shubhobangladesh

সত্য-সুন্দর সুখ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবসময়…

বানকিনার রক্তপঞ্জি : রাশেদ রহমান

Bankinas blood register

Bankinas blood register

Bankinas blood register

বানকিনার রক্তপঞ্জি

রাশেদ রহমান

গ্রামের নাম বানকিনা…।

হাশড়া, কালোহা, পাইকড়া, রোয়াইল, মৌরি—এই পাঁচটি গ্রাম বানকিনাকে ঘিরে রেখেছে। মাঝখানে বানকিনা। ছ’টি গ্রামই দ্বীপসদৃশ। বছরের অন্তত সাত-আটমাস গ্রামগুলো কচুরিপানার মতো জলে ভাসে। সব বাড়ির ঘাটে ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা। নৌকাই এই দ্বীপ-গ্রামগুলোর মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। অঘ্রান-পৌষ মাসে এইসব গ্রামের কাঁচা রাস্তা কি হালট জেগে ওঠে। চার কি পাঁচমাস এই পথে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ তুলে গরুরগাড়ি চলে…।

থানা-সদর থেকে বহুদূরের গ্রাম বানকিনা, হাশড়া, কালোহা, পাইকড়া, রোয়াইল ও মৌরি। নামা ভূমি। কিন্তু গ্রামগুলো উঁচু টিলার মতো। নামা-অঞ্চলের গ্রাম এরকমই হয়। না-হলে বর্ষার জল উঠে যাবে যে বাড়িতে! বর্ষার জল যতোই বাড়ুক—বানকিনা, হাশড়া, কালোহা, পাইকড়া, রোয়াইল, মৌরির কোনো বাড়িতে জল ওঠে না…।

কিছুটা দূরে দূরে সব বাড়ি। একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি নেই। তবে একবাড়ি থেকে পাশের কোনো বাড়ির কারো নাম ধরে ডাক দিলে তার সাড়া মেলে। তার জবাব কানে ভেসে আসে। সব বাড়িতেই প্রচুর গাছপালা। আম-জাম-জামরুল, চালতা-জলপাই-গাবগাছ। সব বাড়ির উত্তরপাশে বাঁশঝাড়। তবে এই ছয় গ্রামের মধ্যে গাছপালা কি বাঁশঝাড় বানকিনাতেই বেশি। ভিন-গাঁয়ের কোনো লোক নতুন বানকিনা ঢুকলে আতান্তরে পড়ে যাবে সে। আরে! চারদিকেই যে বনজঙ্গল—বাড়িঘর কই…!

এই আখ্যান-ভাগের ছ’টি গ্রামেই দুর্গম বসতি। বানকিনা পাঁচভাইয়ের একবোন—সে আরো দুর্গম। আত্মীয়স্বজন ব্যতিরেকে বাইরের কোনো লোক—সে হোক থানা-পুলিশ বা এসডিও অফিসের লোক, কেউ সহজে এদিকে আসে না। কোনো গ্রামে কোনো কারণে সকালে কেউ খুন হলে সন্ধ্যা-নাগাদ পুলিশের দেখা মেলে…!

এখন বানকিনার উত্তর-গাঁ ঘেঁষে পাকা রাস্তা। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চেপে এই রাস্তা ধরে বল্লা, রামপুর, রতনগঞ্জ যাওয়া ডালভাতের মতো। রতনগঞ্জ বাজারের পাশে বংশাই নদে সেতু। শালগ্রামপুর, সখীপুর, সাগরিদঘী, ফুলবাড়িয়া যেতেও কোনো বাধা নাই। হাশড়া, কালোহা, পাইকড়া, রোয়াইল, মৌরি—সব গ্রামের রাস্তাই এখন পাকা। সারাদিন রাস্তায় মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, অটোরিকশা ছুটে চলার শব্দ। কিন্তু এখানে বর্ণিত আখ্যান যে-সময়ে সৃজিত, তখন নৌকা আর গরুরগাড়ি কিংবা নিজের দু’টি চরণই ছিল যাতায়াতের মূল বাহন…!

