শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
জ্যোতি পোদ্দার
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
নয়
‘চিত্রশিল্পী ও কবি—এই যুগল সত্তা নিয়ে রণজিত নিয়োগী’র আত্মপ্রকাশ ষাটের দশকে। জন্ম ৭ নভেম্বর ১৯৪২ সালে। বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত বিপ্লবী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সিংহপুরুষ কমরেড রবি নিয়োগী, মা কমরেড জ্যোৎস্না নিয়োগী—নারী মুক্তি আন্দোলনের নেত্রী, মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামের অগ্রসৈনিক।
রণজিত নিয়োগীর সত্তরতম জন্মদিনে প্রকাশিত রবিন পারভেজের ‘রা’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় রবিন আরো লিখেন, ‘যে বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কবি রণজিত নিয়োগীর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, তা থেকেই সৃষ্ট তাঁর কবিতার মন। বাবার কবিতায় যে আহ্বান ছিল—’ তোমাদের কবিতায় গানে আর ছবিতে সাধারণ মানুষের সংগ্রাম আনন্দ-বেদনা ওঠে আসুক।
নিয়োগীর কবিতা সম্পর্কে রবিন বলেন, ‘বিশ্বায়নের কারণে আজ আমাদের সংস্কৃতি যে অস্পষ্ট, জাতিসত্তা বিচ্ছিন্ন, ইতিহাস-ঐতিহ্যহীনতায় দাঁড়াচ্ছে—নিয়োগী তাতে সামিল হতে নারাজ। নিজস্ব রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভিত্তিমূল বিবেচনা করেই বৈশ্বিক হয়ে উঠতে হয়—তাঁর কবিতায় আমরা এমন চেতনারই সাক্ষাত পাই।’
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
ক.
‘আকাশ মহল থেকে ভাসমান স্প্রিংয়ের দোলনায়
লাফাচ্ছে ঝাঁপাচ্ছে তারা
বারবার উড়ছে তারা ইন্দ্রধনু ডানায় আকাশ
আর সর্বশেষ পৌঁছে যায় মহাকাশ উচ্চতায়।
ক্লাউন কিন্নর কণ্ঠ
কনসার্টের ফেনায় ফেনায় উচ্ছ্বসিত আলোর বুদ্বুদ
আউরে যাচ্ছে
মানুষের উন্নতির উজ্জ্বল পরিসংখ্যান
মাটি থেকে আকাশ আর মহাকাশ উচ্চতার
জটিল যোগফল।
(সার্কাস : রণজিত নিয়োগী)
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
ড. সুধাময় দাস লিখেছেন, ‘রণজিত নিয়োগীর অধিকাংশ কবিতাই একটানে পড়া যায় না। একাধিকবার থামতে হয়, ভাবতে হয় এবং ভেবে ভেবে এগুতে হয়। তাঁর কবিতায় মানব ইতিহাসের সমাজের সময় পরম্পরায় বিচিত্র উপাদানের সমাবেশ ঘটে।’১১
রণজিত নিয়োগী ‘মৃৎ’ প্রকাশ করেন ২০০৮ সালে। গোটা চারেক সংখ্যা উদীচী জেলা সংসদের ব্যানারে প্রকাশ পায়। ‘মৃৎ’ শিল্প-সাহিত্যের কাগজ। কবিতারই প্রাধান্য ছিল। প্রচ্ছদ নিজেই করেছেন। শেরপুরে যারা ব্লক বা প্রচ্ছদ করেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।
তাঁর নিজের পত্রিকা বা রবিন পারভেজের ‘রা’ সবগুলো সংখ্যায় তিনি প্রচ্ছদ করেছেন। তাঁর রেখার গতি ও বিন্যাস একটি আলাদা মাত্রা আনে। পাঠকের নজর কাড়ে।
এখানে আরেকটু তথ্য দেয়া যেতে পারে। ১৯৭১ সালে কলকাতায় সংগঠিত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার কর্মকাণ্ডে চিত্রশিল্পী হিসেবে নিয়োগী যুক্ত হন। কবি বিষ্ণু দে সম্পাদিত ‘বাংলদেশের কবিতাগুচ্ছ’ সংকলনের প্রচ্ছদ অঙ্কন করেন রণজিত নিয়োগী। ‘মৃৎ’-এ লিখেছেন—সুহৃদ জাহাঙ্গীর, রবিন পারভেজ, প্রাঞ্জল সাংমা, সুমন দাস প্রমুখ।
‘মৃৎ’-এ প্রকাশিত কয়েকটি কবিতা তুলে দিচ্ছি :
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
ক.
…তবুও
বুকের দীর্ঘশ্বাস ছোট নয়
সংখ্যালঘু মন জানে দীঘল দীর্ঘশ্বাসের জ্বালা
আমার ভেতরে এসো
উপজাতের কষ্ট দেখাই
বুকটা ছিঁড়ে দেখো
জাত বেজাতের রক্ত দানায়
আমিও যে গাই বন্ধু
সোনার বাংলা গান।
(হৃদয়ের গান : প্রাঞ্জল সাংমা)
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
খ.
