শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৩৭তম পর্ব (শেষ পর্ব)
জ্যোতি পোদ্দার
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৩৭তম পর্ব
সাইত্রিশ
‘গুণগত মান বিচার্য নয় বরং প্রকাশনাই মুখ্য।’ শেরপুর সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ‘বার্ষিকী ৯০’-এ শুভেচ্ছা বাণীতে লিখেছেন অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নান। স্থানিক পর্যায়ে যে সকল পত্রিকা ম্যাগাজিন স্মরণিকা বের হয়, তার পেছনে মূলত এ-কথাই জারি থাকে। এখানেই প্রকাশিত হয় তরুণের ভাব-উচ্ছাস। সাহিত্য করবার হাতেখড়ি।
আরো বিশদে বলতে গেলে ভাবী কালের কবি-লেখকদের আঁতুরঘর। হোক সে পাড়ার ক্লাবের ভাঁজপত্র কিংবা স্কুল-কলেজের ম্যাগাজিন। তরুণ শিক্ষার্থী যেমন, তেমনি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কবিতা, গল্প, নিবন্ধ বা উপদেশমূলক লেখাপত্র প্রকাশের পরিসর। কালো অক্ষরে ঝকঝকে কাগজে নিজের নামটি দেখা বা দেখাবার স্পেসে যে লাজুকতা মনের গহীনে কাজ করে—যা শুধু অনুভবই করা যায়, প্রকাশ করা যায় না ভাষায়।
বার্ষিকী’৯০ মূলত আজাহার আলী – ফজলুর রহমান তারা পরিষদের কর্মতৎপরতার কলেজ ম্যাগাজিন। সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন মো. আবদুল বারী। প্রচ্ছদ : ধ্রব এষ। এই ধ্রব এষ পরবর্তীকালে দেশের নামকরা প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি ছোটদের গল্প, কবিতা, ছড়া লিখেও নাম কুড়িয়েছেন।
এই সংখ্যায় লিখেছেন—অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী। তিনি রাষ্টবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। এই সময়ে যে কয়টি বার্ষিকী বের হয়েছে, সবগুলোতেই তার লেখা ছিল। ‘ভাষা আন্দোলন ও ছাত্র সমাজ’ তার মধ্য অন্যতম। লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও শেরপুর’ নিয়ে সৈয়দ আবদুল হান্নান।
আরো গোটা বিশেক শিক্ষার্থীর কবিতা গল্পের সমহার। তরুণ শিক্ষার্থী রফিক মজীদ লিখেছেন—
.
যদি প্রকৃতি ধ্বসে যায়
তাতেও কোনো দুঃখ নেই, ভয় নেই
কারণ ধ্বংসই সৃষ্টির প্রসব বেদনা।
(নতুন প্রকৃতি)
.
১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত শেরপুর কলেজের ২৭ বছর ব্যাপ্তিকালের মধ্যে বার্ষিকী/৯০ ছিল পঞ্চম কলেজ বার্ষিকী। সাধারণ সম্পাদক লিখেছেন ‘এটা অবশ্যই সুখকর নয়।’ শিক্ষাবর্ষ ৬৬-৬৭ ও ৬৭-৬৮ এই দুই শিক্ষাবর্ষ মিলে যুগ্ম সংখ্যা প্রকাশিত হয় মো. আব্দুস সুলতান ও মো. রেজাউল করিমের প্রযত্নে। এটিই শেরপুর মহাবিদ্যালয়ের প্রথম সংখ্যা। কে জি মুস্তফার প্রচ্ছদে জামালপুরের সমবায় প্রেস থেকে মুদ্রণ করা হয়। কলেজের এই বার্ষিকীটি সব দিক থেকে সমৃদ্ধ।