জেলা ও থানা-শহর অনেক দূরে। হাটবাজারও অনেক দূরে দূরে; তারপরও এই দ্বীপ-গ্রামগুলোর মানুষ নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করে। তাদের যেন কোনো রোগ-ব্যাধি নাই, ডাক্তার-কবিরাজের প্রয়োজন পড়ে না; তাদের পারিবারিক কোনো সমস্যাও নাই, কোনো অভাব-অভিযোগও নাই। সকালে কাঁচামরিচ-পেঁয়াজসহযোগে পান্তাভাত; দুপুরে আর রাতে থালা-ভরা গরম ভাত পেলেই তারা খুশি, সাথে কচুরলতা কি ডাল, কিংবা গুঁড়া মাছের তরকারি। এই ছ’গ্রামের কেউ মাছ কিনে খায় না। জাল, পলো কি বড়শি নিয়ে বেরুলে, কিংবা খালে দিয়ার পেতে রাখলেই খাওয়ার মাছ জোটে। মাংসের ধার ধারে না বড়ো কেউ। আত্মীয়স্বজন এলে বাড়ির পালা মোরগ জবাই করে…।

মার্চ ১৯৭১…।

শান্ত, নিস্তরঙ্গ গ্রাম বানকিনা, হাশড়া, কালোহা, পাইকড়া, রোয়াইল, মৌরি। আষাঢ় থেকে আশ্বিন, এই চারমাস গ্রামগুলো ঘিরে বর্ষার জল যখন থইথই করে, তখন বাতাস উঠলে খোলাচকের জলে শুশুকের পিঠের মতো বড়ো বড়ো ঢেউ ওঠে। বাড়ি থেকেই শোনা যায় ঢেউয়ের গর্জন। তো, সেই মার্চে, তখন চকে কোথাও কোথাও খুব সামান্য জল, কোথাও ঢেউ-ওঠার মতো জল নাই, ঢেউয়ের গর্জন নাই; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদেশে যে ঢেউ উঠেছে, ঢেউয়ের গর্জন শুরু হয়েছে, বহু শহর-বন্দর, বিল-বাঁওড়, নদ-নদী অতিক্রম করে সেই ঢেউ বানকিনা, হাশড়া, কালোহা, পাইকড়া, রোয়াইল ও মৌরি এসেও আছড়ে পড়েছে…।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে ঢেউ তুলে বলেছেন—‘তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। …যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…।’

রশিদ বিএসসি বানকিনায় দুর্গ গড়ে তুলেছে। দুর্গের ভেতরে ট্রেনিং-ক্যাম্প। গাঁয়ের ছাত্র-যুবকরা তো আছেই, বানকিনাকে ঘিরে যে-পাঁচটি গ্রাম—হাশড়া, কালোহা, পাইকড়া, রোয়াইল, মৌরি—এইসব গ্রামের অনেক ছাত্র-যুবকও রশিদের ট্রেনিং-ক্যাম্পে এসেছে। বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরি ডামি রাইফেল হাতে তারা ট্রেনিং করে। সবাই সমস্বরে জয় বাংলা স্লোগান তুলে লেফট্-রাইট করে। বন্দুকের নিশানা ঠিক করে। সে-এক দেখার মতো দৃশ্য! যেন দেশে যুদ্ধ লেগে গেছে। এখনই যুদ্ধে যেতে হবে। অদূরেই শত্রুসেনা ওঁৎপেতে আছে…।

গ্রামের মুরুব্বি-শ্রেণীর লোক কেউ কেউ ট্রেনিং দেখতে আসে। যেমন : রশিদের বাবা ময়নাল সিকদার, প্রতিবেশী মুরুব্বি আমীর আলী, সোহরাব হোসেন; উৎসুক ছেলে-ছোকরার ভিড় তো লেগেই থাকে। ছেলেরাও দল গড়েছে। রশিদের ছোটভাই শাহেদ তাদের দলনেতা। ওরা রশিদ কিংবা অন্য কারো ফাইফরমাস খাটার সুযোগ পেলেই বর্তে যায়। বুক ফুলিয়ে মনে মনে বলে— ‘আমরাও মুক্তিযোদ্ধা…।’

একদিন বুড়ো কলিমুদ্দি ট্রেনিং-ক্যাম্পে এসেছে। ৪০-৫০ জন যুবকের লেফট্-রাইট-করা দেখে তার তো চক্ষুচড়কগাছ! এতো ছেলে-পেলে এলো কোত্থেকে? ক’দিন আগেই কলিমুদ্দির কানে এসেছে—রশিদ বিএসসি ক্যাম্প খুলেছে। ক্যাম্পে ছাত্র-যুবকদের ট্রেনিং দেয়া হয়। বাঁশ-কাঠ দিয়ে বন্দুক বানিয়েছে। রশিদ বিএসসি’র ওপর ভূতে আছর করেছে, আর কি! বাঁশ-কাঠের বন্দুক নিয়ে যুদ্ধে যাবে…!

কলিমুদ্দি মুসলিম লীগের পাণ্ডা। সে একা না। বানকিনার আরো ক’জন সাথে আছে তার। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে হ্যারিকেন মার্কা নিয়ে বেশ লম্ফঝম্প করেছে। ভোটাররা তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। মুসলিম লীগের প্রার্থী মওলানা কালিহাতী থানায় সাকুল্যে ভোট পেয়েছিল দুইশ’। তারপর থেকেই কলিমুদ্দির মুখে কুলুপ-আঁটা। তার সাঙ্গপাঙ্গরা তেমন কথাবার্তা বলে না। ৭ মার্চের পর থেকে আবার একটু একটু নড়াচড়া শুরু করেছে। দেশে সত্যি-সত্যিই যুদ্ধ লেগে যাবে নাকি? পবিত্র পাকিস্তান কি ভেঙে যাবে? শেখ মুজিব যে বললো—‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’—এটা কীসের ইঙ্গিত? রশিদ বিএসসি আবার ট্রেনিং-ক্যাম্প খুলে বসেছে…!

আব্দুর রশিদ ২১ বছরের টগবগে যুবক। সা’দত কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করে গোপালদীঘি হাইস্কুলে চাকরি নিয়েছে। গণিতের শিক্ষক। তরুণ-শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয়ও খুব। স্কুলে যোগদানের পরই তার নামের প্রথমাংশ ‘আব্দুর’ কাটা পড়ে যায়, বড়রা ‘রশিদ বিএসসি’ নামে ডাকে, ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ‘বিএসসি’ স্যার হিসেবে পরিচিত। রশিদ কলেজে ছাত্রলীগ করতো। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন—দিনরাত খেটেছে রশিদ। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনলে তার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফোটে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পরই সে এলাকার ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করতে শুরু করে…।

নিজেদের বাড়ির পাশেই রশিদের ট্রেনিং-ক্যাম্প। জায়গাটাও ট্রেনিং-ক্যাম্প খোলার জন্য খুবই যুতসই। চারদিকে ঝোপজঙ্গল, বাঁশঝাড়। মাখঝানে বেশখানিকটা খোলা জায়গা। ভেতরে না-ঢুকলে বোঝার উপায় নাই—এখানে কী হচ্ছে। সেদিন, সকাল এগারোটার মতো বাজে, সমবেত ছাত্র-যুবকরা লেফ্ট-রাইট করছে, কমান্ড করছে রশিদ, ছেলে-ছোকরার দল তখনো আসেনি। হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এলো শাহেদ; হাঁপাতে হাঁপাতে বললো—‘বড়ভাই, হারিকেন মার্কা আসতেছে…।’

‘হারিকেন মার্কা! কে রে…?’

‘কলিমুদ্দি বুড়ো…।’

‘আসুক…।’

ছানাবড়া চোখে কলিমুদ্দি বলল—‘এ রশিদ, এইডা তুমি কী করতেছ…?’

রশিদ ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে বলল—‘তোমরা সবাই কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। আমি হারিকেন-চাচার সাথে একটু কথা বলে নিই…।’

‘কী যে কও রশিদ! আমার নাম কলিমুদ্দি মোল্লা…।’

‘জানি। একটু ঠাট্টা করলাম আর কি! তা, কী যেন জিজ্ঞেস করলেন চাচা…?’

‘এখনই ভুইলা গেলা মাস্টার? আশ্চর্য! জিজ্ঞাস করি—এইডা তুমি কী করতেছ…?’

‘কোনটা…?’

‘না মাস্টার! তোমার লগে আর পারা গেলো না। এই যে পোলারা লাফালাফি করতেছে, এইডা কী…?’

‘ও! এটা কী বোঝেন না? এটা ট্রেনিং। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছি…।’

‘মুক্তিযুদ্ধ! যুদ্ধ কোনে পাও…?’

