shubhobangladesh

সত্য-সুন্দর সুখ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবসময়…

নয়নতারা ফোঁটা-না-ফোঁটা

Nayantara
Nayantara

নয়নতারা ফোঁটা-না-ফোঁটা

লাবণ্য প্রভা

নয়নতারা ফোঁটা-না-ফোঁটা

শহীদুল জহিরকে আমি চিনি না। কিংবা চিনি। শহীদুল জহিরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তাঁর সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। এই দেখা হওয়া-না-হওয়া আসলে মহাকালে কোনো মানে বহন করে না।

এ দেশে কোটি কোটি শহীদুল জহির আছে। জহির শহীদুল আছে। আলাদা আলাদা করে লক্ষ লক্ষ শহীদুল আছে, জহির আছে। তারা খায় দায়, সঙ্গম করে, পয়দা করে। তাদেরকে আমি চিনি না। তাদেরকে চেনার জন্য আমার ভেতরেও কোনো মোচর তৈরি হয় না।

কিন্তু আমাদের শহীদুল জহির আলাদা। তিনি অন্য শহীদুল কিংবা জহিরদেরও মতো নন। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হলেও, গল্প-উপন্যাস লেখেন। কেবল লেখেন না, লেখক জগতকে চমকে দেন। অন্য লেখকরা তার লেখার ঝলকানিতে পুড়ে যেতে থাকেন।

তবে, শহীদুল জহিরকে চেনার আগে থেকে আমি আগারগাঁও কলোনি চিনি। বামপাশে পুরাতন বিমান বন্দর, আর ডান পাশে আগারগাঁও কলোনির মাঝ দিয়ে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে গুলিস্তানের দিকে যেতে যেতে আমি জায়গাটিকে চিনেছি সেই প্রথম তারুণ্যে।

অনেকখানি সবুজ খালি জায়গা, মাঝখানে একটি আধা তরুণ রাবার গাছ। কলোনির মানুষদের বসবার জন্য গাছটির চারদিকে বাধিয়ে দেয়া হয়েছে। আশির দশকের শেষ দিকে আর নব্বই দশকের আগে আগে আমি এ জায়গাটিকে পছন্দ করতে থাকি।

ওই পথে চলতে চলতে আমি জায়গাটির দিকে তাকিয়ে থাকি। গুলিস্তান যাওয়ার পথে এবং গুলিস্তান থেকে ফেরার পথে ওই জায়গাটিকে না-দেখলে আমার ভালো লাগে না। বিষয়টি আমার চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়।

কোনোদিন যদি বাসের অন্যদিকে বসতাম, সেদিন ঐ জায়গাটিকে না-দেখতে পেতাম না। কিন্তু বাস আগারগাঁও কলোনির কাছাকাছি এলেই আমি অস্থির হয়ে পড়তাম। আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হতো এবং বাসের লোকজনকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে আমি আগারগাঁও কলোনি দেখতে থাকতাম। গভীর শ্বাস নিতাম। এটা হয়তো অনেকের বিশ্বাসযোগ্য নাও মনে হতে পারে। বিশ্বাস করতেই হবে—এমন কোনো কথা নেই।

তবে এটা সত্যি যে আগারগাঁও কলোনির মানুষরা খুবই সবুজ প্রিয়। গান-বাজনা করে। উৎসব-পার্বণে কলোনিতে আলোকসজ্জা করে। গুলিস্তান-টু-মিরপুরের মাঝখানে আগারগাঁও কলোনি একটা সবুজ টিপের মতো জ্বলতে থাকে। 

নয়নতারা ফোঁটা-না-ফোঁটা

আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল ফোঁটে না কিংবা সেখানে নয়নতারা ফুল নেই কেন…

প্রতিদিন অফিস শেষ করে আবদুস সাত্তার বেলকনির বেতের চেয়ারে শরীর ডুবিয়ে বসে থাকে রাত পর্যন্ত। তার স্ত্রী, দুই পুত্র ও এক কন্যা লেখাপড়া করে। পাশের ফ্লাটে গিয়ে টেলিভিশন দেখে। সে তখন অন্ধকারে মিশে থাকে। সে দেখে অন্ধকার আরো কেমন গভীর ও স্পর্শযোগ্য হয়ে ওঠে, তার কোনো আনন্দ কিংবা ক্লান্তি বোধ হয় না—‘যেমন, কেরানির সরকারি চাকরিতে সে ক্লান্তির বোধহীনভাবে লেগে থাকে।’