কেতাব উদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, ‘সত্য সীমাহীন। তাই তার প্রকাশের শেষ নেই। সত্য, ভাব, ভাষা—এই তিনের মধ্যে রয়েছে চির ব্যবধান। সত্যের সম্যক অনুধাবন সম্ভব নয়, যে টুকু ভাবা যায়, তারও সঠিক ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব। ভাবকে ভাষার তুলি দিয়ে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলার নামই সাহিত্য।
এখানে একটা তথ্য যোগ করা যেতে পারে। ৬৫-৬৬ শিক্ষাবর্ষের ভিপি ছিলেন মো. সামছুল হক, আর ’৬৬-৬৭ সালের ভিপি ছিলেন মোহাম্মদ আলী। মো. আখতারুজ্জামানের সম্পদনায় শিক্ষাবর্ষ ১৯৬৯-৭০ সালে ছাত্র সংসদের পক্ষে এই বার্ষিকীটি প্রকাশিত হয়।
অধ্যক্ষ কেতাব উদ্দিন আহমেদ স্মরণিকার ভূমিকায় লিখেছেন, ‘কিশোর-কিশোরীদের অন্তর মাঝে ঘুমন্ত রয়েছে সাহিত্য প্রতিভার বিরাট সম্ভবনা। বার্ষিকীর মাধ্যমেই সম্ভব তার ক্রমবিকাশ।’
এই জন্য লিখলাম যে তৎকালীন ছাত্র সংসদের নেতার কাজের নজির হিসেবে এই তথ্যটুকু আপনাদের ভালো লাগবে। এ সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন—সংগ্রাম চক্রবর্তী, উদয় শংকর রতন, অনিল দাম।
‘বেকুব’ ছদ্মনামে আখতারুজ্জান লিখেছেন চমৎকার একটি গল্প। আরো লিখেছেন—নারায়ন চন্দ্র হোড়, দিপ্তী রানী সাহা। প্রভষক নূর মোহাম্মদ লিখেছেন, ‘অর্থনৈতিক বৈষম্যেরর শিকার পূর্ব পাকিস্তান’। অধ্যাপক রেজাউল করিম লিখেছেন ‘আপেক্ষিক তত্ত্ব’ নিয়ে মনোজ্ঞ একটি প্রবন্ধ।
স্বাধীনার পর ১৯৭২ সালে বের হয় তৃতীয় সংখ্যা। শিক্ষানবর্ষ ১৯৭০-৭১। সম্পাদক ছিলেন মো. রেজাউল করিম। সহ-সম্পদাক মো. মতিউল আজিজ। মো. মনিরোজ জাহিদের সাগর রহস্য, দুলাল দে বিপ্লব লিখছেন ‘সুকান্ত : শ্রেণী সংগ্রামের কবি’, নিত্যলাল বণিক লিখেছেন ‘নজরুলের দৃষ্টিতে নারী সমাজ’। গল্প, কবিতা, রম্যরচনা দিয়ে সাজানো এই স্মরণিকা।
তবে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ ১৯৯০-১৯৯১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সংসদ নিবার্চনের পর পরই আরেকটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় সাহিত্য সম্পাদক খন্দকার ইকবাল হাসান বাসুর প্রযত্নে। এই বার্ষিকী নামটি বেশ চমৎকার। ‘প্রপর্ণ’। মানে গাছের ঝরা পাতা। কোথায় যেন পড়েছিলাম—
.
‘শাখে শাখে প্রপর্ণ যত ওরে
উড়ে যাবে কালবৈশাখী ঝড়ে’
.
সে যাই হোক, এটি ছিল শহীদ-মিনাল পরিষদের একটি কলেজ প্রকাশনা। সহ-সভাপতি শহীদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘সাহিত্য মানবতার গান গায়। সাহিত্য চিন্তাই আত্মার চিন্তা স্বরূপ… প্রকৃত সাহিত্যকর্ম সত্য ও সুন্দরের সন্ধান দেয়। কলেজ বার্ষিকীতে প্রতিফলিত হয় শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি ও তাদের সৃজনশীল চিন্তা ধারার পরিব্যাপ্তি।’
এই সংখ্যাও পেলাম একঝাঁক শিক্ষার্থীর আবেগ ভালোবাসার উচ্ছ্বসিত শব্দমালা। ইকবাল হাসান রাসু লিখলেন—
.
দুকুল ছাপান জোয়ার তুমি
আমি উষর বালুচর।
কবে ফের আসিবে তুমি
আমার বুকে দিয়ে ভর।।
(কিছু স্বপ্নের স্থির চিত্র)
.
১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষে বের হয় সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদের ম্যাগাজিন। কোনো নামকরণ নেই। ফটো সাংবাদিক নীতিশ রায়ের অলঙ্করণে। ১৯৭২ সালের ২৭ জুলাই কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এই বছরেই অর্থাৎ ১৯৯১ সালের ১৪ আগষ্ট প্রথমবারের মতো ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে শম্পা-শিখা-মনোয়ারা পরিষদ নির্বাচিত হয়।
এই পরিষদের সাহিত্য সম্পাদিকা শামছুন নাহারের প্রযত্নে প্রকাশিত হয় এই কলেজ ম্যাগাজিন। সম্পাদিকা লিখেছেন, ‘নিজের মনের ভাবকে অন্যের মনে সঞ্চারিত করে দেয়ার বাসনা মানুষের চিরন্তন। আর সাহিত্যের মাধ্যমেই তা সম্ভব হয় অত্যন্ত সুন্দরভাবে। যুগ ও কালের শত রূপান্তর পরিবর্তনের মধ্যে সাহিত্য বেঁচে থাকে চির অম্লান হয়ে।’
অধ্যক্ষ সৈয়দ আহসান আলী লিখেছেন, ‘বার্ষিকীতে প্রকাশিত লেখাগুলো হোক না তা কাঁচা হাতের লেখা, এর ভবিষ্যত সম্ভাবনাময়।’ স্থানিক সাহিত্যচর্চার মাঠ মূলত প্রাথমিকভাবে এই জমিনে দাঁড়িয়ে থেকেই বীজ ছড়ায়। জমিন প্রস্তুত হয়। একদিন হয়তো এই মাটিতেই জন্মে কালের যাত্রার নায়ক।
এই সংখ্যাতে সিংহভাগ জায়গাজুড়ে রয়েছে শিক্ষকদের লেখাপত্র। বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাইরে এই জনপদের গারো হাজং-এর যাপনচিত্র এঁকেছেন সৈয়দ আহসান আলী তার ‘তোমরা আমাদের লোক’ নিবন্ধে। সুধাময় দাসের ‘প্রসঙ্গ বাইশে শ্রাবণ’। মো. ফজলুল হক লিখেছেন, ‘বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও সমর নায়ক মহানবী (সা.)।’
ইকোলজিক্যাল চিন্তার আলোকে বেগম মেহেরুন নেসা ‘একটি ভাবসাম্যময় পৃথিবী’ প্রবন্ধে ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত পরিবেশ সন্মেলনের থিম ‘মানুষে মানুষে বর্ণবৈষম্য বজায় রেখে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব নয়’—বিষয়কে সামনে রেখে পরিবেশ সচেতনামূলক একটি সমৃদ্ধ আলোচনা।’
হাল আমলে পরিবেশ আন্দোলন বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে দিন দিন বেগবান হচ্ছে। জীববিদ্যা বিভাগের প্রদর্শক মো. কর্নেল আরিফ বিভিন্ন গাছের গুণাগুণ নিয়ে লিখেছেন ‘উপকারী বন্ধু : গাছ’।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে স্কুল ম্যাগাজিনের সংখ্যা হাতে গোনা। স্বাধীনতা উত্তর শেরপুরে এমপিওভুক্ত স্কুলের সংখ্যা যেমন, তেমনি ব্যক্তি মালিকানাধীন স্কুল-কলেজের সংখ্যা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। বেড়েছে সচেতনতা। সদরে রয়েছে শতাধিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-কিন্ডারগার্টেন-এগ্রিকালচার ইনস্টিটিউট। সহশিক্ষা কার্যক্রমের অনুষঙ্গ হিসেবে স্কুলবার্ষিকী তেমন বাড়েনি।
শিক্ষার্থীরা সুকুমারবৃত্তি চর্চা করার কোনো চাতালই পাচ্ছে না। বুদ্ধির বিকাশ হচ্ছে না। যদিও শিক্ষাবর্ষের নির্ধারিত ফি ঠিকই গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। যদিও ডিবেট সোসাইটি-সহ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার ব্যানারে তর্ক-বিতর্ক যুদ্ধে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আগের তুলনায় বেড়েছে। হোক সে বিতার্কিক বা শ্রোতা। সমসাময়িক নানা বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপনা ও খণ্ডনের মেধা মনন লক্ষ্যণীয়।