‘যুদ্ধ লাগলো বলে, চাচা। আপনাদের পবিত্র পাকিস্তান দুই টুকরো হতে আর বেশি দেরি নাই। পূর্বপাকিস্তান খুব শিগগিরই স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে যাবে। তবে এজন্যে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে…।’

‘না বাবাজি, যুদ্ধটুদ্ধ হবে না। পাকিস্তানও ভাঙবে না। আল্লাহপাক নিজে পবিত্র পাকিস্তানকে হেফাজত করবে। শেখ সাবের সাথে আলোচনা হইতেছে তো। একটা মীমাংসা হইয়া যাবে…।’

‘ইয়াহিয়া খান আর ভুট্টোকে আপনারা চেনেন না, চাচা। ওরা বাঙালির হাতে ক্ষমতা দেবে না…।’

‘তা, তোমরা এই বাঁশের বন্দুক দিয়া যুদ্ধ করবা…?’

‘সময়মতো আসল বন্ধুক এসে যাবে…।’

‘করো, তোমরা ট্রেনিং করো। আমি যাই। পাকবাহিনীর পেদানি যখন খাবা, তখন বুঝবা কতো ধানে কতো চাইল। যুদ্ধের প্যাকপ্যাকানি মিটা যাবো তখন…।’

রশিদ বিএসসি কলিমুদ্দির দিকে একটু তাকালো। রশিদের চোখে-মুখে প্রচণ্ড ঘৃণা, ক্রোধ। কিন্তু নিজেকে সে সামলে নিল। কলিমুদ্দিকে কিছুই বললো না। এখন কিছু বলার সময় না। সে উচ্চস্বরে বললো—‘রেডি? এক, দুই…।’

পাইকড়ার দুদু চেয়ারম্যান একদিন ট্রেনিং-ক্যাম্পে এলেন। ট্রেনিং-প্রত্যাশীর সংখ্যা সেদিন আরো বেশি। নতুন কয়েকটি ছেলে এসেছে। সিংহটিয়া ও ছাতিহাটীর। ছেলেদের ট্রেনিং দেখে চেয়ারম্যানের চোখ-মুখ জোনাকির আলোর মতো ঝলমল করছে। রশিদ বিএসসি সত্যি-সত্যিই দুর্গ গড়ে তুলেছে। সারাদেশেই হয়তো গড়ে উঠছে এরকম দুর্গ। ইয়াহিয়ার সৈন্যরা যতোই প্রশিক্ষিত হোক, তাদের হাতে যতো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রই থাকুক না কেন, এটা ওদের কাছে বিদেশবিভূই; পথঘাট অচেনা, এখানে ওরা মার খাবেই। তা ছাড়া পাকিস্তানের সৈন্যরা চাকরিজীবী, চাকরি রক্ষার জন্য যুদ্ধ করবে, যেটুকু সামনে না-গেলেই নয়—সেটুকুই যাবে, নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে যুদ্ধ; আর রশিদের ছেলেরা যুদ্ধ করবে দেশের স্বাধীনতার জন্য। বাঙালির বিজয় সুনিশ্চিত। দুদু চেয়ারম্যান রশিদ বিএসসিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন—‘তোমরা বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত সৈনিক। ট্রেনিং চালিয়ে যাও। আমি তোমাদের সাথে আছি…।’

রশিদের হাতে দু’শ’ টাকা দিলেন দুদু চেয়ারম্যান। ‘এটা রাখো রশিদ। ট্রেনিং চালাতে নিশ্চয়ই টাকার দরকার…।’

দুদু তালুকদার শুধু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানই নন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিও। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর ডানহাত। রশিদরা গার্ড অব অনার দিল চেয়ারম্যানকে। চেয়ারম্যান মুগ্ধ, আপ্লুত। তার চোখে জল এসে গেছে…।