সে বসে থাকে—তার স্ত্রীর লাগানো সবুজ লতার বেস্টনীতে। সে পটের মাটিতে জন্মানো নয়নতারা ফুলের অস্পষ্ট গন্ধ পায়। স্ত্রী শিরিন বানুর প্রশ্রয়ে ঘরের এখানে সেখানে পাতাবাহার আলো ছড়ায়। মানিপ্লান্টের লতা দোল খায়।

আবদুস সাত্তারের প্রতিবেশিরা এসব দেখে—‘তারা তার স্ত্রীর অফুরন্ত প্রশংসা করে। কলোনির নারীরা ঘরের ভেতর অরণ্যের এই সমাবেশ দেখে উত্তেজনায় আত্মহারা হয়ে পড়ে।

আবদুস সাত্তার এবং তার  পরিবার এই কলোনিতে চার বছর আগে আসার পর থেকে তার স্ত্রী এই চার বছর যাবৎ টবে গাছ জন্মানোর শিল্পচর্চার চরম বিকাশ ঘটায় এবং এই গাছ তাদের গৃহের সীমানা অতিক্রম করে প্রতিবেশীদের গৃহে ছড়িয়ে পড়ে।

কলোনির এই ভবনটির সকল অধিবাসী বিভিন্ন সরকারি অফিসের কেরানি, ইনস্পেক্টর এবং পাতি কর্মকর্তাদের স্ত্রীরা। তাদের বাসার ভেতরটা গাছে পূর্ণ করে ফেলার প্রতিযোগিতায় নেমে যায়।

ধীরে ধীরে গোটা আগারগাঁও কলোনি সবুজ হয়ে যায়। হলুদ হয়ে যায়। সেখানে হলুদ গাঁদাফুলের সবাবেশ হয়। গাঁদাফুলকে কেন্দ্র করে প্রজাপতির আগমন হয়। সেই প্রজাপতিরা সারাবেলা গাঁদাফুলের রেণুর মধ্যে বিচরণ করে।

তার পর তারা আবদুস সাত্তারের বাড়ির নয়নতারা ফুলের বেগুনি-সাদা ঝোঁপের কাছে এসে নৃত্য করে। আবদুস সাত্তার অজর-অচল হয়ে বসে থাকে—আর প্রজাপতিরা বারান্দায় উঠে এসে দুলে দুলে উড়তে থাকে।

তাদের পাখার ঝাঁপটা লেগে আবদুস সাত্তারের মুখে চিবুকে, কানের পিঠে হলুদ রেণু জমা হয়। তার জামার ভেতর প্রজাপতি ঢুকে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে আবদুস সাত্তার এক রহস্যময় চরিত্র হয়ে উঠতে থাকে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয় গোলাপফুল; প্রতিদিন একটি করে গোলাপ এসে পড়তে থাকে আবদুস সাত্তারের বারান্দায়। তার স্ত্রী প্রতিদিন ভোরে মৃত গোলাপের কফিন সরায়।

নয়নতারা

এদিকে, নয়নতারাকে ঘিরে আগারগাঁও কলোনিতে প্রজাপতির আবির্ভাবের কথা গোটা শহর জেনে যায়। উৎসুক জনতার ভিড় বাড়তে থাকে, সঙ্গে চীনাবাদাম-ঝালমুড়িওয়ালাদের আগমনও হয়।

ভিড় ঠেকাতে পুলিশ প্রহরা বসানো হয়। টানানো হয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে সাইনবোর্ড। কিন্তু ‘ধীরে ধীরে সোনার গয়নায় শ্যাওলার মতো’ আগারগাঁও কলোনির সুখ বিবর্ণ হয়ে যায়।

‘একদিন সন্ধ্যার পর শহর প্রবলভাবে ঝাঁকি খেয়ে কেঁপে ওঠে, কলোনির সব রান্নাঘর থেকে ঝনঝন করে তৈজসপত্র গড়াতে থাকে, মানুষজন চিৎকার করে নেমে মাঠের দিকে দৌঁড়ায়। এ দিনও আবদুস সাত্তার বারান্দায় বসেছিল; প্রথম ঝাঁকি খাওয়ার কয়েক মুহূর্ত পর চকিতে তার মনে হয় যে ভূমিকম্প হচ্ছে এবং সে নিচে নেমে যাওয়ার কথা ভাবে।

তখন দালানটি দ্বিতীয়বার প্রবলভাবে কেঁপে ওঠে এবং সে দেখতে পায় যে, রেলিংয়ের ওপর বসানো এবং দড়ি দিয়ে বাঁধা নয়নতারার টবগুলো দড়ি ছিড়ে পড়ে যাচ্ছে; সে দ্রুত অগ্রসর হয়ে, ঝুঁকে পড়ে স্থানচ্যুত দুটি টব দু’হাতে বগলদাবা করে আঁকড়ে ধরে।

