shubhobangladesh

সত্য-সুন্দর সুখ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবসময়…

নীল কাঁচপোকা

Glass bugs
Glass bugs

নীল কাঁচপোকা

মনোজিৎকুমার দাস

নীল কাঁচপোকা

দিন বদলের পালা শুরু হয়েছে বেশ দিন থেকে, তা সবকিছুতেই পালা বদল। হাওরের মানুষের জীবনে এসেছে পরিবর্তনের হওয়া। আগে বছরের নয় মাস জলমগ্ন থাকতো, জাদু ছোঁয়ায় সেখানটা দিনে দিনে বদলে গেছে।

বিলের মাঝ দিয়ে পাকা সড়ক এঁকেবেঁকে চলে গেছে ঝকঝকে শহরের দিকে। পাকা সড়কে দু’পাশে বাবলা, কড়াই, অর্জুন বৃক্ষের সারি। মুন্সী বাজার পেরোলেই রাস্তার দু’পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ। চোত মাস পড়তেই কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটা শুরু। বোশেখে গাছগুলো লালে লাল।

একটু এগোলেই শিমুলতলী। কয়েকদিন আগেও শিমুলতলীর শিমুল গাছগুলোর পাতা ছিল না, ছিল অজস্র রক্তলাল শিমুল ফুল আর শিমুল ফুল। শিমুল গাছগুলো বিপুলের দাদা জাবেদ মল্লিক লাগিয়েছিল।

মল্লিকপুর বাজারের প্রতিষ্ঠাতা জাবেদ মল্লিক। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর ভাটির দেশ থেকে জাবেদ মল্লিক উজান দেশে বাবার সঙ্গে পাটের ব্যবসা করতো। ফরিদ মল্লিক রজব মুন্সী পাটের গোডাউন ভাড়া নিয়ে বড়-সড় ধরনের পাটের কারবার খোলে মুন্সী বাজারে।।

একসময় দাদীর কথা জাবেদের মনে পড়ে। দাদী বলতেন, ‘বরিশালের ধান, পাবনার পান। যশোরের মেয়ে, ফরিদপুরের নেয়ে।’ এখানে এসে রজব মুন্সীর মেয়ে শাহানাকে দেখে জাবেদ ভাবে, দাদীর কথা তো ঠিক! যশোরের মেয়েরা তো সত্যিই সুন্দরী।

জাবেদের মা বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পাড়ের কীর্তিপাশার মেয়ে। জাবেদকে নিয়ে তার ভাবনার অন্ত নেই। জাবেদের মা ভাবে, ছাওয়ালটা আর একটু ডাগোর হলু পারে ওরে সইর মিয়্যার লগে বিয়ে দিয়ে দিতাম। দিলরুবার মতো একটা বিটার বউ আনতি পারলি সোয়াস্তি পাতাম। জাবেদের মা’র ভাবনা ভাবনাই থেকে যায়।

এদিকে শাহানার বাবা ভাবে, জাবেদকে জামাই করতি পারলি ভালোই হতো। জাবেদ কালেভদ্রে শাহানাদের বাড়িতে যায়। প্রথম দিন দূর থেকে সে শাহানাকে দেখেই ভেবেছিল, মুন্সীকাকার মেয়েটি খুবই সুন্দরী।

শাহানার বাবা ভাবে, জাবেদের সাথে শাহানার বিয়ে দিতে পারলে মন্দ হয় না। সে শাহানার মা’র সাথে পরামর্শ করে। ওর মায়ের ইচ্ছেটাও তেমনই।

জাবেদের বাবা বরিশালে দেশের বাড়ি গেলে ব্যবসার সব দায়দায়িত্ব জাবেদ নেয়। সে সময় থেকে রজব মুন্সি শাহানার বিয়ের বিষয়ে বেশি করে ভাবতে থাকে। সে আগেই জাবেদের বাবার সাথে আলাপ করে বুঝেছিল, সে ছেলের বিয়ে তাদের দেশে দেবে না।

আকারে ইঙ্গিতে জাবেদের সাথে শাহানার বিয়ের কথা রজব মুন্সী ফরিদ মল্লিককে বলেছিল। কিন্তু তাতে সে সাড়া না-দেয়ায় রজব মুন্সি অপমান বোধ করে। সে প্রতিজ্ঞা করে সুযোগ পেলে ফরিদ মল্লিককে একহাত দেখে নেবে।

জাবেদের বাবা ফরিদ মল্লিক বরিশালে গেলে ফরিদ মুন্সী বুদ্ধি আটে এইটাই সুয়োগ জাবেদ মল্লিককে কব্জা করার। সে প্রায় দিনই জাবেদের ব্যবসার খোঁজখবর নেয়। জাবেদকে তাদের বাড়িতে যাবার জন্য বলে।

জাবেদ ফরিদ মুন্সীর বাড়ি যায়। প্রথম দিন সে দূর থেকে শাহানাকে দেখতে পায়, যদিও সে শাহানাকে আগেও একদিন স্কুলে যাবার পথে দেখেছিল। শাহানার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। তাই সে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকায় জাবেদের সাথে দেখা করে না।

শাহানার মায়েরও ইচ্ছে জাবেদের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবার। সে ভাবে, দিনকাল যা পড়েছে, তাতে মেয়েকে বেশি পড়াশোনা করাতে ইচ্ছে তার নেই। তার ভাইয়ের মেয়েটা শাহানার ক্লাসে পড়তো। নয় ক্লাস থেকে দশ ক্লাসে উঠার পর পর বাদামতলির এক ভাদামে ছাওয়ালের লগে ভেগে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। কুলসুমের কী বিয়ের বয়স হইছিল!

