শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৭ম পর্ব
জ্যোতি পোদ্দার
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৭ম পর্ব
পাঁচ
১৯৪৭ সালের পূর্বের পঞ্চাশ বছর শেরপুরে কোনো সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে কি-না তার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদিও টাউন শেরপুরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিকচর্চা বিশেষ করে নাট্যচর্চার ধারাবাহিক কার্যক্রম ছিল।
পণ্ডিত ফসিহুর রহমান ও অধ্যাপক দেলওয়ার হোসেন শেরপুরের ইতিহাস নিয়ে কাজ করলেও তাদের বইতে সাহিত্যপত্রিকা বিষয়ক কোনো আলোচনা করেননি।
উনিশ শতক থেকেই শেরপুরে সাহিত্যচর্চার জমিন তৈরি হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে হরচন্দ্র চৌধুরীই (১৮৩৭—১৯১০) এ-জেলায় সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে প্রথম পথিক।৪
তিনি ছাড়াও পণ্ডিত চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার (১৮৩৬—১৯১০), বিজয়কৃষ্ণ নাগ, রাধাবল্লভ চৌধুরী, রামকান্ত, রামনাথ বিদ্যাভূষণ, হরগোবিন্দ লস্কর, হরসুন্দর তর্করত্ন, নারী কবি হিরন্ময়ী চৌধুরী, পাইকুড়া গ্রামের অধিবাসী পুঁথিলেখক রমজান আলী, কবি ফজলুল রহমান আজনবী, আব্দুল কাদের মুন্সী, একই গ্রামের বিপ্লবী ও লেখক প্রমথ গুপ্ত, কবি কিশোরী মোহন চৌধিরী, মীরগঞ্জ অধিবাসী মুন্সী বছির উদ্দিন, শ্রীবর্দীর গোলাম মোহম্মদ এবং রৌহা গ্রামের অধিবাসী সৈয়দ আবদুস সুলতান৪ শেরপুরের সাহিত্যচর্চার স্মরণীয় বরণীয় অগ্রসৈনিক।
তাঁদের সাহিত্যকৃত্য নিয়ে দুই ইতিহাস লেখক বিশেষ কিছু লিখেননি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনালোকিতই থেকে গেছে। এতে করে শেরপুরকে জানবার-বুঝবার ও ছড়িয়ে দেবার পথ হয়ে গেছে সংকীর্ণ।
‘ময়মনসিংহ জেলার অন্তগর্ত একটি উপজাতি অধ্যুষিত জনপদে বিদ্যোৎসাহী কতিপয় জমিদারদের প্রচেষ্টায় যে বিকাশ শুরু হয়েছিল—দুর্ভাগ্যক্রমে আধুনিক যুগে তা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি।’৪
দেশভাগ উত্তর দশ বছরে শেরপুরের কি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি? একদিকে, দেশভাগজনিত মানুষের অস্থিরতা, কেউ কেউ পাড়ি দিচ্ছে সীমান্তের ওপারে, পরিবার ভাঙছে—অন্যদিকে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের আবির্ভাব—এই সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ কি সেই সময়ের তরুণদের প্রভাবিত করেনি?
তা ছাড়া বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের বছর? ১৯৫২ সালে ভাষার প্রশ্নে লড়াই সংগ্রাম শেরপুরে রাজনৈতিক কার্যক্রম ছিল বলিষ্ঠ। সেই সময়ে কি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি? অনেক অনুসন্ধানে তথ্য পেলাম ‘সাপ্তাহিক পয়গাম’৪ সৈয়দ আবদুস সুলতান ১৯৫২ সালে প্রকাশ করেন।
সৈয়দ সুলতান স্বাধীনতার পর ব্রিটেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এ ছাড়া দেশভাগ উত্তর সময়ে আর কোনো সাহিত্য পত্রিকা হয়নি। কেন হয়নি তার কার্যকারণ কেউ হয়তো খুঁজবেন।
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৭ম পর্ব
তবে এখানে একটু তথ্য যোগ করা যেতে পারে। দেশভাগের তিন বছর পর টংকপ্রথাবিরোধী যে আন্দোলন ময়মনসিংহের উত্তরে শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলনে শহীদ হন নারিতাবাড়ি কমিউনিস্ট নেতা কমরেড শচী রায়, ১৯৫০ সালের ১৬ মে। তিনি দেশভাগ উত্তর প্রথম শহীদ।