স্কুলভিত্তিক যে কোনো চর্চা শিক্ষার্থীর পরবর্তী জীবনের ভিত রচনা করে। হোক সে বিতর্ক সাহিত্য চর্চা, রেড ক্রিসেন্ট গার্লস গাইড ক্রীড়া, কিংবা স্কুলভিত্তিক শিক্ষার্থীদের ভোটে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার গণতান্ত্রিক চর্চা।
প্রাথমিক স্কুল থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীই চিনে জানে প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার, নির্বাচন কমিশনার কে, কী তাদের কাজের ধরন-ধারণ। এখন প্রয়োজন গুণগত চর্চার দিকে মনোনিবেশ করা।
এখানকার বালিকা বিদ্যালয়টি ১৯৪৯ সালে কায়েদ আযম মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয় নামে একটি মক্তব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।১৮ পণ্ডিত ফছিহুর রহমান ‘শেরপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিকথা’ নিবন্ধে লিখেছেন, স্বাধীনতা পর স্কুলের নতুন নামকরণ হয় সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
বিদ্যালয়ের বার্ষিকী সংখ্যা গোটা দশেক হলেও, সবগুলো হাতে পাইনি। ‘উৎস’ (২০০২), ‘ধারা-খরতর’ (২০১৫), ‘কিশোলয়’ (২০১৮) প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে—জীবন কৃষ্ণ বসু, অপর দুটোতে—সহকারী শিক্ষক এ এস এম আশরাফুল আলম।
‘উৎস’ ম্যাগাজিনে সম্পাদক জীবন কৃষ্ণ বসু লিখেছেন, ‘জীবন যেখানে অন্তহীন সমস্যায় ভারাক্রান্ত এবং দুঃসময় ও সময়াল্পতা যেখানে অনিবার্য অন্তরায়, প্রতিবন্ধী ভাষা সেখানে প্রকাশের প্রতিরুদ্ধ তাড়নায় আর্তনাদ করে। সাধ ছিল, সাধ্য ছিল না। তবু লালন করেছি প্রকাশের উদগ্র বাসনা। অকপটে বলতে পারি বিগত কয়েক বছরের বন্ধ্যাকালে গুমড়েমরা অপ্রকাশিত রোরুদ্যমান ভাবের দীর্ঘশ্বাসের এক মূর্ত প্রতীক হচ্ছে আমাদের এ সীমিত প্রয়াস।’
আসুন শিক্ষার্থীদের কয়েকটি কবিতাংশ পড়ি।
.
ক.
‘কিল্লাই মারস খোঁচা,
খায়া যাবি খায়া যা—
মানা তো করি নাই।
(মশা : ফারজানা ইয়াসমিন)
খ.
চোখ মেলে দেখেছি আমি
প্রিয় মায়ের মুখ।
মা যে আমার সকল স্বপন
মা-ই আমার সুখ
(প্রিয় মা : মৌটুসী)
গ.
If you love me
I shall love the flowers of garden
In the world.
(If you: Nure Asane)
.
এই তিনটি প্রকাশনায় প্রায় শতাধিক শিক্ষাথী কবিতা লিখেছেন। গল্প এবং রাজনীতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক কথকতাও লিখেছেন। ভাষার প্রাঞ্জলতা যেমন লক্ষণীয়, তেমনি অকপটে বলে গেছেন নিজ ভাব-ভাবনার আলাপন। কিশোর-কিশোরীদের কাছে এটিই তো চাওয়া।
শেষ দুটো সংখ্যাতে বিজ্ঞানের শিক্ষক মনোরঞ্জন সেন বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিস্তরনে প্রতিবন্ধকতা এবং উত্তরনের উপায় নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন রসায়নের সব জটিল বিক্রিয়ার সহজ সমাধানের পথের কথা : ‘অজৈব যৌগের নামকরণ’ নিবন্ধে। শিক্ষক রবিন বসু লিখেছেন ‘গণিত ভীতি গণিত প্রীতি’।
.
ঘ.
কাল যেখানে সবুজ দোলা গাছ গাছালির সারি
আজ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু দালানের বাড়ি।
(গাছ কেটো না আর : নূর ই ইসরাত)
.
এখানে উল্লেখ্য যে, স্কুল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কবিতা, গল্প, ছড়া, কৌতুক, ধাঁধা সবকিছু নিজের মষ্কিস্কপ্রসূত তা নয়। এদের মাঝে কারো কারো নিজের মৌলকতা যেমন আছে, কারো কারো অন্যলেখা টুকলিফাই করে তুলে আনা, কিংবা একটু ঘষামাজা করে নিজের নামে চালিয়ে দেবার প্রবণতাও আছে। তার পরও শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা-উদ্দীপনা লক্ষণীয়।
আত্মপ্রকাশের আকুলতায় উন্মুখ নবীন শিক্ষার্থীদের ভাবানুভূতিকে জাগিয়ে তুলতে বার্ষিকীর কোনো বিকল্প নেই। স্কুল ম্যাগাজিন তাই ছোটকাগজ চর্চার প্রাইমারি স্কুল। সুরে সুরে নামতা পড়তে পড়তে আজ আমাদের ছুটি গরম গরম রুটি বলার উন্মুক্ত চাতাল। সাহিত্যচর্চার আঁতুর ঘর।
.
বক্সীগঞ্জে থাকি আমি
শান্ত আমার নাম
স্বপ্ন আমার ডাক্তার হবো
উজ্জ্বল হবে গ্রাম।
.
শাহ মুহাম্মদ শান্তর ‘স্বপ্ন’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে ‘শুভ্র ভোরের পুষ্পকথা’ নামের এক স্কুল ম্যাগাজিনে। স্কুল ম্যাগাজিন শিশুদের স্বপ্ন নির্মাণের, সাহস নির্মাণের, নিজের কথা নিজের মতো বলবার আঁতুর ঘর। এখানেই প্রজাপতির মতো পাখনা মেলে শিশুদের।
ভাবী কালের যাত্রিকদের শব্দখেলার আসর। সম্পাদক সুজয় মালাকার। এক স্বপ্নবাজ তরুণ। গত শতাব্দীর আটের শেষের দিকে এই মফস্বলে বের করেন শিশুদের জন্য পত্রিকা ‘দুরন্ত’। কৈশোর ও যৌবনে মেতেছেন নাটকের দল গড়া ও নাটক মঞ্চায়নের। শহীদ মোস্তফা থিয়েটারের প্রযত্নে পরবর্তী দুই দশক অনেক নাটকের সফল মঞ্চায়ন দেখেছে টাউন শেরপুরের নাটক প্রিয় নাগরিক।
তিনি আবার গত কয়েক বছর আগে গঠন করলেন শেরপুর বার্ড কনজারভেটিভ সোসাইটি। দলে আছেন—শহিদুজ্জামান, আব্দুল কাদির, অপূর্ব ভট্টার্চায, দেবদাস চন্দ প্রমুখ। পাখি বিষয়ক মুখপত্র ‘আমাদের পাখি’ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে।
পাখির বসত বনেই, খাঁচায় নয়—‘পাখি ও পরিবেশ রক্ষায় আমাদের নিরলস পথচলা’—পাখি সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তাঁরা কাজ করে যাচ্ছে।
‘শুভ্র ভোরের পুস্পকথা’ দিশা প্রিপারেটরি এন্ড হাই স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন। নয়ের দশকে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত। স্কুলটি পড়াশোনার পাশাপাশি সুজয় মালাকার চারুকলার কার্যক্রমে যুক্ত করেছেন শিক্ষার্থীদের।
সম্পাদক বার্ষিকীতে বারবার বলেছেন, ‘ছোটদের লেখা ছোটদের মতোই হওয়া উচিত।… কাঁচা হাতের কাঁচা লেখাই ছেপে দিলাম নির্ভয়ে।’ ঠিকই বলেছেন এবং ঠিকই করেছেন। আঁতুরঘরের কাজ ‘ছেলেখেলাই’ হবে; এতেই সৃষ্টি সুখের উল্লাস। শেষে তিন বলছেন, ‘নিজস্ব চেষ্টার মাধ্যমেই একদিন ওদের মেধার বিকাশ ঘটবে।’
বিভিন্ন সংখ্যায় শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবি নিয়েই ‘শুভ্রভোরের পুষ্পকথা’র প্রচ্ছদ। এঁকেছেন—সুকন্যা, অভিজিৎ, দূর্জয়, সৌমিত্র ও সিয়াম। লেখা ও ছবি শিক্ষার্থীদের, তবে পত্রিকার বিন্যাস ও অলংকরণে সম্পাদকের মুন্সিয়ানা আছে।
শিবরাম চক্রবর্তীর কাহিনীর নাট্যরূপ দিয়েছেন শিক্ষার্থী আফিয়া শারমিন তুলি। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান রাকিব লিখেছেন, ‘ইংরেজি ভাষার শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের সীমাবদ্ধতা’ নিয়ে নিবন্ধ। এ ছাড়া লিখেছেন শিক্ষকবৃন্দ।
.