চোখের সমুদ্রে মিশেছে ব্রহ্মপুত্রের
সমস্ত জল।
জল ঝড়ে, জোয়ার আসে;
বালুময় তীরে শামুকের মতো
নিস্পৃহ পড়ে থাকে
আমার বন্ধকী স্বপ্নের টিপসই।
(সমুদ্র বিলাস : কোহিনুর রুমা)
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
গ.
বিশ্বাস করো কিনা জানি নে
একদিন আমার এ বুকেও
তরতর করে বইতো উজানের নাও
ভাঙতো শহর-বন্দর-গাঁও।
(আমার এ বুকেও : লুল আবদুর রহমান)
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
ঘ.
আমাকে বাধা দিও না
আমি যাবো,
লাল ইটের সিঁড়ি মাড়িয়ে
ওই ফুলের সমাধিতে,
দেখব অশ্রু জমে জমে সাদা হয়ে গেছে
ফুলের শরীর।
(বাধা দিও না, আমি যাবো : আরিফ হাসান)
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
নিয়োগী তাঁর কাগজে কবি ও কবিতা নির্বাচনে একদিকে যেমন লেখার শিল্পের দিকে নজর দিতেন, তেমনি লেখকের রাজনৈতিক মতাদর্শের কী—সেই দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। রনজিত নিয়োগী তুলি ও কলম নিয়ে চিন্তার ‘কার্তুজ’ হৃদয়ে প্রথিত করে ঠিক ঠিক নিশানায় তাক করে রেখেছেন আধিপত্যবাদবিরোধী এক সমাজ বাস্তবতার অশ্রুত স্বাপ্নিক কার্যক্রম।
জাত-পাত শ্রেণি বিভেদ বিরোধীতার মনোভূমি নিয়োগীর এক অনিবার্য বৈপ্লবিক উত্তরাধীকার। যে বৈপ্লবিক পরিসরে কবি রণজিত নিয়োগীর বেড়ে ওঠা; সেই প্রাতিবেশিক বলয়ে উত্তর উপনিবেশিক সময়ে আধিপত্যবাদবিরোধী হওয়া ছাড়া অন্যকোনো পথ নেই; বরং এক অনিবার্য অনুশীলন।
এই কার্যক্রমে নিয়োগী সতত হাজির ছিলেন। ‘মৃৎ’-এ প্রকাশিত প্রাঞ্জল সাংমার কবিতায় তাঁর প্রাতিবেশিক জগৎ যেমন ওঠে এসেছে, তেমনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক যাপনের সুর ও স্বর জেগে উঠেছে।
তবে মিঠুন রাকসাম প্রাঞ্জল সাংমার চেয়ে আরো ভেতরের অনুভূতিমালা তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। মিঠুন ঝিনাইগাতীর, প্রাঞ্জল শ্রীবর্দীর। দু’জনেই একই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থেকে উঠে এসেছে। যদিও শেরপুরের কাগজে মিঠুন রাকসামের কবিতা খুব একটা প্রকাশিত হয়নি।
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
ক.
‘তখনও কি মান্দি নারী কাঠগড়ায়
চেঁচিয়ে বলছে, ‘বাবু ও দলিল জাল…’
শুনতে পাই ট্রাকটরের শব্দ
মুখে পান গুঁজে ব্যাটা গান গাইছে
তাহলে কি সবই অসাড়?
মুছে যাবে এসিড পাতার ন্ম?
কিংবা ‘পিরেন পিরেন?’
পাহাড়ি মাটির মত ক্ষয়ে যাবে দলিল?
(দলিলে ভাটপাড়া গ্রাম : মিঠুন রাকসাম)
‘ব্রিংনি বিবাল’-এ প্রকাশিত মিঠুনের কবিতা। প্রকাশ ২০০৯।
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
খ.
‘বৃদ্ধ নানীর সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি না।
নানী বাংলা জানে কম
আমি মান্দি জানি কম
মুখোমুখি বসে থাকি—বোবা হয়ে যাই।
শালার নিজের ভাষাটাও ভুলে গেলাম।
(গন্ধচোর : মিঠুন রাকসাম)
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব
প্রাঞ্জল সাংমা, মিঠুন রাকসামদের আধিপত্যের চাপ ও তাপের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। তাদের কবিতায় এখন ক্রমেই উঠে আসছে প্রান্তজনদের কেন্দ্রীয় সুর।
(চলবে)
…………………
পড়ুন
কবিতা
রাংটিয়া সিরিজ : জ্যোতি পোদ্দার
প্রবন্ধ-গবেষণা
টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী
১ম পর্ব । ২য় পর্ব । ৩য় পর্ব । ৪র্থ পর্ব । ৫ম পর্ব । ৬ষ্ঠ পর্ব । ৭ম পর্ব । ৮ম পর্ব । ৯ম পর্ব । ১০ পর্ব । ১১তম পর্ব
12 thoughts on “শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ১১তম পর্ব”