খুচরো কথা চারপাশে
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
সুনীল শর্মাচার্য
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
অমর্ত্য সেন। এই নামটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা অনেক বাঙালিই জানেন না। ভারতেরও অনেকেই জানেন না যে—বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্থনীতির সেরা গবেষকরা শুধুমাত্র অমর্ত্য সেনের ভাবনা ও তাঁর অবদান নিয়ে অন্তত পঞ্চাশটি বই লিখেছেন।
বইগুলোতে তাঁরা আলোচনা করেছেন কেন অমর্ত্য সেনের অর্থনীতি ভাবনা—এই বিশ্বের সব মানুষের সুস্থ জীবন গড়ে তোলার একটা হাতিয়ার। সাম্প্রতিক কালে আর কোনো ভারতীয়ের সমাজচিন্তা নিয়ে গোটা পৃথিবীতে এতবেশি তোলপাড় হয়েছে কিনা সন্দেহ।
অমর্ত্য সেন কখনো নিজেকে বামপন্থী বলে দাবি করেননি। তবে বিশ্বে যতদিন ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও হিংসা থাকবে, ততদিন তার মোকাবিলায় কী করা উচিত—সে-বিষয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তা আলোচিত হবে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই দেশে তাঁকে মনে রাখা হয় শুধুমাত্র অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কারণে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি দরকার ছিল তাঁর ভাবনার আদলে এই দেশকে গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
সমাজের সব মানুষের ভালো থাকার পথের দিশা নির্ধারণে তাঁর অবদান নিয়ে চর্চা হয় উন্নত দুনিয়ায়। আর আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দেশের কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর মতো মানুষের মতপ্রকাশের পথই বন্ধ করে দেন।
যাঁর বাসভবনকে ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান হিসেবে ঘোষণা করা উচিত ছিল সরকারের, তার বদলে তাঁকে অসম্মান করার মতো ঔদ্ধত্য দেখানোটাই বেশি কৃতিত্বের পরিচয় বলে মনে করে কেন্দ্রের শাসক দল।
সে-কাজে হাতিয়ার করা হয় শান্তিনিকেতনে তাঁর বাসভবনের জমিজমা সংক্রান্ত ভিত্তিহীন অভিযোগকে। বিশ্বভারতীর আজকের যে অবস্থান ও মর্যাদা—তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত অমর্ত্য সেন এবং তাঁর পরিবার, এ-কথাটাই তাঁরা ভুলিয়ে দেওয়ার নোংরা খেলায় নেমেছেন।
অমর্ত্য সেনের প্রতি কেন এত খড়গহস্ত কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক বিজেপি? কারণ তিনি শুধু মাত্র এই সরকারের অর্থনীতি ভাবনার অসঙ্গতিই স্পষ্ট করে দেননি, কেন্দ্রের বর্তমান সরকার ও শাসকদল যে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক ঐক্য ধ্বংস করছে এবং গণতন্ত্র ও সংবিধানের ভিত্তিমূলে আঘাত করছে, সে নিয়েও তিনি সোচ্চার হয়েছেন মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই।
সেই কারণেই তাঁর ওপর এই আক্রমণ। বিজেপির আইটি সেলের কাজই হলো অমর্ত্য সেনের নিন্দা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত পোস্ট করে যাওয়া। দুর্ভাগ্য এই যে স্বল্প সংখ্যক বাঙালিও তাতে শামিল।
এটা কি শুধুই অমর্ত্য সেনের ওপর আক্রমণ? না। আসলে এটা বাঙালির সার্বিক অবক্ষয়েরও নিদর্শন। এর পেছনে রয়েছে বিশ্বায়নের তীব্র ভোগবাদী দর্শন ও সংস্কৃতি—যা রবীন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দের আদর্শবোধ-সঞ্চাত বাঙালির মূল্যবোধের একেবারে বিপরীত।
এই ধারা ক্রমশ বাঙালিয়ানাকে নষ্ট করেছে, ডেকে আনছে উচ্ছৃঙ্খলতা, নিজের সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা ও অর্থ-সর্বস্ব সামাজিক পরিমণ্ডল। প্রগতিশীল মানবিক সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বাস হারানোর পাপেই যে বাঙালির এই সঙ্কট, আজ সেটা প্রমাণিত।
আর এরই সুযোগ নিচ্ছেন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধারক-বাহকেরা। সেই সুযোগে অমর্ত্য সেনকে গালি দেওয়াটা দলীয় আনুগত্য প্রকাশের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে মনে করেন মুষ্টিমেয় কিছু বাঙালি।
বাংলাকে ভালোবাসি স্লোগানের আড়ালে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এত আগ্রাসী কোনো রাজনৈতিক দল আগে কখনো বাংলার মানুষ দেখেননি। রবীন্দ্র দর্শন, রবীন্দ্র ভাবনা, রবীন্দ্র শিক্ষা ও সংস্কৃতির তীর্থ যে শান্তিনিকেতন, অমর্ত্য সেন তার উজ্জ্বল উত্তরাধিকার।
আজ যখন তাঁকেই আক্রমণের লক্ষ্য করে তোলা হয়, তখন বুঝতে হবে আক্রমণ করা হচ্ছে গোটা বাঙালির অস্তিত্বকে। আগ্রাসী হিন্দুত্বের রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণের জন্য এ হলো প্রচ্ছন্ন এক হুমকি।
সেলুলার জেল থেকে সমস্ত বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী শহীদদের নাম মুছে ফেলা হয়েছে—যে কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তে, অমর্ত্য সেনের বাসভবনের জমি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সঙ্গে তার যোগ রয়েছে।
বাঙালির অস্তিত্ব আরো বিপন্ন হবে যদি এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায়। এক্ষেত্রেও ভোটের রাজনীতির সমীকরণে বাঙালি যদি নিজেকে টুকরো টুকরো করে ফেলে, তাহলে তার চাইতে বড় দুর্ভাগ্য আর কিছু হবে না!
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প: সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হাল্কা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
রাজনীতি বোঝো, অর্থনীতি বোঝো! বনাম ভারতের যুবসমাজ
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
14 thoughts on “ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত”