যে মুঠোফোন বাজবে বলে বাজেনি
রওশন রুবী
যে মুঠোফোন বাজবে বলে বাজেনি
হাত বাড়িয়ে রুগ্ন হাতটি ছুঁলাম।
—কখন যাবে।
—ঘণ্টাখানেক থাকি?
আঙুলে চাপ পড়লো মৃদু। বুঝলাম সম্মতি। লোকজন আসছে যাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। বেডের পাশের চেয়ার ছেড়ে সোফায় বসলাম। একটা জাতীয় দৈনিকে মন দেবার বৃথাই চেষ্টা। খানিক্ষণ টিভির দিকে মুখ। দম আটকে আসছে। একটু ফাঁকা হলে বলে নিচ্ছি ডুবে যাবার কথা। চাঁদ সমুদ্র ঢেউ, প্রজাপতি, গাঙচিলের কথা। সর্বোপরি একা হয়ে যাবার কথা। যে কথা শুনলে ওর মন বাঁচার জন্য আকুল হয়ে উঠবে। একজন রোগীর মনোবল ঔষধের চেয়েও কার্যকর ভূমিকা রাখে। কারণ মন মরে গেলে দেহের মরণ হয় সর্বাগ্রে। মন সতেজ থাকলে দেহও সতেজ থাকে।
ও হাসছে অভিযোগ, অভিমান করছে। আমি কলকল। কেউ এলে নিশ্চুপ। যেন কত দূরের কেউ। যেন খোঁজ পেয়ে কেউ একজন দেখতে এসেছে। এমন অনেকেই আসছে। কে অত কাকে মনে গেঁথে রাখে?
এর মধ্যে রুমে ঢুকলো নিনাদের বন্ধু উপল সেনের সাথে দু’জন। তিনি আমাকে চেনেন। আমার নিনাদের বিষয়টি জানেনও। নিনাদ তার সাথে দেখা করাতে নিয়ে গেছে দু’বার। উপল সেনের কাছে আমার ফোন নম্বরও আছে। তবে কখনো তিনি ফোন করে উঠতে পারেননি। বন্ধুর হবু বউকে অযথা কেনই-বা ফোন করবেন। যথেষ্ট স্মার্ট, রুচিশীল এবং ভদ্র তিনি। খুব কম কথা বলেন। এখন নিজেই বললেন
—কেমন আছেন?
—আছি। আপনি?
—হুম। কখন এলেন?
—ঘণ্টা পেরিয়েছে।
অন্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘আমাদের বন্ধু দিবা।’ উনি একটা ব্যাংকে আছেন। ‘আমাদের’ মানে নিনাদ, উপল আর আমি। বেশ লাগল। পরিচয়টা দিতে গিয়ে তিনি সাবলিল ছিলেন। হোঁচট খাননি। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। আমাদের সমাজে মেয়ে বন্ধুদের এভাবে পরিচিত করতে অনেকেই কুণ্ঠিত হয়। বন্ধু শব্দটি উচ্চারণই করে না। বলে পরিচিত। মানুষের মন ক্ষণিকেই রঙ বদলায়। এখন আমার মনের রঙ বদলে শরতের আকাশ।
বেশ ক’দিন ধরে নিনাদের শরীর ভালো নেই। ওকে দেখতে আসবো, আসছি করেও সময় নিচ্ছিলাম। ওর সাথে প্রতিনিয়ত ফোনে বা ম্যাসেঞ্জারে কথা হচ্ছে। কথা বলতে ঐটুকু ‘ডাক্তার চেকাপ করে কী রিপোর্ট দিলো? খাবারের মেনু চেঞ্জ করল কি-না? বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে কি-না? বাড়ি থেকে কে থাকতে আসবে এ-বেলা, ও-বেলায় কে ছিল। আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে?’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।
উপল সেনের সাথে যারা এলো, সবাই বেরিয়ে গেলেন। একেরপর এক লোকজন আসছে। দু’দণ্ড কথা বলার জো নেই। কেউ কারোর দিকে তাকিয়েও থাকছি না। শুধু দু’একবার সবার দিকে সবাই যেমন তাকায়। একজন মৃত্যুপথযাত্রীর সাথে দেখা করতে এসেও কেমন অভিনয়! একটা কাগজের সইয়ের চেয়ে সমাজের কাছে মনের গভীরতা হালকা কত। সেটুকু অনুধাবন করছি। দগদগে ক্ষত নিয়ে দেখছি নতুন মানুষগুলোকে। কাউকে চিনবার কথা নয় আমার। আমাকেও কেউ চিনছে না। সবাই কেবল এসেই অবাক হয়ে তাকায়। একজন অচেনা মেয়ে নিনাদের রুমে। অন্য যারা আসছে সবাই সবার চেনা। মেয়েরা সাথে করে বরকেও নিয়ে আসছে। কেন যে ভীষণ বিব্রত লাগতে শুরু করলো। মনে হতে লাগলো একটা কাগজের এতোই প্রাইভেসি?