পরীক্ষা হল
নেই কোলাহল
ভয়ে কাঁপে বুক
করে ধুকপুক।
(পরীক্ষা : হোসাইন মোহাম্মদ)
.
আইডিয়াল প্রিপারেটরি এন্ড হাই স্কুলের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ২০১৬ সালে। স্কুলটি ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত। ‘রজত’-এর সম্পাদক নাসরিন বেগম ফাতেমা।
এ অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে আইডিয়াল স্কুল বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। নব্বইয়ের পর থেকে সারাদেশে যেমন, তেমনি শেরপুরেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তরনে ব্যক্তি মালিকানা স্কুল বেড়েছে। বেড়েছে শিক্ষার হারও। বেড়েছে নাগরিক সচেতনতা।
রাবিউল ইসলাম উক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক; কবি। অমর একুশে বইমেলায় কবি প্রকাশ করেন ‘স্বচ্ছ ভালোবাসা’ কাব্যগ্রন্থ। বইটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তার কবিতায় সহজ উপস্থাপনা ও প্রাঞ্জল ভাষার কারুকাজ লক্ষণীয়। যদিও সাম্প্রতিক কবিতার উত্থান-পতন কবিতার বাঁকবদলের হদিশ তার কবিতায় নেই। রজতে তিনি কবিতায় লিখেছেন—
.
‘মাতৃভাষা বাংলাভাষা
পড়াই বাংলা ভাষা
সহজ বিষয় জানেন সবাই
যত কুলি মজুর চাষা।
(আপন পেশায়)
.
পঞ্চমের শিক্ষার্থী আবিদা ইয়াছমিন রিতু লিখেছেন—
.
ফুল হতে
পাঁপড়ি লাগে
নদী হতে
জল লাগে
বৃষ্টি হতে
মেঘ লাগে
দুঃখ পেতে—
আঘাত লাগে
.
‘ভিক্টোরি’ শেরপুর সরকারি ভিক্টোরিয়া একাডেমির ১২৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র। ১৮৮৭ সালে ১ এপ্রিলে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। নয় আনি জমিদার চারু চন্দ্র চৌধুরীর প্রযত্নে। তিনি প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকও ছিলেন।
এ অঞ্চলে ভিক্টোরিয়া একাডেমি শিক্ষার বাতিঘর। চারু চন্দ্রের নামে তার প্রতিষ্ঠিত আরেকটি স্কুল আছে ‘চারু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে নালিতাবাড়ি থানার আম বাগানে। আরেকটি তথ্য যোগ করা যেতে পারে, সেই সময় রানী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসন আরোহনের জুবলি অভিষেক উপলক্ষে জমিদার চারু চন্দ্র চৌধুরী বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।
.
‘হাতে রাখো হাত, এগিয়ে যাও
কণ্ঠে তোলো মানুষ হবার গান—
বিদ্যা-জ্ঞানের সারথী মোরা
আমরা ভিক্টোরিয়ান।’
.