কিন্তু ছুটে এসে বাইরের দিকে ঝুঁকে পড়া এবং দুটো ভারি টব আঁকড়ে ধরায় তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশের ওজন বৃদ্ধি পায়, ফলে রেলিংয়ের ওপর তার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়; টব দুটোকে তুলে আনার বদলে তার শরীর রেলিং টপকে টব দুটোর সঙ্গে নেমে যায়। আবদুস সাত্তারের পতন বোমা ফেলতে আসা বোমারু বিমানের মতো একেবারে খাড়া হয়েছিল।’

নয়নতারা

এবার গল্পটি শুরু হয়…

‘ভূমিকম্পে শহরের সাতাশটি দালানে ফাটল ধরে, রামপুরায় জলার ধারের একটি দালান কাত হয়ে যায় এবং আগারগাঁও কলোনিতে সকল নয়নতারা গাছ এবং আবদুস সাত্তার ভূপাতিত হয়। আবদুস সাত্তারের মাথার খুলি থেঁতলে গলার ওপরের প্রান্তে একটি রক্তাক্ত ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে, তার মগজ গলে মাটিতে মিশে যায়।

আবদুস সাত্তারের দাফন হয়ে যাওয়ার পর কলোনির শোকার্ত লোকেরা তাদের ধরাশায়ী নয়নতারা গাছগুলো পুনরায় রেলিংয়ের ওপর তুলে দেয়, কেবলমাত্র বিধবা শিরীন বানুর গাছগুলো নিচে মাটিতে পড়ে থাকে।

কয়েকদিন পর গাছগুলো পুনরায় সতেজ হয়ে ওঠে এবং প্রজাপতিরা ফিরে আসে, তখন শিরীন বানু একটু সুস্থ হয়ে ওঠে এবং মাটি থেকে নয়নতারা গাছগুলো তুলে নতুন পটে লাগায়; কিন্তু তার ওই গাছগুলো রেলিংয়ের ওপর সতেজ হয়ে ওঠার বদলে দ্রুত মরে যেতে থাকে।

এর পর কলোনির সকলে বিস্ময় ও আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করে যে, তাদের সতেজ হয়ে ওঠা নয়নতারা গাছগুলোর পাতা ক্রমান্তয়ে নেতিয়ে পড়ে এবং এক সপ্তাহের ভেতর সব গাছ মরে কড়ি হয়ে ওঠে’—কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেখা যায়, কেবলমাত্র যেখানে আবদুস সাত্তারের মগজ মাটিতে মিশে গেছিল সেখানেই নয়নতারা গাছ জন্মায়।

একদিন সিটি করপোরেশনের পিচ ঢেলে সেখানে রাস্তা বানালে—আর কোথাও নয়নতারা ফুল ফোঁটে না। এভাবে আগারগাঁও কলোনি নয়নতারা শূন্য হয়ে যায়।

শহীদুল জহির গল্পটিকে এমনভাবে আমার মগজের মধ্যে প্রোথিত করেছেন যে, আমার এখনো বিশ্বাস আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল ফোঁটে না। আগারগাঁও কলোনি ঘিরে এখন অনেক নার্সারি হয়েছে। মাঝে মাঝে গাড়ি থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে চাই কোথাও কি নয়নতারা ফুটল?

এই হলো শহীদুল জহির। আমার বিশ্বাস যতোদনি আগারগাঁও কলোনি আছে, ততোদিন নয়নতারাকে ভুলতে পারবো না। এভাবে শহীদুল জহির আগারগাঁও কলোনিকে এক তীর্থস্থানে পরিণত করেন। যেভাবে তিনি আরো অনেক তীর্থস্থান তৈরি করেছেন।

যেমন : ভূতের গলি, ভিক্টোরিয়া পার্ক, নাজিমুদ্দীন রোড, নারিন্দাসহ অসংখ্য স্থানকে এবং তাঁর রয়েছে নিজস্ত ভাষার নির্মিতি। মহল্লার-গলির এবং শহরের ভাষা মিলিয়ে তিনি তৈরি করেছেন নিজস্ব ভাষা।

নয়নতারা

লোকায়ত জীবন এবং শহরের অতি সাধারণ কথকতায় গল্প তৈরি করেন। যেন দেশজ লোকায়ত উপাদানে নতুন ধরনের আধুনিকতা তৈরি করেন তিনি। কখনো আক্রোশে, কখনো উচ্ছ্বাসে, কখনো চরম অসহায়ত্ব থাকে তার আখ্যানে।