আটকে রাখেনি কেউ। অযাচিতের মতো আটকে গেলাম যেন। যে আটকে রেখেছে সে মায়া। মায়াটা আমাদের সেন্টমার্টিনে প্রথম দেখা হওয়া থেকেই শুরু হয়েছে। আমি গিয়েছিলাম বোনের পরিবারের সাথে। ও ওর বন্ধুদের সাথে। আমি স্বাধীনচেতা। পরিবারের সাথে গিয়েও একা একাই ভালো লাগা উপভোগ করছি। খুব ভোরে সমুদ্রের কোলে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। রাতে বেলাভূমির ফসফরাস দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বিকেলে জেলিফিসের খণ্ড পা দিয়ে আলতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব নিয়েছি। বুঝেছি, জীবের জীবন না-থাকলে অস্তিত্ব নিয়ে যে কেউ খেলতে পারে। আবিষ্কার করেছি ‘বেলাভূমিতে ঢেউ এসে ফিরে গেলে যে ফেনা থাকে। সেগুলোতে মানুষের প্রতিবিম্ভ পড়ে।’ কি অপূর্ব এ বিষয়টি। ক্যামেরা বন্দী করে রাখলাম। সেখানকার হতদরিদ্র মাঝি পরিবারের শিশুদের সাথে কথা বললাম। দুপুরে দাঁড়িয়ে রোদেপোড়া সমুদ্রের নীল জলের লাস্যময়তা উপভোগ করলাম। সারি সারি কেয়া গাছের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি ওদের। পাশ থেকে কেউ একজন বললো,
—ভাবছেন এ-গাছগুলো কেন এতো বেশি এখানে? এরা সমুদ্রের ঢেউ বুকে নিয়ে মাটিকে রক্ষা করে।
আমি ফিরে অবাক হলাম। সুদর্শন একজন মানুষ। আমার দিকে তার মুঠোফোন বাড়িয়ে দিয়ে ভনিতা ছাড়াই বললেন,
—আরে অবাক হবার কিছু নেই। আপনিও পর্যটক, আমিও। নিন আমাকে এখানে দুটো ছবি তুলে দিন। বন্ধুদের সাথে এসেছি। ওরা ঘুমাচ্ছে। আমি অত ঘুমাতে পারি না। ভোরের সমুদ্র আমাকে টানে।
আমি না-করতে পারলাম না ভদ্রলোককে। কয়টি ছবি তুলে দিলাম। ছবি তুলতে তুলতে টুকটাক কথাও হলো।
তিনি বললেন,
—চা বা কফির অভ্যেস আছে তো?
আমি হাসলাম। আমরা একটি স্টলে সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি, আর সমুদ্রের হাওয়া নিচ্ছি। তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—আমি নিনাদ। বগুড়ার ছেলে। ঢাকায় বাস।
আমি বলাম,
—দিবা। রংপুর।
তার মুঠোফোন দিয়ে দিয়েছি। তিনি ছবি দেখে বললেন,
—ছবিগুলো আমার বেস্ট ছবি হয়েছে।
—তাই?
—হুম। দেখবেন?
—দেখি।
—আপনাকে এই তিনদিন আমি দেখছি। একা একাই ঘোরেন। আপনার সাথে পরিবার আছে দেখলাম। তারা কি আমার বন্ধুদের মতো?
—আসলে একা ঘুরলে প্রগাঢ়ভাবে ধারণ করা যায় প্রকৃতিকে।
—তাই বুঝি!