এই থিম সংটি লিখেছেন ড. সৌমিত্র শেখর। সুরারোপ করেছেন দেবাশীষ মিলন। সুরে ছন্দে গানটি অপূর্ব। প্রাক্তন শিক্ষক মুহাম্মদ মুহসিন আলী লিখেছেন, ‘শেরপুর সরকারি ভিক্টোরিয়া একাডেমির ইতিকথা’ নিবন্ধ। সৌমিত্র শেখর লিখেছেন, ‘ইতিহাস নিশ্চয়ই ধরা দেবে’। আছে প্রাক্তন ভিক্টোরিয়ানদের স্মৃতিচারণ; ইতিহাস চর্চা ও কবিতা।
১৯৮৩ সালে সুনীল বরণ দে’র সম্পাদনায় একটি বার্ষিকী বের হয়। শিক্ষক সুনীল বরণের সম্পাদনায় এই তিরাশি সালের বার্ষিকীটি গোছালো। এ ছাড়া সুনীল বরণ দে স্থানীয় বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। কখনো আবু তাহের সম্পাদিত সঞ্চরনে, কখনো কখনো মো. মুহসীন আলীর সম্পাদিত পত্রিকায়, কিংবা সাতের দশকে প্রকাশিত ‘প্রবাহ’-এ।
গারো নৃত্য ও সঙ্গীত নিয়ে সুনীল বরণ দে’র একটি চমৎকার নিবন্ধ। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বার্ষিকী প্রকাশিত হলেও, ধারাবাহিকতা থাকেনি। সাতানব্বই সালে প্রকাশিত ম্যাগাজিনও পরিচ্ছন্ন।
.
‘লক্ষ জনের লক্ষ কায়া
অন্তরে আবার একের ছায়া।
অযুত লক্ষ যাই বলি
সবাই মিলে এক,
এক ভিন্ন দুই নাই
সকলের এক সাঁই
(এক : বিনয় কৃষ্ণ সাহা)
.
বিনয় কৃষ্ণ সাহা তৎকালীন সময়ে ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন—চারুকলার শিক্ষক হারুন অর রশিদ।
১২৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত ক্রোড়পত্রের সম্পদনা পরিষদে ছিলেন—আ জ ম রেজাউল করিম জুয়েল, শিব শংকর কারুয়া, সুশীল মালাকার, সঞ্জীব চন্দ-সহ প্রমুখ। গ্লোসি পেপারে চার রঙে ছাপা কাগজটিতে চমৎকারভাবে সাজিয়েছেন সম্পাদনা পরিষদ।
.
তথ্যসূত্র
১. শেরপুরে সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে : গোলাম রহমান, অঙ্গন।
২. ইমদাদুল হক হিরা মিয়া স্মারকগ্রন্থ : আহমদ আজিজ, ২০০৯।
৩. শেরপুর জেলার পত্রপত্রিকা ও সাংবাদিকতা : সুশীল মালাকার, উন্নয়নে শেরপুর।
৪. সাহিত্যে শেরপুরের অবদান : মোস্তফা কামাল, প্রয়াস, ১৯৮৬।
৫. প্রমথ গুপ্তের চিঠি : কমরেড সুশীল রায়কে লেখা, অপ্রকাশিত।
৬. ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহেরর বিবরণ, শ্রীকেদার নাথ মজুমদার।
৭. সোনার খাঁচার দিনগুলো : গোপা হেমাঙ্গী রায়, ২০০৪।
৮. আত্মচরিত : গিরিশ চন্দ্র সেন, ১৩১৩ বঙ্গাব্দ।
৯. শেরপুরের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকথা : গোলাম রহমান, ১৯৭৯।
১০. উদয় শংকর রতন : একজন কবির প্রতিকৃতি, সাহিত্যলোক।
১১. রা : রবিন পারভেজ, সংখ্যা ০৬, ২০১১।
১২. অঙ্গিকার : তুলশী নাগ, ১৯৭৭।