এসব কথা ভেবেই শাহানার মা মেয়ের বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগে। ভালো ছাওয়াল পাওয়া মুখের কথা নয়, তা সে জানে। শাহানার বাবা জাবেদের সাথে মেয়ের বিয়ের কথা তোলায়, জাবেদের বাবা রাজি না-হওয়ায় শাহানার মায়ের মাথায় জেদ চেপে যায়। শাহানার মা করিমন জানে কিভাবে যুবক ছাওয়ালকে বসে আসতে হয়।

ফরিদ মুন্সির বাবা-মা একসময় জেনেছিল করিমন কিভাবে তাদের ছাওয়াল ফরিদকে বস করেছিল। ফরিদের বাবা-মা তার সাথে বিয়ে দিতে নারাজি হওয়ায় করিমনের মনের অবস্থা পাগলের মতো। তার মতো জুয়ান সুন্দরীর জন্য তো ফরিদেরই পাগল হবার কথা! কিন্তু পাগল হচ্ছে তার সুন্দরী মেয়ে করিমন!

সে এক ঘটনা। সেই ঘটনাই ফরিদকে বশ করার আভাস পায় করিমন। সেদিনের কথা মনে পড়লে করিমনের এখনো হাসি পায়। বর্ষাকাল করিমন মন মরা হয়ে নিজের ঘরে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। হঠাৎ তার চোখ পড়ে আলমারির কোণার দিকে। সে দেখতে পায় একটা নীল রঙের কাঁচপোকা তার থেকে বড় সাইজের একটা তেলাপোকাকে শুড় দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

করিমনের মনে হয়, তেলাপোকাটা তো ইচ্ছে করলে তার পাখনায় একটা ঝাপটায় নিজেকে মুক্ত করতে পারে। অথচ তেলাপোকাটা নীল কাঁচপোকার দ্বারা সম্মোহিত! এ দৃশ্যটা দেখে করিমন যেন একটা ইঙ্গিত পায়।

তেলাপোকাটাকে কব্জা করার ওই দৃশ্যটার কথা সে ভাবে। ফরিদ নামের তেলাপোকাটাকে বস করতে হলে তাকে নীল কাঁচপোকা হতে হবে। করিমন সত্যি সত্যি একদিন ফরিদকে সম্মোহিত করে ফেললে, সে যেন একান্তই তার হয়ে যায়।

ফরিদ তার মা-বাবাকে বলে দেয় করিমনকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। সে একসময় মনে মনে চিন্তা করে, সে মা হয়ে কিভাবে শাহানাকে নীল কাঁচপোকা হয়ে জাবেদকে বস করতে বলবে!

ভেবেচিন্তে একটা কিছু করতে হবে, করিমন মনস্থ করে। তার দু’দিন পড়ে করিমনের সোয়ামী ফরিদ মুন্সী বাজার থেকে এসে করিমনকে বলল, ‘ওগো শাহানার মা, খবর ভালো না, জাবেদ বরিশালে ফিরে গিয়ে বিএম কলেজে ভর্তি হয়েছে।’

সোয়ামীর কথা শুনে করিমন রেগে বলে, ‘যাক গে জাহান্নামে। আরো ভালো ছাওয়ালের সাথে আমাদের শাহানা মায়ের বিয়ে দেব।’

তারপর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়। শাহানা বিএ পাশ করে স্থানীয় গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পায়। অন্যদিকে, জাবেদ এমবিবিএস পাশ করে সরকারি ডাক্তার হয়।

সে একসময় শাহানাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার হয়ে আসে। সেবারই প্রথম শাহানা সাথে জাবেদের কথা হয়। শাহানাকে নীল কাঁচপোকার মতো জাবেদকে বশ করতে হয় না। ডাক্তার জাবেদ নিজেই তার মা-বাপকে বলে সে শাহানাকে পছন্দ করে। জাবেদের মা-বাবা এ বিয়েতে রাজি হয়।

বাসর রাতে জাবেদ তার বৌ শাহানাকে বলে, ‘এমন রাতের জন্যই সেদিন ফিরে গিয়ে পড়াশোনা করে ডাক্তার হওয়া, যাতে তোমাকে নীল কাঁচপোকা না-হতে হয়।’

About The Author

শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে থাকুন...