—জানি না। আমি একা হয়ে যাই ইচ্ছে করেই।
—বেশ। আমি কৃতজ্ঞ।
—কেন?
—ছবি তুলে দিলেন, একাকী সময় থেকে কিছু দিলেন, কথা বললেন, একসাথে চা খেলেন; সে জন্য।
—আপনি নেহায়েত ভদ্রলোক তাই।
—মনে থাকবে আমার। হয়তো আর যোগাযোগ হবে না। দেখাও না। তবু ছবিগুলো থেকে যাবে।
আমি হাসলাম। ভাবলাম ন্যাকা নম্বর চাইছে। ভদ্রলোক বলে সরাসরি বলতে পারছে না। আচ্ছা নম্বর দিলে কী হবে? খুটে তো খেয়ে ফেলতে পারবে না। দিয়ে দেই।
—যোগাযোগ করতে চাইছেন স্বল্প পরিচয়ে?
—সমস্যা মনে হলে থাক।
—সমস্যা মনে হচ্ছে না। চলুন আরেকটা চা খেয়ে ফিরি। তার আগে নম্বরটা রাখুন যদি ঢেউয়ে ভেসে যাই। জানবেন সমুদ্রের তলে কোথায় অবস্থান।
—তা ঠিক বলেছেন। দিন।
এরপর মাঝেমাঝেই কথা হতো। তিন বছরজুড়ে কথা। দেখা মাত্র চারবার হয়েছে। নিনাদ বাড়িতে বলবো বলবো করেও বলছে না বলে বিয়ে করা হয়ে উঠছে না।
নিনাদের মুখটা কালো হয়ে উঠলো। বুঝলাম ও টেনশান করছে আমার উপস্থিতি নিয়ে। চোখ ইশারায় বললাম চলে যাবো? ও চোখের পাতা বন্ধ করে অনুমতি দিলো। তবু মন বলে আরেকটু থাকি। হয়তো আর দেখা হবে না। কথা হবে না। এভাবে ক’দিন থাকবে, কে জানে। চলে যাবার কথা ভাবলেই তীর তীর করে শিহরণ ওঠে বুকে। ভাবলেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। চোখ আড়াল করতে ভেজা টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে নেই। ওর মুখটাও মুছে দেই। ও নির্লিপ্ত চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। যেন যে কোনো সময় কেঁদে ফেলবে।
নিনাদ যদি জানতো এ-জীবনে আমাদের এই শেষ দেখা। তবে বলতো, ‘সমাজ জাহান্নামে যাক। তুই আমার হাত ধরে বসে থাক। তুই থেকে যা দিবা। একসাথে থাকি বাকি মুহূর্তগুলো। গোল্লায় যাক সব—সব।’ মনে মনে বলি নিনাদ যেখানে থাকিস, ভালো থাকিস।
গেল দু’মাস থেকে হাসপাতালে ভর্তি। ওর ব্রেইন টিউমারটা ক্যান্সার হয়ে বড় নাজুক অবস্থায় আছে। যে কোনো সময় একটা অঘটন হতে পারে। এবার সত্যি বিদায় নিবো ভেবে স্থির করলাম। তার আগেই ও বললো,
—কখন যাবে?
—এই তো যাচ্ছি।
ওর চোখ টলটল করে। আমি ওর ব্যর্থতা অনুভব করলাম। ইশারায় বললাম ফোন দিও। ও সামনের দিকে তাকিয়ে মাথা কাত করলো। ফের বললাম, দিও কিন্তু।
ও ফের মাথা ঝাঁকালো।
বেরুবার মুখেই উপল সেন ফের এলেন। বললাম, একটু এগিয়ে দিবেন?
দু’জন লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে। লিফটের দরজা খুলে গেলে তনুশ্রী বেরুলো। ও আমার সহপাঠী। নিনাদের বন্ধুর বউ। টেনশনে অথবা এখানে আমাকে কল্পনাই করেনি, তাই লক্ষ্য করলো না । যেমন নিনাদও বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল দেখে। তনুশ্রী পাশ কেটে যেতে যেতে পেছনে এলো এক পা। বললো,
—কেমন আছেন উনি? তুই কখন এলি?
আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। ও কি বুঝলো কে জানে। ও আমার ডান বাহুতে হাত রাখলো। ওর হাতের মৃদু চাপে চোখে বাঁধ দেয়া জল বাঁধ ঠেলে বেরিয়ে এলো।
আবার লিফটের দরজা খুলে যায়। উপল সেন তাড়া দিলেন। ভেতরে এক পা দিতেই মনে হলো নিনাদ ডাকছে আমাকে। আমি চমকে পা বের করে আনি। বেখেয়ালে প্রায় উনার গায়ে পড়ার অবস্থা। তিনি দ্রুত সরে দাঁড়ালেন। বলে উঠেন, ‘দেটস ওকে দিবা?’
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। সব হারিয়ে ফেলার বেদনা—চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। পারছি না। না-পারাটাই শত্রু আমার। ভাবলাম বলি, ‘উপল সেন, আপনি একটু দাঁড়ান প্লিজ! আমি আর একবার ওকে দেখে আসি?’ পারলাম না। গলার ভেতর কাঁটার মতো আটকে রইল কথাটা।
সপ্তাহ পার হলো মুঠোফোন বাজেনি। নিনাদ আমাকে কোনো কথা দিলে তা শত কষ্টেও রাখে। কিন্তু এবার কথা রাখছে না। বুঝলাম ভীষণ ভীষণ খারাপ আছে সে। মুঠোফোন নেড়ে চেড়ে রেখে দেই। বাজে না। বাজেই না। অসহ্য লাগে। তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করে সব। আইনজীবী বাবা দুপুরে খেতে খেতে বললেন,
—মা, আর সময় নিও না। যদি কিছু ভাবনা থাকে, তবে দ্রুত তোমার মতো করেই সেটেল করো।
—বাবা, তোমাকে যে নিনাদের কথা বলেছি। সে এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
মা প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছিলেন। কথাটি শুনে তার হাত থেকে ভাত সমেত চামুচ নিচে পড়ে গেল। তিনি বললেন,
—হায় আল্লাহ্! কি বলছো কী! কি হয়েছে?
—ওর ব্রেইন টিউমার থেকে ক্যান্সার হয়েছে। এখন আর বেশি সময় নেই।
বাবা খেতে পারলেন না। সান্ত্বনাও দিলেন না। তিনি সোজা তার ঘরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন চেক বই নিয়ে। দশ লক্ষ টাকার একটা চেক লিখে আমার হাতে দিলেন। আর বললেন,
—প্রয়োজন হলে আরো দিবো। তোমার স্বপ্নকে বাঁচাও। তুমিই আমার সব। তুমি ভালো থাকবে, এটুকু আমরা চাই।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। পারলাম না। শুধু তার হাতটি চেপে ধরলাম গালে। মনে মনে ভাবলাম উপল সেনের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
বিকেলে ফোন এলো। আননোন নম্বর।
—হ্যালো কে বলছেন?
—হ্যালো দিবা? কেমন আছিস্?
—এই তো আছি। কে বলছেন, বলুন তো?
—আমি তনুশ্রী। সরি ভাই তোকে বিদায় জানাতে নিচে যেতে পারিনি সেদিন। জানিস তোদের সাথে যে দেখা হলো। তারপর রুমে ঢুকে দেখি নিনাদের চোখ বেয়ে জল নামছে। তোকে সে অসম্ভব ভালোবাসেরে।
বুকে ভেতর কেমন হাহাকার করে উঠলো। কথা বলতে পারলাম না আর। তনুশ্রী ক্লাসমেট বলে আমাকে জানে। নিশ্চুপ আছি। বুঝলো বিমর্ষতা। ফোন রেখে দিলো।
ফের ফোন বেজে উঠলো। চেয়ে দেখি উপল সেনের ফোন। তিনি যে কখনোই আমাকে ফোন করেন না। তবে এখন? কী হয়েছে?
—হ্যালো!
—দিবা, দিজ স্টোরি ইজ ইন্ড!
মহাবিশ্বের সমগ্র অন্ধকার ভিড় করলো আমার রুমে। ভিড় সরিয়ে বেরুতে পারলাম না। ড্রেসিং টেবিলের উপর বাবার দেওয়া চেকটা সেই অন্ধকারে পথ হারালো।
………………… মুঠোফোন
পড়ুন
কবিতা
গল্প
1 thought on “যে মুঠোফোন বাজবে বলে বাজেনি”