১৩. শেরপুরের ইতিকথা : অধ্যাপক দেলওয়ার হোসেন, ১৯৬৯।
১৪. নাগ বংশের ইতিবৃত্ত : শ্রী বিজয় নাগ, ১৯২৯।
১৫. www.publiclibrary.giv.bd
১৬. একান্ত প্রদীপের আলোয় : মুহাম্মদ আবু তাহের, ২০১৪।
১৭. শেরপুর জেলার অতীত ও বর্তমাস : পণ্ডিত ফসিহুর রহমান, ১৯৯০।
১৮. পাখির নিরাপদ আশ্রয়ে বিদ্যুতের ফাঁদ : প্রথম আলো, ২৬.৫.১৩।
১৯. http://nbsnews.org/bn/2016/08/27/159707
২০. অবকাশ নয়, চাই হাজনী গ্রাম : নিস্কৃত হাগিদক, ব্রিংনি বিবাল, ০৯।
২১. আপসান : রবেতা ম্রং, মরিয়মনগর রিচ্চাসা দামানি ওয়ানগালা, ২০১৫।
২২. ওয়ানগালা স্মরণিকা ’৯৯, রবেতা ম্রং।
২৩. মান্দি কৃষ্টি : ওয়ানগালা ও প্রাসঙ্গিক কিছুকথা, রমেন্দ্র কুমার মানখিন।
২৪. বিশপ পনেন পল কুবি’র ওয়ানগালা বাণী, আপসান, ২০১৫।
২৫. একজন মহিলা : একটি কাব্য, মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ খান, ১৯৬৭।
২৬. চিঠি : রোজিনা তাসমীন।
২৭. চিঠি : রবিন পারভেজ।
২৮. ব্রতচারী আর্দশ মানুষ গড়ার আন্দোলন : নরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২৯. ইস্ক্রা : সম্পাদক নিলয় সাহা, ১৯৮৫।
৩০. ইতিকথা : বিমল কর্মকার, মাধবপুর ক্লাব সুবর্ণজয়ন্তী সংখ্যা।
৩১. সমবায় সংঘের স্মৃতিচারণ : নারায়ণ সাহা, অঞ্জলি, ১৪১৯।
৩২. অসহযোগ আন্দোলন : প্রমথ গুপ্ত।
৩৩. ভুলি কেমনে : মোস্তফা কামাল, সুবর্ণ সম্ভাব, ১৯৯১।
৩৪. সেরপুর বিবরণ : শ্রী হরচন্দ্র চৌধুরী, ১৮৭৩।
৩৫. আলাপচারিতা : মিঠুন রাকসাম, উঠান, ১ম বর্ষ, ২০১৯।
.
ঋণ স্বীকার
ক. ফকির আখতারুজ্জামান, এ্যাডভোকেট।
খ. কমল পাল, নৃত্যশিল্পী।
গ. শিব শংকর কারুয়া, সহযোগী অধ্যাপক ও লেখক।
ঘ. রবিন পারভেজ, কবি।
ঙ. রফিক মজিদ, সাংবাদিক।
.
(শেষ)
…………………
পড়ুন
কবিতা
রাংটিয়া সিরিজ : জ্যোতি পোদ্দার
প্রবন্ধ-গবেষণা
টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী
১ম পর্ব । ২য় পর্ব । ৩য় পর্ব । ৪র্থ পর্ব । ৫ম পর্ব । ৬ষ্ঠ পর্ব । ৭ম পর্ব । ৮ম পর্ব । ৯ম পর্ব । ১০ পর্ব । ১১তম পর্ব । ১২তম পর্ব । ১৩তম পর্ব । ১৪তম পর্ব । ১৫তম পর্ব । ১৬তম পর্ব । ১৭তম পর্ব । ১৮তম পর্ব । ১৯তম পর্ব । ২০তম পর্ব । ২১তম পর্ব । ২২তম পর্ব । ২৩তম পর্ব । ২৪তম পর্ব । ২৫তম পর্ব । ২৬তম পর্ব । ২৭তম পর্ব । ২৮তম পর্ব । ২৯তম পর্ব । ৩০তম পর্ব । ৩১তম পর্ব । ৩২তম পর্ব । ৩৩তম পর্ব । ৩৪তম পর্ব । ৩৫তম পর্ব । ৩৬তম পর্ব । ৩৭তম পর্ব (শেষ পর্ব)
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা
সুনীল শর্মাচার্যের দশটি কবিতা
নাসিমা খাতুনের কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের কবিতা