শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২১তম পর্ব
জ্যোতি পোদ্দার
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২১তম পর্ব
বিশ
কমল চক্রবর্তী দীর্ঘদিন যুক্ত আছেন কবিতা ও প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে। ছিলেন উদীচী শেরপুর জেলা শাখার সভাপতি। উদীচীর ব্যানারে তাঁর রচিত নাটক ‘একাত্তুরে একদিন’, ‘প্রতিবাদ’ ইত্যাদি মঞ্চায়ন হয়।
সত্তর দশকের শেষের দিকে গঠন করলেন, ‘সুকান্ত সাহিত্য অঙ্গন’। দুয়েকটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হলেও, বিস্তার ঘটেনি। স্থানিকে সাহিত্য পরিষদ গঠন ও মৃত্যু একটি স্বাভাবিক নিয়তি। কিছুদিন পরই উদ্যোম হারিয়ে যায়।
কমল চক্রবর্তী সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকেই কবিতা অঙ্গনে সরব হতে দেখা যায়। পরে যুক্ত হন ‘মানুষ থেকে মানুষে’। এই কাগজে বিজন কর্মকারের পাশাপাশি কাঠ খোদাই প্রচ্ছদ করেছেন কমল চক্রবর্তী।
.
ক.
খোকামণি খুকুমণি থাকো চুপচাপ
সত্য কথা বলো যদি হবে এখন পাপ।
মিথ্যা কথা বলা যাবে—পাবে অনেক টাকা
রঙ বেরঙের গাড়ি চড়ে ঘুরবে শুধু ঢাকা।
(যুগ স্বরূপ : কমল চক্রবর্তী)
খ.
অদৃশ্য হাতে সৃষ্টি করে চলেছে
ঠিকানা বিহীনের জীবন যন্ত্রণা।
(প্রিয়তমা বর্তমান : কমল চক্রবর্তী)
গ.
পুরানো পাণ্ডুলিপিগুলোয়
তেল পোকার বাসা
যেন যৌবন হারা কুমারীর স্তন
(ইদানীং : কমল চক্রবর্তী)
.
কমলের সাথে আলাপচারিতায় তাঁর সময়ের কথা জানতে চাইলে লিখলেন, ‘স্মৃতি রোমন্থনে অতৃপ্তির দগ্ধতার ক্ষরণ শুধুই কষ্টের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেয়।’ কমল চক্রবর্তী এখনো বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত রাখলেও, কবিতা থেকে সরে গেছেন।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে নারীদের কবিতা বিভিন্ন স্মরণিকায় প্রকাশিত হতে দেখা গেলেও, হিরন্ময়ী চৌধুরীই অগ্রপথিক। তিনি ১৯২১ সালে প্রকাশ করেন তাঁর কবিতার বই ‘পুষ্পাধার’।
বইটির ভূমিকা লেখেন আড়াই আনীর জমিদার শ্রী গোপাল দাস চৌধুরী। ‘…‘পুষ্পাধার’ সাধারণের মধ্যে প্রচারের জন্য প্রকাশিত হইল না; কেবল আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যেই বিতরণের জন্য।’২৫
.
‘এ মধুর হাসি তুই পাইলি কোথায়?
টুকটুকে রাঙ্গা ঠোঁটে
আহা মরি ফুটে উঠে
আঁধার গৃহেতে যেন আলোকের ভায়।
মেঘ শেষে নীলাকাশে
চাঁদ যেন উঠে হেসে
নিরমল রূপ ছটা করি বিতরণ;
পূরব গগন গায়
উষা যেন হেসে যায়।
(পুষ্পাধার : হিরন্ময়ী চৌধুরী)২৫
.