তাঁর স্মরণে কমিউনিস্ট পার্টি একটি বুলেটিন প্রকাশ করে। নাম ছিল ‘রশ্মি’।৫ শহীদ স্মরণে সাইক্লোস্টাইলে ছাপা রস্মিতে ছিল রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও শচী রায়কে উৎসর্গ করে লেখা কবিতা।
১৮৬৯ সালের ১৬ জুন শেরপুর পৌরসভা ঘোষিত হবার চার বছর পূর্বে ‘বিদ্যোন্নতি সাধিনী’ (১৮৬৫)৬ নামে একটি মাসিক পত্রিকা যাত্রা শুরু করে জমিদার হরচন্দ্র রায় চৌধুরির প্রযত্নে চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কারে সম্পাদনায়।৭
উক্ত পত্রিকা প্রকাশের আগে গঠিত হয় ‘বিদ্যোন্নতি সাহিত্য চক্র’।৭ গোপা হেমাঙ্গী রায় তাঁর ‘সোনার খাঁচার দিনগুলি’ বইতে লিখেছেন, ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার ও ঈশান চন্দ্র বিশ্বাসের উৎসাহে ও প্রেরণায় ১৮৬৫ সালে হরচন্দ্র নিজের বাড়িতে ‘বিদ্যোন্নতি সভা’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন।’৭
তখন শেরপুর তো দূরের কথা ময়মনসিংহে কোনো প্রেস ছিল না। ছিল না কাছাকাছি ধনবাড়ি কিংবা টাংগাইল জমিদার শাসিত কোনো অঞ্চলে। ‘বিদ্যোন্নতি সাধিনী’ ময়মনসিংহ জেলার প্রথম পত্রিকা।৬
এই সভা থেকেই প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক চারুবার্তা। তখনো পৌরসভা গঠিত হয়নি। যে বছর শেরপুরে পৌর সভা হয়, সেই একই বছরে আট এপ্রিলে ময়মনসিংহ পৌরসভা গঠিত হয়। শেরপুর পৌরসভা ময়মনসিংহেরর চেয়ে কয়েক মাসের ছোট এবং প্রান্তিক পৌরসভা। নিশ্চয় সেই সময়ে শেরপুর অঞ্চল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে পরিগঠিত হবার সূচক ব্রিটিশের বার্ষিক রিপোর্টে উর্ধ্বমুখী ছিল।
১৮৮০ সালে ‘চারুপ্রেস’৯ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রেস থেকেই গিরিশ সেন কৃত পবিত্র কোরআন শরিফের বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। ‘১৮৮১ সালের শেষ ভাগে আমি ময়মনসিংহে যাইয়া স্থিতি করি, সেখানে কোরাণ শরিফের কিয়দ্দূর অনুবাদ করিয়া প্রতিমাসে খণ্ডশঃ প্রকাশ করিবার জন্য সমুদ্যত হই। শেরপুরস্থ চারুযন্ত্রে প্রথম খণ্ড মুদ্রিত হয়…’৮
একই প্রেস থেকে ১৮৮৫ সালে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ ছাপা হয়। অন্যদিকে, শেরপুরে জমিদারদের মাঝে শরিকী ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব যেমন ছিল, তেমনি ছিল কল্যাণমূলক কাজের প্রতিযোগিতা (ভিক্টোরিয়া স্কুল ও জিকে পাইলট স্কুল প্রতিষ্ঠা উল্লেখ্য)।
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৭ম পর্ব
নয়আনী জমিদারের পাশাপাশি পৌনে তিন আনী জমিদার প্রতিষ্ঠা করেন জগন্নাথ অগ্নিহোত্রির প্রযত্নে ‘শেরপুর বিজ্ঞাপনী প্রেস’ (১৮৯৫)। এই প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক বিজ্ঞাপনী সংবাদ’।
শেরপুরের জমিদারবৃন্দ শুধুমাত্র বাণিজ্যের জন্যই শুধু প্রেস স্থাপন করেননি, তাদের ছিল সমাজ সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কল্যাণমুলক কার্যক্রম চালানো ও তার পরিসর নির্মাণ করা।
এই প্রান্তিকে যে প্রেস ব্যবসা সুবিধে করতে পারবে না তার সম্যক জ্ঞান জমিদার কর্তা ব্যক্তিদের ভালোই ছিল। জমিদার বিলাসী হলেও, পাকা চুলের নায়েবদের লাভ-ক্ষতির হিসাব ছিল নখের ডগায়।
নয়আনী জমিদারের অধীনে ব্যবস্থাপকের চাকরি করতে আসা গীতিকবি গোবিন্দ দাসের কয়েক কাব্যগ্রন্থ এই চারু প্রেস থেকেই নয়আনী জমিদারের পৃষ্টপোষকতাই প্রকাশিত হয়। নিয়মিত বিদ্যোন্নতি সাধিনী প্রকাশিতও হচ্ছে এই প্রেস থেকে। হরচন্দ্রের ‘সেরপুর বিবরণ’ গ্রন্থের অধিকাংশ রচনা এই কাগজেই প্রথম প্রকাশিত হয়।
বছরভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত হরচন্দ্র চৌধুরী প্রণিত ‘সেরপুর বিবরণ’ গ্রন্থ হতে প্রাপ্ত। শেরপুরের সুধীমহল ও পরবর্তী সময়ে যারা ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন, তারাও সেরপুর বিবরণ (১৮৭৩) ও নাগবংশের ইতিবৃত্ত (১৯৩০) হতে প্রাপ্ত সাল-তারিখ লিখেই ইতিহাস রচনা সমাপ্ত করেছেন। কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেননি। তথ্য হিসেবে হাজির আছে শুধু।
তৎকালীন সময় ও তার কার্যকারণে কী ঘটেছে—কোন আর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই শেরপুর পল্লবিত হয়ে উঠল এবং কেনই-বা পরবর্তী পঞ্চাশ ষাট বছর নিষ্ফলা মাঠের মতো পড়ে রইল তার বিশ্লেষণ করা হয়নি।
শেরপুর পরিগঠনে হরচন্দ্র চৌধুরীর যে ভূমিকা তার কোনো মূল্যায়ন শেরপুরের ইতিহাস প্রণেতারা করেননি। নাগরিক সমাজও মনে রাখেননি এই বহুভাষায় দক্ষ পণ্ডিত মানুষকে। অধ্যাপক দেলওয়ারের ‘শেরপুরের ইতিকথা’ (১৯৬৯), পণ্ডিত ফসিহুর রহমানের ‘শেরপুর জেলার অতীত ও বর্তমান’ (১৯৯০)—এই দু’টি বইয়েই পরবর্তী অনেক তথ্য-উপাত্ত তারা যুক্ত করেছেন।
এ-জন্য তারা আমাদের নমস্য। আগামী কালের কোনো ইতিহাসবেত্তা নিশ্চয় এই বইগুলো থেকে রসদ যেমন পাবেন, তেমনি পাবেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিকতার ঘটনা প্রবাহ ও তার কার্যকারণ এবং মিসিংলিংক।
শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৭ম পর্ব
একমাত্র নালিতাবাড়ির অধ্যাপক মোস্তফা কামাল হরচন্দ্র চৌধুরী ও তাঁর ‘সেরপুর বিবরণ’ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘তাঁর বইটি শুধুমাত্র একটি তথ্য প্রদান ও গবেষণামূলক ঐতিহাসিক গ্রন্থই নয়—বিপ্লব, বিদ্রোহ অভ্যুত্থান ও জীবন চেতনা এবং বাস্তব সমাজ চেতনার এককালের সাক্ষী।
সবচেয়ে শিল্পী হরচন্দ্র চৌধুরীর প্রতি আমাদের মস্তক শ্রদ্ধায় অবনত হয় এ জন্যই যে, সামন্ত জমিদার হরচন্দ্রেরা শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার জন্য কৃষক সংগ্রামকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে—এই সামন্ত হরচন্দ্রই শেরপুরের কৃষক অভুত্থানের সংগ্রামী ও বৈপ্লবিক চেতনার জয় ঘোষণায় মুখরিত।
অন্তরের সমস্ত সত্তাটুকু নিঙড়িয়ে দিয়ে তিনি কৃষকদের সংগ্রামী চেতনাকে চিত্রিত করেছেন এবং আসল সত্য ও তথ্যের দিক নির্দেশ করেছেন। শিল্পী হরচন্দ্র চৌধুরী এখানে কৃষকদের সংগ্রামকে লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য একাত্ম। এখানে শিল্লী হরচন্দ্র চৌধুরী সামন্ত হরচন্দ্রকে পরাজিত করে স্বাধীন শৈল্পিক সত্তায় জাগ্রত ও স্পষ্টবাক।’৪
স্থানিক ইতিহাসের ভিত্তি যে প্রাতস্মরণীয় মানুষদের হাতে নির্মিত হয়েছে—তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েই এগুতে হবে সামনের পথ। আরো প্রয়োজন পর্যালোচনা। স্থানিক ইতিহাসের রসদ রচনা ছাড়া জাতীয় ইতিহাস বিকাশ হতে পারে না। একটি শক্তিশালী জনগোষ্ঠী গঠনে স্থানিক ইতিহাস বিনির্মাণ ছাড়া হতে পারে না।
(চলবে)
…………………
পড়ুন
কবিতা
রাংটিয়া সিরিজ : জ্যোতি পোদ্দার
প্রবন্ধ-গবেষণা
টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী
১ম পর্ব । ২য় পর্ব । ৩য় পর্ব । ৪র্থ পর্ব । ৫ম পর্ব । ৬ষ্ঠ পর্ব । ৭ম পর্ব
17 thoughts on “শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ৭ম পর্ব”