খুচরো কথা চারপাশে
বর্তমান ভারত
সুনীল শর্মাচার্য
বর্তমান ভারত
মাসতুতো ভাই
ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে একচ্ছত্র হয়ে দীর্ঘদিন রাজত্ব করার লক্ষ্যে—এক গভীর ষড়যন্ত্র, এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেছে। সেই লক্ষ্যেই মিমকে প্রশ্রয় দিয়েছে বিজেপি। ‘সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন’, সংক্ষেপে মিম। প্রধান কার্যালয় আঘাপুর, হায়দরাবাদ, তেলেঙ্গানায়।
নবাব মাহমুদ নওয়াজ খান ৯৩ বছর আগে এই দলটির প্রতিষ্ঠা করলেও, দীর্ঘদিন হায়দরাবাদের মধ্যেই এ সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে মোদি সরকার আসার পর থেকে আসাদুদ্দিন ওয়াইসির নেতৃত্বে প্রসার নজর কাড়ে। পা বাড়ায় মিম তেলেঙ্গানার বাইরে। এখন পশ্চিমবঙ্গেও জেলায় জেলায় সংগঠনের মিটিং এবং সদস্য সংগ্রহ শুরু হয়ে গেছে।
এ-কথা সর্বৈব সত্য যে, স্বাধীনতার পরবর্তী কালে ভারতে সাধারণ মুসলিম সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক উন্নতি যেভাবে হওয়া উচিত ছিল সেভাবে হয়নি। তাই মিমের মতন একটি বিশুদ্ধ সাম্প্রদায়িক দল তার সুযোগ নিতে পারছে।
কংগ্রেস হীনবল হওয়ার পর আঞ্চলিক দলগুলিই বিজেপির একমাত্র প্রতিপক্ষ। আর এই আঞ্চলিক দলগুলি নানা রাজ্যে মুসলিম ভোটের ওপর নির্ভরশীল। তাই মিম যে রাজ্যে ঢুকবে, সেখানকার আঞ্চলিক দলের মুসলিম ভোট কমবে, এটা পরিষ্কার হিসেব।
অন্যদিকে, সব কেন্দ্রেই সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে বিজেপির নির্দিষ্ট কিছু ভোট আছে। সেটা সেই কেন্দ্রের মোট ভোটের অনুপাতে কম হলেও, বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে গেলে জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ সদ্য শেষ হওয়া বিহারের বিধানসভা ভোটে দেখেছি। বেশ কিছু আসনে বিজেপি প্রার্থীর জয় শুধুমাত্র মিমের ভোট কাটার জন্যই সম্ভব হয়েছে। গেরুয়া শিবিরের মাসতুতো ভাই এরা। সেই কারণেই ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে মিম বা সহযোগী শক্তির উত্থানকে ত্বরান্বিত করতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে বিজেপি।
সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরির চেষ্টা চলছে, মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নয়ন মুসলিমদের নিজস্ব রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই সম্ভব। কিন্তু এতে অদূর ভবিষ্যতে তাঁরাই সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। আর যাঁরা সংবিধান রক্ষার জন্য, ভারতকে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়বেন, সবচেয়ে বেশি অত্যাচার নেমে আসবে তাঁদের ওপর।
ইতোমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের এনআরসি, ক্যা, কৃষি আইন, শ্রম আইন ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে যে-সব প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর গর্জে উঠেছে—তাদের ওপর চরম অত্যাচার নেমে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জঙ্গি, দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে।
দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র করার পরিকল্পনা জোর কদমে এগোচ্ছে। ‘বিবিধের মাঝে মিলন’ ভারতের মর্মকথা। একে প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে বিজেপির মতো মিমকেও প্রত্যাখ্যান করার কথা ভাবতে হবে।
বর্তমান ভারত
স্মৃতির লড়াই
ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইটা হলো বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই। —‘দ্য বুক অফ লাফটার এণ্ড ফরগেটিং’, মিলান কুন্দেরা
.
দেশের প্রথম নাগরিক অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণে পাঁচ লক্ষ এক হাজার একশো টাকার চেক দিলেন শ্রী রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টকে। ভাবা যায়, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির এহেন দানধ্যান! না, ভাবা প্র্যাকটিস করতে হবে। সবই সম্ভব।
অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণে সরাসরি ব্যাংক পরিষেবা নিয়ে হাজির হলো ভারতের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক—স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। এও কী ভাবনায় ছিল? ছিল না তো। ট্রাস্টকে চেকে বা ক্যাশে যেন টাকা জমা দিতে কোনো সমস্যা না হয়, তার জন্য নির্দেশ জারি করেছে এসবিআই।
ছাপিয়ে ফেলা হয়েছে আলাদাভাবে নকশা করা বিশেষ ডিপোজিট স্লিপ, তার জন্য প্রতিদিনের ব্যাংকে নগদ অর্থ জমা দেওয়ার ঊর্ধ্বসীমাও তুলে দিল এসবিআই। মকুব করা হয়েছে সমস্ত ধরনের ব্যাঙ্কিং চার্জ। এমনকি টোল ফ্রি পরিষেবাও চালু হয়েছে।
ডিপোজিট স্লিপে লেখা রয়েছে—শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের নাম, উল্লেখ করা হয়েছে ট্রাস্টের প্যান নম্বর। এর পরও ছাতির গর্বে দেশবাসী গর্বিত হবে, না ছাতি চুপসে যাবে? আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা বিস্মৃতিতে তলিয়ে গেলে, স্মৃতি কি লড়াই চালাবে ক্ষমতাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে?
‘চোখ মেলে তাকাতে মানুষের কত শতাব্দী লাগে? আগামীর দোরগোড়ায় পৌঁছোতে ক’হাজার জেলের সেল মানুষকে পেরোতে হয়?’ হিটলার অধিকৃত চেকভূমিতে গেস্টাপোদের হাতে ধরা পড়ে ফাঁসিতে যাওয়ার আগে কথাগুলো বলেছিলেন জুলিয়াস ফুচিক।
আজ ভারতের সমস্ত মানুষের চোখ মেলে তাকানোর সময় হয়েছে। শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে। অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। মোদি-শাহদের বলতে হবে, ‘আমরাও দেখব তুমি কতদিন এইভাবে রাক্ষস নাচাও’ (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)!
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প: সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হাল্কা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
রাজনীতি বোঝো, অর্থনীতি বোঝো! বনাম ভারতের যুবসমাজ
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
ভারতের CAA NRC নিয়ে দু’চার কথা
9 thoughts on “বর্তমান ভারত”