তার ‌ভাষা ‘বাত্তি খোঁজে, তামাম দেশ-গেরামের আদলে ভূতেরগলিতে লৌড়ালৌড়ি করে’ ডাইলপুরি আলুপুরি খায়। নরম মাটি বা ধানের গন্ধের ইশারা নিয়ে জননীকে খুঁজতে ফুলবাড়িয়া যায়। যেন নির্দিষ্ট ঠিকানা খুঁজে না-পাওয়া পর্যন্ত থামবে না সে পথ চলা।

তাঁর চরিত্রগুলো জোরেও ধমক দিতে পারে না, কেবলই পতনশীল হয়। তার গল্পে একটা জাদুময়তার আবহ আছে অবশ্যই, তবে তিনি তার গল্পভাষা মানবজীবনের গন্ধ নিয়েই তৈরি করে গেছেন। লৌড়ানো, লাফালাফি, চাপা খায়া—শব্দের সঙ্গে অনায়াসে ব্যবহার করেন—কুত্তা, বিলাই, ইন্দুর। এভাবে তিনি পতনশীল মানুষের গতিশীল জীবনকে পূর্ণ মেজাজসহ বুনে যান।

বর্ণিল সব চরিত্র তৈরি করতেন তিনি। আর তাদের মুখের কথা—ডায়ালেক্ট নিয়ে তাঁর গল্প-উপন্যাসে কী যে অসাধারণ আখ্যান তিনি রচনা করেন, তা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা বোঝানো সম্ভব নয়।

কিন্তু এই আখ্যান কি তা কেবল কি একটি গল্প বলার জন্য? নির্মাণ করতেন যে বাস্তবতা তার মধ্যে কি নেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা উত্থান-পতনময় ঘটনা প্রবাহ! তিনি সমকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং একই সঙ্গে তাঁর স্বভাবসুলভ তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ দিয়ে ক্রমাগত বিদ্ধ করে গেছেন সুশীল সমাজ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বেনিয়বৃত্তির প্রবণতাকে।

সারা জীবন ধরে তিনি আমাদের জীবনের ছবি এঁকে গিয়েছেন এবং বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্য এক রূপকার।

শহীদুল জহিরের গল্প আমাদের শঙ্কিত করে, বিমোহিত করে। কখনো কখনো ক্লান্ত করে। সম্মোহিতের মতো আমরা নিজেরা ঢুকে পড়ি কাহিনীর ভেতর। কিন্তু পাঠক পাঠান্তে একই বোধের আওতায় থাকতে পারেন না। তারা ক্রমাগত নানামুখী সঙ্কট প্রত্যক্ষ করতে থাকেন।

তাঁর গল্পপাঠের এক সহজিয়া ব্যাপার আছে। যেন গল্প বলতে শেষ পর্যন্ত কিছুই থাকবে না। কিন্তু শেষমেশ একটা মোচর থাকেই। আশির দশকের মার্শাল ল—এ অঞ্চলের মানুষের জীবনকে নতুনভাবে গড়ে। কিছু মানুষকে নির্লজ্জের মতো সুযোগ-সুবিধা দেয়, গল্পকার তার প্রায় গল্পেই এটা বলে দিয়েছেন।

নয়নতারা

কেমন করে এ এলাকার জনসংস্কৃতির কাঠামো ভেঙে পড়ে। শহীদুল জহির বাংলা সাহিত্যের একজন গল্পকারের মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিত্ব। বাঙালির জাতিসত্তা, সংখ্যা লঘুত্বের অফুরান যন্ত্রণা, মুক্তিযুদ্ধের হিংস্র্রতা তার গল্পে হিমঘরের মতো ল্যাবিরিন্থ তৈরি করে।

১৯৮৫ সালে ‘মুক্তধারা’ থেকে তখন তিনি শহীদুল হক নামে লিখতেন। তার পরবর্তী গ্রন্থ ‘জীবন ও রাজিনৈতিক বাস্তবতা’ থেকে তিনি শহীদুল জহির নামে লিখেতে থাকেন। তিনি কি নিজেকে ভাঙতে থাকেন? যেমন করে তিনি গল্পের ছাঁচ বদলে দেন!

