‘তুই কে? ঠিক করে বল।’হিসহিস করে বলল উত্তম।
তার সামনে বসে থাকা তরুণটি হাসল।
‘আমি সৌমিক। তোর ক্লাসমেট।’
‘ক্লাসমেট! উড়ে এসে জুড়ে বসে এখন বলছিস তুই আমার ক্লাসমেট!’
‘আহা! চটছিস কেন। উড়েই আসি আর জুড়েই বসি, আসলে আমি তোর আর সাথীর ক্লাসমেট। বন্ধু।’
‘আর বাকিরা? ওরা তোর ক্লাসমেট নয়?’
‘আমরা সবাই ক্লাসমেট। তবে তুই আর সাথী হচ্ছিস আমার ঘনিষ্ঠ ক্লাসমেট।’
‘মোটেও না। আমি তোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু না। সাথীও না।’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল উত্তম।
‘তুই এত ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন? অবশ্যই তুই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’ হেসে হেসে বলল সৌমিক।
‘তুই যদি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুই হোস, তাহলে আমি অন্তত জানতাম—তুই কে, কোথায় তোর বাড়ি, আর কোথায় থাকিস তুই।’
‘জানবি। অত তাড়া কীসের!’ শান্ত ভঙ্গিতেই বলল সৌমিক।
মাত্র দিন পনেরো আগের কথা।
উত্তমের মনে পড়ল, ক্যান্টিনে বসে গল্প করছিল ও আর সাথী। তখনো নাস্তার অর্ডার দেয়া হয়নি। হঠাৎ হাসিমুখে একপ্লেট কচুরি হাতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এক তরুণ।
‘বসতে পারি?’ বলেছিল সে।
‘আমরা দুজন ক্লাসমেট এসে বসে পড়া নিয়ে ডিসকাস করছিলাম। আপনি অন্য কোনো…’
বলতে বলতে থেমে গিয়েছিল উত্তম। কারণ সামনে বসা তরুণটির চোখ দুটি অদ্ভুত। নীল। প্রাণোচ্ছ্বল। মায়াময়।
‘আমিও তোমাদের ক্লাসমেট। সৌমিক।’
‘আগে দেখিনি তো।’
‘দেখবে কীভাবে। আমি তো অসুস্থ ছিলাম। মাত্র কিছুদিন হলো হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি।’ করুণ স্বরে বলল সে।
তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, সাথী জিজ্ঞেস করেই বসেছিল, ‘আহা রে! কী হয়েছিল?’
‘সে কথা এখন থাক। আরেকদিন বলবো। আমি তোমাদের জন্য বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ গরম গরম কচুরি নিয়ে এসেছি। তোমরা খাবে কি না?’
‘আমরা তো খেতেই পছন্দ করি। তাই না উত্তম?’ বলে হাত বাড়িয়ে কচুরি নিয়েছিল সাথী।
রহস্য গল্প : বন্ধুত্ব : বিশ্বজিৎ দাস
উত্তম আর কোনো কিছু বলারই সুযোগ পায়নি সেদিন। এর পর থেকে সৌমিক ওদের সঙ্গী হয়ে থেকেছে বারবার।
হয়তো উত্তম একা বসে আছে লাইব্রেরিতে।
হঠাৎ সামনে এসে হাজির সৌমিক।
‘কী রে, সাথীর জন্য অপেক্ষা করছিস? ওর তো আসতে দেরি হবে। মাথায় শ্যাম্পু করছে।’
‘তুই কীভাবে জানিস?’
‘অনুমান বন্ধু অনুমান। তুই মিলিয়ে নিস।’
পরে সাথী বলেছিল, ‘ঐ সময় আসলেই শ্যাম্পু করছিলাম।’
এভাবেই কেমন কেমন করে আগে ভাগেই অনেক কথা বলে ফেলতে পারত সৌমিক।
বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে ভেনোম মুভি চলছে। সাথী মুভি দেখতে পছন্দ করে।
বলি বলি করেও সাথীকে মুভি দেখতে যাওয়ার কথা বলতে পারছিল না উত্তম।
সেদিন হঠাৎ সৌমিক এসেই বলেছিল, ‘চল, সবাই মিলে ভেনোম মুখি দেখে আসি।’
‘তুই দেখাবি বুঝি?’ সাথী জানতে চেয়েছিল।
‘অবশ্যই। তোমার জন্যই তো এই আয়োজন। অনলাইনে টিকেট পর্যন্ত করে এনেছি।’
‘কেন! আগে টিকিট কেন কেটেছিস? ক্লাস আছে না?’ সাথী বলেছিল।
‘ক্লাস আজ হবে না।’সৌমিক আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল।
পরে দেখা গেল সত্যিই ক্লাস হলো না।
শুধু মুভি দেখা নয়, সেদিন দুপুরে লাঞ্চ পর্যন্ত করিয়েছিল সৌমিক।
‘আজ তোর জন্য সময়টা ভালোই কাটল সৌমিক।’যাওয়ার আগে বলেছিল সাথী।
‘আজ আরো ভালো কাটবে তোর।’ বলেছিল সৌমিক।
‘কীভাবে?’
