মনস্কামনায় বাজে বিষের বাঁশি
জেবুননাহার জনি
মনস্কামনায় বাজে বিষের বাঁশি
লেকের এক কোনায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে এক নিবিষে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে ছিপছিপে গড়নের মন্টু। তার গায়ে ময়লা হাফ শার্ট, গলায় গামছা প্যাঁচানো। ছাপার লুঙ্গির ভেতরে ভাঙা পা’টি যতদূর সম্ভব লুকিয়ে রেখেছে। এক হাতে মোহনীয় সুরের বাঁশি, অন্য হাত ক্রাচে ভর করে সে দাঁড়িয়ে আছে।
রাস্তার পথচারীরা কেউ কেউ কখনো এক পশলা বৃষ্টির মতো একটু থেমে মন্টুর বাজানো বাঁশির সুর শোনে। এতে মন্টুর ভালো লাগে। আর ভাবে, কখনো যদি তার লায়লি তার সামনে এসে এই সুর শুনতো, তাহলে লায়লির সব কষ্ট দূর হয়ে যেত। লায়লি এই মোহনীয় বিরহী সুরে উপলদ্ধি করতে পারতো, তার মন্টু তাকে ধোঁকা দেয়নি। তার ভালোর জন্যই আর গ্রামে ফিরে যায়নি।
লায়লিকে মন্টু কথা দিয়েছিল ঢাকায় এসে রোজগার করে, বিয়ের টাকা জোগার হলেই গ্রামে ফিরে আসবে। এর পর লায়লিকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে। সেই কথা মতো মন্টু ঢাকায় এসে ভাড়ায় রিকশা চালাতে শুরু করে।
কিন্তু একদিন হঠাৎ করে একটা প্রাইভেট কার পেছন থেকে মন্টুর রিকশায় ধাক্কা দেয়। মন্টু গড়িয়ে পড়ে রাস্তায়, এর পর প্রাইভেট কারটি একটি পায়ের উপর দিয়ে চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। মন্টুর পায়ের সাথে তার সাজানো স্বপ্নটাকেও তছনছ করে ভেঙে দেয় প্রাইভেট কারটি।
যেখানে সে লায়লিকে কথা দিয়েছে তাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে, সংসার করবে। সেখানে উল্টো নিজে কি করে লায়লির বোঝা হবে? নিয়ন্তার নিয়তি সে ভাঙবে কি করে? এই পঙ্গু শরীর নিয়ে লায়লির সামনে সে দাঁড়ানোর থেকে, লায়লি মন্টুকে ভুল বুঝে ভুলে যাক, অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার করুক, সুখী হোক এটাই চেয়েছে মন্টু। তাই গ্রামে ফিরে যাওয়াকে তার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছে।
কিন্তু তার পরও কি কারণে গোপন অভিসারে তার হৃদয় তোলপাড় করে ওঠে বুঝতে পারে না। মন্টুর বুকের ভেতরে লায়লির জন্য এখনো কত-শত হাহাকার! খুব জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে তাঁর লায়লি?
লায়লিকে কষ্ট না-দেয়ার জন্যই আজ মন্টু ভিটামাটিহীন হয়ে পথে-ঘাটে মনস্তাপের সুরে বাঁশি বাজিয়ে তার বিষের জ্বালা মেটায়।
আজ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। যেভাবে জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে আগুনের ফুলকির মতো—মন্টুর হৃদয় ভেদ করে তা বুকের ভেতরে জ্বলছে। এতটা কাছে মনে হলেও, চাইলেই হাতের নাগালে ছোঁওয়া যাচ্ছে না চাঁদটাকে।
রাত ঘনিয়ে আসে। রাস্তাঘাট নীরব হতে থাকে। কিন্তু মন্টু তাঁর বিষের বাঁশি বাজিয়ে চলে। যার মনস্কামনায় ছিল শুধু লায়লির স্বপ্ন সুর, সে বোঝে না—আজ এ কোন সুর বাজে অতন্দ্রিতার অবতরণে?
.
…………………
পড়ুন
জেবুননাহার জনির গল্প
1 thought on “মনস্কামনায় বাজে বিষের বাঁশি”