা এই ‘গোকুল মেধ’ পরিচিতি পেয়েছে ‘বেহুলার বাসরঘর’ হিসেবে।

তা ছাড়া উল্লেখ্য, চাঁদ সওদাগর ও ওঝা ধন্বন্তরীর বাসভবন—যা মাটির স্তুপে পরিণত হয়েছে, কিন্তু এখনো বিদ্যমান। কথিত আছে, কেউ যদি সাপের তাড়া খেয়ে এই মাটির স্তুপের ওপর ওঠে, তবে সাপ সেখানে ওঠে না। কেউ যদি এখান থেকে মাটি নিয়ে ইঁদুরের গর্তে দেয়, তাহলে সেখানে সাপ আসে না।

এ ছাড়া মনসা দেবীর বাসভবনেরও কিছু অবশিষ্ট নেই, তবুও যারা মানত করে—তাঁরা এখনো সেখানে দুধ কলা দিয়ে আসে। এই বাসভবনের স্তুপে কলাগাছ ছিল, কিন্তু সেই গাছের কলা বিষাক্ত ছিল। কেউ খেতে পারতো না।

আর, মহাস্থান গড়ের একমাইল দক্ষিণে নেতাই ধোপানির ধাপ ছিল, যার নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়ে কাকলিদিঘী, বারাণশী এবং কালিদহকে অবিচ্ছিন্ন রেখেছিল। কিন্তু পুরাকালের স্মৃতি এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।

কাহিনী যাই থাক, বর্তমানে ‘বেহুলার বাসরঘর’ বাংলাদেশের একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।  

তথ্যসূত্র

১. বেহুলার বাসঘরের ইতিহাস : তবিবুর রহমান। প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৯৯

২. বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, গুগল ও অন্তর্জাল

শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে থাকুন...