‘তোর খুব প্রিয়জন আজ তোকে ফোন করবে।’হেসে বলেছিল ও।
রহস্য গল্প : বন্ধুত্ব : বিশ্বজিৎ দাস
পরদিন উত্তমের সাথে দেখা হতেই সাথী বলেছিল, ‘ সৌমিকের কথা সত্যিই হয়েছে।’
‘কী সত্যি হয়েছে?’
‘আমার ছোটবেলার বান্ধবী মাইসা। লন্ডনে থাকে অনেকদিন ধরে। যোগাযোগ ছিল না। গতকাল রাতে ফোন করেছিল। সৌমিক আগে থেকে বলতে পারল কীভাবে।’
উত্তম জানে না।
কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেও ‘অনুমান করে বলছি’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে সৌমিক।
আজ সত্যিটা জেনেই ছাড়বে ও। সে জন্যই ওকে নিয়ে একটা চাইনিজ হোটেলে চলে এসেছে উত্তম। বলেছে—একটা পার্টি হবে।
‘ঠিক করে বল সৌমিক, তুই কে?’
হাসল সৌমিক। তার নীল চোখে কী যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল।
‘তুই কি সাথীকে ভালোবাসিস?’ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল উত্তম।
হো হো করে হাসল সৌমিক।
‘বন্ধু আমি সবাইকেই ভালোবাসি। তোকেও যেমন ভালোবাসি, সাথীকেও তেমনি ভালোবাসি।’
তার হাসি আরো ক্রুদ্ধ করে তুলল উত্তমকে। পকেট থেকে সুইস নাইফটা ঝট করে বের করল ও।
‘কী ব্যাপার। আবার ছুরি কেন?’ হাসি এতটুকু কমল না সৌমিকের মুখে। ভয়ের লেশমাত্র চিহ্ন নেই তার চোখেমুখে।
‘ছুরি কেন, এখনি বুঝতে পারবি?’ প্রচণ্ড রেগেমেগে বলল উত্তম।
টিপে ছুরির ফলা খুলল ও। সোজা বসিয়ে দিল সৌমিকের দু’চোখের মাঝে।
কিন্তু ছুরিটা ঢুকলই না। কোথায় যেন আটকে গেল।
উত্তম টের পেল, প্রচণ্ড একটা শক্তি বাধা দিচ্ছে।
সৌমিকের কপালের সামনে গিয়ে ছুরি আটকে গেছে। কোনোভাবেই আর এগুচ্ছে না।
প্রচ- শক্তি খাটালো উত্তম। ছুরি এক ইঞ্চিও এগুলো না।
সৌমিক হাসল।
‘তুই যে এমন করবি, আমি আগেই তা জানতাম।’
প্রচণ্ড রাগ চেপে বসল উত্তমের মাথায়। আরো জোর দিলো ছুরির হাতলে।
মুখের হাসি দপ করে নিভে গেল সৌমিকের। গম্ভীর হয়ে গেল তার মুখ।
অমনি উত্তম টের পেল, তার হাতে ধরা ছুরির ফলা ধীরে ধীরে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। একবার ছুরি আরেকবার সৌমিকের মুখের দিকে তাকাল উত্তম।
ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পেল ও। শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। ছুরি ছেড়ে দিয়ে দু’কান চেপে ধরল উত্তম।
সৌমিকের হাসি দেখতে পেল ও।
হাসছে।
দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করল উত্তমের।
কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই সামনের টেবিলে মাথা রেখে জ্ঞান হারাল।
দুই
‘জ্ঞান ফিরেছে?’ জানতে চাইল সাথী। এইমাত্র কেবিনে ঢুকেছে ও।
‘না। তবে ফিরবে। ডাক্তার বলেছে, ভয়ের কিছু নেই।’ সৌমিক বলল।
‘কী হয়েছে ওর?’
‘মাথায় আঘাত লেগেছে।’
‘মাথায়! কোথায়? কীভাবে?’
‘উত্তম আমাকে চাইনিজে দাওয়াত দিয়েছিল। সেখানেই হঠাৎ কীভাবে যেন টেবিলের উপর পড়ে গেল। কেন পড়ল বুঝতে পারিনি।’
‘মানে। তুই সাথে ছিলি আর বলছিস দেখিসনি কোনোকিছুই।’গলা চড়ে গেল সাথীর।
‘আস্তে।’ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারা করল সৌমিক।
দু’জনেই বরান্দায় এসে দাঁড়াল।
রহস্য গল্প : বন্ধুত্ব : বিশ্বজিৎ দাস
‘পরশুদিনই আমাকে উত্তম বলেছিল, তোর ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার জন্য।’ সাথী বলল।
‘সতর্ক! কেন?’ হাসল সৌমিক।
‘উত্তম বলেছিল, হঠাৎ করেই উড়ে এসে জুড়ে বসেছিস তুই আমাদের জীবনে। তোর কার্যকলাপ বেশ রহস্যময়।’
‘রহস্যময়। আমি আবার কী রহস্য করলাম?’