বইটি আমি হাতে পাইনি। শেরপুর মহাবিদ্যালয়ের ১৯৬৭-৬৮ সালের বার্ষিকীতে তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রভাষক মুহাম্মদ আব্দুর রসিদ খাঁন পুষ্পাধার নিয়ে রিভিউ করেন।২৫
তিনি লিখেছেন, ‘এই মহিলার কাব্যনবিশীর আরম্ভ ও পরিসমাপ্তি ‘পুষ্পাধারে’ সীমাবদ্ধ। হয় প্রকাশনা শৈথিল্যে অথবা কাব্যালোচনার পরিবেশ অভাবে আরো কবিতা ফুলদানির বাইরে অজ্ঞাতে ঝরে গেল কিংবা কলিমুখ ফুটতে পায়নি। কিন্তু এই সংকলনে যথেষ্ট শক্তির পরিচয় স্বাক্ষরিত।’২৫
‘হিরন্ময়ী দেবী নিজের চেষ্টায় বাঙলা সাহিত্য নিপুণতা অর্জন করেছিলেন।’ লিখেছেন গোপা হেমাঙ্গী রায় চৌধুরী, ‘তত্ত্ববোধনী’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতো।৭
হিরন্ময়ী দেবীর পর ষাটের দশকের শেষে নারীদের উপস্থিতি পাই। কবি শাহজাদী আর্জুমান, শাহেদা বেগম রুনুকে পাই সত্তর দশকে কলেজ বা ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন স্মরণিকায়। আশির দশক থেকে নারী সাহিত্যকর্মীর উপস্থিতির উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। রোজিনা তাসমীন, বিভা সরকার, ক্ষমা চক্রবর্তী, এমেলী পারভেজ, সানজিদা মনিকা, মনিকা চক্রবর্তী, রত্না চক্রবর্তী, তৌহিদা বেগম, শুক্লা সরকার, শামীমা আখতার শিউলি প্রমুখ।
নারী সাহিত্য কর্মীদের মাঝে বিভা সরকার, রোজিনা তাসমীন, এমেলী পারভেজ আর ক্ষমা চক্রবর্তী ‘মানুষ থেকে মানুষে’ প্রকাশিত তাদের কবিতা কিংবা ছড়ায় নিজস্বতা অর্জনের চেষ্টা লক্ষণীয়।
আসুন দেখি নেই চার নারীর ভাষাবিশ্ব।
.
ক.
শিকারী মাছ রাঙার মতো
নিভাঁজ চোখ মেলে
বসে আছি।
বুকে অতৃপ্ত তৃষ্ণা—
ছোঁব না কিছুই আমি।
(শুধু তুলে নেবো : রোজিনা তাসমীন)
.
ঝকঝকে সব আলো
তুলে নেবো মুঠোয়
তারপর—
বুনে দেবো সব—নরম মাটিতে
সবুজ কোমল দূর্বা হবে।
(স্বপ্ন প্রেম বিশ্বাস : রোজিনা তাসমীন)
.
খ.
ভালোবাসা চাই না—একথা কোনোদিন বলবো না।
সূর্য প্রতিদিন রাঙা হয়ে পূর্ব দিগন্তে
আভা ছড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত রাজ পুরুষ হয়ে আসে।
ভালোবাসা হবে স্বচ্ছ দেয়াল
যেখানে কেউ কোনোদিন একটিও
পোস্টার লাগায়নি
(ভালোবাসা কেমন : বিভা সরকার)
.
গ.
টুঙ্গি পাড়ার মুঙ্গি বাবু
গান গাইতেন ভালো।
ঠোঁটগুলো তাঁর কেঁচোর মতো
দাঁতগুলো তার কালো।
দাঁত চিবিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে
খেয়াল গাইতেন হা—হা
কেউ-বা কানে আঙুল দিতেন
কেউ বলতেন আ—হা
(মুঙ্গি বাবু : ক্ষমা চক্রবর্তী)
.
ঘ.
বোকা মানুষের মনে তুমি
চিরস্থায়ী বাসা বেঁধেছো
তোমার নিচ্ছিদ্র অবরোধ থেকে
মুক্তির পথ নেই
(আশা : এমেলী পারভেজ)
.
তোমার চুলের ভীড়ে
আমার পাঁচ আঙুলের খেলাটা স্মরণ করো
সেইটি আমার গল্পের প্লট
(প্লট উপহার : এমেলী পারভেজ)
.