তাঁর লেখা পড়ে অনেকের লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কথা মনে পড়ে। তারা ‘চৈত্র-বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে দক্ষিণ মৈশুন্দি, নারিন্দা, বনগ্রাম, ওয়ারি, র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিট, জোড়পুল, ভূতের গলি, পদ্মনিধি লেনে তরমুজ বিক্রির লাল সবুজের বর্ণিল ঘুলঘুলাইয়ায় পড়ে যখন জানতে পারে তরমুজ ফ্যাক্টরি দেয়া হচ্ছে—নাম ‘হাজী ফুড কোম্পানি’ তখন তাদের মার্কেসের লিফ স্টর্মের কাথা মনে পড়ে।

কখনো তাদের আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা মনে হয়। কখনো মনে হয় ওরহান পামুকের কথা। শহীদুল জহির প্রচলিত অর্থে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না। সেটি হওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল বলেও মনে হয় না।

পাঠক তার লেখায় চিত্ত প্রীত করার চিন্তা করতে পারেন না। তাঁর লেখা পড়ে তাঁর সমসাময়িক লেখকরা তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, ‘শহীদুল নিজেকে দাবি করতেন ডিমান্ডিং লেখক হিসেবে; যিনি পাঠকের কাছ থেকে আশা করতেন চিন্তার সক্রিয়তা। জনচিত্ত জয় করার মতো আখ্যান তিনি লিখতেন না, বরং ঘটনাপ্রবাহে, ভাষায় প্রকরণে সর্বোপরি নির্মাণ শৈলিতে তুলে রাখতেন এক দুর্ভেদ্য দেয়াল। সেই দেয়াল সরিয়ে যারা ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছেন—তারাই কেবল সন্ধান পেয়েছেন প্রচুর মণি-মাণিক্য খচিত এ অচেনা জগতের।

রহস্যময় সব গল্প শোনাতেন তিনি আমাদের। রহস্যময়, কারণ তার গল্প ঠিকঠাক বুঝে ওঠা কঠিন। যদিও অজ্ঞাত কারণে পাঠকরা সেগুলো পছন্দ করেন। কেন পছন্দ করেন—এ প্রশ্ন বরাবরই তার পাঠকদের জন্য বিব্রতকর। সত্যি কথা বলতে কি আমি নিজে সবসময় তার লেখা বুঝে উঠতে পারিনি।’

এমন করে অনেকেই হয় তো তাঁর লেখা বুঝতে পারেননি, কিন্তু তাঁর পঠন থামেনি।

নয়নতারা

যে কথা না-বললেই নয়, তা হলো—শহীদুল জহিরকে বুঝতে হলে শহীদুল জহিরের লেখা পাঠ করতে হবে। অন্যের লেখা পড়ে তাঁকে চেনা যাবে না।

১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩ সালে শহীদুর জহিরের জন্ম। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘পারাপার’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। ১৯৮৭ সালে ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ প্রকাশিত হয়। ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ বলা নেই, কওয়া নেই—তিনি চলে গেলেন।

১৯৯৭ সাল থেকে তার লেখা একটু একটু করে চিনতে শুরু করেছিলাম। হোঁচট খেতে খেতে, ধাক্কা খেতে খেতে মোটামুটি যখন আত্মস্থ করে উঠতে পারছিলাম—তখনই তার প্রস্থান।

কারো কাছ থেকে শুনতাম তিনি অত্যন্ত অ-মিশুক, অ-সামাজিক। কারো কারো কাছে অত্যন্ত ঝকঝকে। আমার ভেতরে ভেতরে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতো, কোনো একদিন হয়তো কোনো এক বইয়ের দোকানে নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে।

যে মুহূর্তে আমি শুনলাম, ‘শহীদুল জহির আর নেই’। সে-সময় আমার হাত থেকে কলম পড়ে যায়। এমন করে আরো একদিন হাত থেকে আমার কলম পড়ে গিয়েছিল, যেদিন নাট্যগুরু সেলিম আল দীন মারা গেলেন।

খবরটা শুনে আমি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। সবার গন্তব্য যখন হাতিরপুল অভিমুখে, তখন আমি উল্টোপথে হাঁটা শুরু করি। আমার কেবলই আগারগাঁও কলোনি আর নয়নতারা ফুলের কথা মনে হয়। রোদের মধ্যে হেঁটে হেঁটে একটা বইয়ের দোকানে পৌঁছাই। কিনে ফেলি তার ছোটগল্প সংগ্রহ।

তার পর শাহবাগের সামনে থেকে একটি ডাবল ডেকার বাসে করে মিরপুরের দিকে রওনা দেই। কৃষি কলেজ পার হলেই আগারগাঁও স্টপেজ। আমি নতুন করে আগারগাঁও কলোনিকে চিনতে শুরু করি। আগারগাঁও কলোনিজুড়ে আমি যেন অজস্র প্রজাপতির উড়াউড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম।

শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে থাকুন...