‘তুই অনেককিছু আগে থেকেই বলতে পারিস। আর উত্তম যে টেবিলের উপর পড়ে যাবে—সেটা তুই আগে জানতে পারলি না?’ তীক্ষ্মচোখে সৌমিকের দিকে তাকাল সাথী।
সৌমিকও তাকিয়ে রইল চোখে চোখ রেখে।
বেশ কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল নীরবে।
‘ওকে। বল তুই কী জানতে চাস?’ হার মানল সৌমিক।
‘তুই কে?’
‘আমি সৌমিক। তোদের বন্ধু।’
‘সেটা তোর কথা। আমরা তোকে বন্ধু নাও মনে করতে পারি। আমরা তো তোকে ভালোমতো চিনিও না।’
‘ওকে বাবা ওকে। বল তুই কী জানতে চাস?’ সৌমিক হাসল।
তার নীল চোখে কী যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল।
‘তুই আসলে কে? কোথা থেকে এসেছিস?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল সাথী।
‘আমি…।’ দ্বিধা করল সৌমিক।
‘বল। খুলে বল।’
রহস্য গল্প : বন্ধুত্ব : বিশ্বজিৎ দাস
‘আমি লাচিন গ্রহ থেকে এসেছি।’
‘লাচিন! জীবনেও তো এই নাম শুনিনি।’
‘শোনার কথাও নয়। আমাদের গ্রহের সাথে পৃথিবীর যোগাযোগ নেই।’
‘যোগাযোগ নেই তো এলি কীভাবে?’
‘এসেছি আমাদের স্পেসশিপে চড়ে। মাসখানেকের জন্য। একটা স্টাডি করব। তার পর আবার ফিরে যাবো।’
‘কীসের স্টাডি। তুই কি ওখানকার ছাত্র?’
‘নাহ্! আমি ওখানে একজন গবেষক। গবেষণার তথ্য নিতেই তো পৃথিবীতে আসা।’
‘কীসের গবেষণা?’
‘বন্ধুত্ব! পৃথিবীর মানুষের মাঝে বন্ধুত্ব, তার গভীরতা, ঈর্ষা, আস্থা—ইত্যাদি জানার জন্যই আমি পৃথিবীতে এসেছি।’
‘কী জানতে পারলি?’ সাথী জানতে চাইল।
সৌমিক হাসল। সাথীর চোখ আটকে গেল। মানুষ এতো সুন্দর হাসতে পারে।
‘উত্তম তোকে খুব ভালোবাসে। সে তোকে খুব সুখী করবে।’হাসতে হাসতে বলল ও।
‘আর তুই? তুই আমাকে ভালোবাসিস না?’
হাসল সৌমিক।
‘কী হলো? উত্তর দিচ্ছিস না যে?’ অধৈর্য হয়ে জানতে চাইল সাথী।
বাইরের অন্ধকারে চাইল সৌমিক। উত্তর দিল না।
‘কী হলো? কিছু বল?’
‘আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে সাথী।’
‘আমি চলে যাচ্ছি।’
‘চলে যাচ্ছিস মানে। কোথায় যাচ্ছিস?’
‘আমি আমার গ্রহে ফিরে যাচ্ছি।’
‘আর তোর গবেষণা? তার কী হবে?’
‘সব গবেষণা যে সম্পূর্ণ করতে হবে, তার কোনো মানে আছে। এ গবেষণার কার্যক্রম, আপাতত স্থগিতই থাক।’
‘আর উত্তম যদি জানতে চায়, তুই কোথায়, তখন আমি কী জবাব দেব?’ নিজের কানেই গলাটা ভেজা ভেজা শোনাল সাথীর।
‘ও তোর কাছে কিছু জানতে চাইবে না।’
‘কেন?’
‘আমি ওর মেমোরি থেকে আমার অংশটুকু মুছে ফেলেছি। উত্তম তোর কাছে কিছু জানতে চাইবে না।’
‘আর আমি। আমি কী করে তোকে ভুলব? বলতে পারিস? এসেছিস তো অল্প সময়ের জন্য। এই অল্প সময়েই তুই আমার কত আপন হয়ে উঠেছিলি। তুই না এলে উত্তম কি কখনো আমাকে তার ভালোবাসার কথা বলতে পারত?’ সাথী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
সৌমিক কিছু বলল না। তার দু’চোখে জল।
রহস্য গল্প : বন্ধুত্ব : বিশ্বজিৎ দাস
‘তুই আমার মেমোরিও মুছে দিয়ে যা। আমি তোকে মনে রাখতে চাই না। চাই না।’কাঁদতে কাঁদতে বলল সাথী।
সৌমিকের খুব ইচ্ছে হলো সাথীকে কাছে টেনে নিতে। আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।
হাত বাড়ালও।
তার পর হাত গুটিয়ে মাথা নিচু করে সাথীর সামনে থেকে চলে এল সৌমিক।
উত্তমের জ্ঞান ফেরেনি।
কেবিনের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে চাইল সৌমিক।
সাথী দাঁড়িয়ে আছে।
একা।
চোখের কোণে পানি।
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা
সুনীল শর্মাচার্যের দশটি কবিতা
নাসিমা খাতুনের কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের কবিতা