রোজিনা তাসমীন এখনো কবিতাতেই আছেন। আছেন টাউন শেরপুরে বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় মুখরিত। বিভা সরকার গেরস্থালিতে। নব্বইয়ের পর তাঁর কবিতা আর কোনো কাগজে দেখিনি। একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন শুনেছি। বিভা সরকার ও রোজিনা তাসমিন—এই দুই কবিই তাদের কবিতায় আটের দশকে ছিল উচ্চকিত স্থানিক অন্য যে কোনো নারী সাহিত্যকর্মীর তুলনায়। আর ক্ষমা চক্রবর্তী এখন সবকিছু থেকে দূরে। একাকী নীরবতার জীবন বেছে নিলেন।
রোজিনা তাসমিন রিখেছেন, ‘আমাদের ক্ষমাদি খুব গোছানো পরিপাটি—ঘরটাও যেমন রাখতো নিজেও থাকতো। খুবই ধার্মিক ছিল। সন্ধ্যায় বাসায় গেলে তাকে পুঁজার ঘরে পাওয়া যেতো। এক পেচে শাড়ী পড়ে, পিঠে লম্বা চুল ছেড়ে ওনি পুঁজায় নিমগ্ন থাকতেন। খুব ভালো লাগতো। ফুল খুব ভালোবাসতেন। তার একটা সখের বাগান ছিল। প্রতিদিন ভোরে উঠে বাগানের আগাছা, ময়লা, ঝরে পড়া পাতা পরিষ্কার করতেন। সকালে তাজা ফুল ফুলদানীতে রাখতেন।
ক্ষমাদি সাপ্তাহিক দশ কাহনিয়ায় একসময় নিয়মিত লিখতেন। ক্ষমাদি ঢাবি থেকে বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। শামসুন্নহার হলে থাকতেন। পরবর্তী সময়ে ঝিনাইগাতী কলেজের টিচার ছিলেন। দীর্ঘদিন বাসে যাতায়াত করতে করতে হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে অসুস্থতা বাড়তে থাকে। এখন খুবই গুরুতর অবস্থা। একেবারেই শয্যাশায়ী।
উনার বড়বোন দীর্ঘ ছয় বছর যাবৎ উনার দেখাশোনা এবং সেবা করছেন। সে আমাদের মিনুদি। উনিও খুব ভালো মানুষ। মিনুদি না-থাকলে যে কি হতো! যার কেউ নেই, তার আল্লাহ আছেন। আল্লাহই সব ব্যবস্থা করে দেন।
ক্ষমাদির বিয়ে হয়নি। সারাজীবন একা। ইচ্ছে করে বিয়ে করেননি তা না। উনার রুচিবোধ আর গোত্রবোধ ছিল প্রখর। বর মেলাতে মেলাতে একসময় বয়স বেড়ে গেছে, তার পর আর বরই মেলানো যায়নি। আর সে কারণেই তিনি একা হয়েই রইলেন আজীবন।
আজকের ক্ষমাদিকে দেখে কেউ মানতেই হয়তো চাইবেন না—এই ক্ষমাদি সেই ক্ষমাদি। দিদি আজ কোনো কথা বলেন না। নাম ধরে ডাকলে শুধু হু বলেন। কোনো বোধ-বুদ্ধি নেই। আমাকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলেন। কখন যে নিজের অজান্তেই তার চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে নিজেও হয়তো জানেন না।’২৬
কবি তপন চক্রবর্তী ওরফে ক্যামালিয়া সন্ন্যাল, নাট্যকার বিজন চক্রবর্তী ও বাচিকশিল্পী-ছড়াকার ক্ষমা চক্রবর্তী সম্পর্কে ভাই বোন। পিতা চিত্ত রঞ্জন চক্রবর্তী। টাউন শেরপুরে নাটক কবিতা সঙ্গীত নিয়ে এই পরিবারটি জড়িয়ে-ছড়িয়ে ছিলেন দীর্ঘদিন। পৈতৃকভূমি বাগরাসা। এই স্থানেই ছিল চন্দ্রকান্তের বিখ্যাত চতুষ্পাঠী। চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার এই চক্রবর্তী পরিবারের জ্ঞাতজন।
(চলবে)
…………………
পড়ুন
কবিতা
রাংটিয়া সিরিজ : জ্যোতি পোদ্দার
প্রবন্ধ-গবেষণা
টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী
১ম পর্ব । ২য় পর্ব । ৩য় পর্ব । ৪র্থ পর্ব । ৫ম পর্ব । ৬ষ্ঠ পর্ব । ৭ম পর্ব । ৮ম পর্ব । ৯ম পর্ব । ১০ পর্ব । ১১তম পর্ব । ১২তম পর্ব । ১৩তম পর্ব । ১৪তম পর্ব । ১৫তম পর্ব । ১৬তম পর্ব । ১৭তম পর্ব । ১৮তম পর্ব । ১৯তম পর্ব । ২০তম পর্ব । ২১তম পর্ব
8 thoughts on “শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২১তম পর্ব”