মে ১৯৭১…।

সারাদেশে যুদ্ধ লেগে গেছে। যুদ্ধ লেগেছে বলতে পাকিস্তানি হানাদারদের একতরফা পৈশাচিক তাণ্ডব। মুক্তিবাহিনী কোথাও তেমন গুছিয়ে উঠতে পারেনি। হানাদাররা যাকে যেখানে পাচ্ছে পাখির মতো গুলি করে মারছে। ছেলে-বুড়ো-নারী—বাছবিচার নাই। যুবতী মেয়েদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গণধর্ষণ করছে। ধর্ষণের পর মেয়েদের লাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে খালে, বিলে, নদীতে। খাল-বিল-নদীর জলে রক্ত মিশে জল জমাট বেঁধে গেছে। জল স্থির। জলের গতি রুদ্ধ। হানাদাররা পুড়িয়ে ছারখার করছে মানুষের বাড়িঘর। ভিটেবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে আতঙ্কিত মানুষ। পাকা রাস্তার ধারের বাড়িঘরে কোনো মানুষজন নাই। কুকুর-বেড়ালও নাই বাড়িতে। ইয়াহিয়া খান বলেছে—‘মানুষ চাই না, বাংলার মাটি চাই’—নিয়াজির ছেলেরা তাই খুন-ধর্ষণের ব্রত পালন করছে। যতটা দ্রুত সম্ভব—বাংলার মাটি জনশূন্য করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা কোথাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। তারা কোথাও কোথাও নিরাপদ স্থানে ট্রেনিং করছে। হানাদারদের প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে…।

বানকিনা তখনো নিরাপদ। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়ক থেকে অনেক দূরের গ্রাম বানকিনা। তখনই গাঁয়ের চারদিক জলে ভরে গেছে। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের পথ নাই। হানাদাররা তখনো নৌকায় ওঠা শুরু করেনি। জল দেখে ভয় পায় ওরা। রশিদ বিএসসি ট্রেনিং চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখানে আর কতদিন নিরাপদ? কালিহাতী থানায় পাকিস্তানি হানাদাররা ঘাঁটি গেড়েছে, টাঙ্গাইল শহর হানাদারদের দখলে, শহরে কোনো লোকজন নাই, একদম গড়ের মাঠ; এই খবর শুনেই কলিমুদ্দি মোল্লা লাফালাফি শুরু করেছে—‘সাহস কতো বুকে? কাঠের বন্দুক দিয়া যুদ্ধ করবো! আর দুইদিন সবুর করো। ওই বন্দুক তোমাগো গোয়া দিয়া ঢুকামু। পাকি সোলজার আইলো বলে…।’

সত্যিই তো! বাঁশ-কাঠের বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করা যাবে না। হানাদারদের হাতে চাইনিজ রাইফেল, মেশিনগান। কামানও আছে। এখন প্রকৃত বন্দুক দরকার। ভারী অস্ত্রশস্ত্র দরকার। কিন্তু অস্ত্রের বাড়ি কোথায়…?

রশিদ বিএসসিকে আরেকটি বিষয় ভাবিয়ে তুলেছে। ট্রেনিং-ক্যাম্পের সদস্য দিন দিন কমছে। ঘটনা কী? যারা এতো উৎসাহ নিয়ে এলো, দেশের জন্য যুদ্ধ করবে, প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দেবে, তারা এখন কিছুই না-বলে সরে পড়ছে কেন? ট্রেনিং-ক্যাম্পের ছাত্র-যুবকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল তেপান্ন, এখন ত্রিশে নেমে এসেছে। হাশড়া, কালোহা, পাইকড়া, রোয়াইল, মৌরির অনেকে তো কেটে পড়েছেই, বানকিনারও সাতজন পালিয়েছে…।

‘ওরা পালাচ্ছে কেন, আলাল? তোমার কী মনে হয়…?’

হাশড়ার আলাল আকন্দ রশিদ বিএসসি’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বলতে গেলে এই দুই বন্ধু মিলেই এই ট্রেনিং-ক্যাম্প খুলেছে। আলাল বললো—‘ওরা হয়তো ঝোঁকের বশে ট্রেনিং নিতে এসেছিল। এখন হানাদারদের কামান-মেশিনগানের নাম শুনে ভয় পেয়েছে। মনে করছে হানাদারদের সাথে যুদ্ধ মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। তাই পালাচ্ছে। তা ছাড়া…।’

‘তা ছাড়া কী…?’

‘আমরা যুদ্ধ যে করবো, আমাদের তো কোনো অস্ত্রশস্ত্রই নাই। অস্ত্র যে কোত্থেকে কীভাবে পাবো—ছেলেদের তো আমরা কিছুই বলতে পারছি না…।’

শাজাহানভাই তো অনেক আগেই ইন্ডিয়া চলে গেছেন। তার সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তিনি যে বলে গেলেন—সময় মতো খবর দেবেন—তখন ওপার চলে যেতে হবে। তার কাছ থেকে কোনো খবর আসছে না—এটাই মুশকিল হয়েছে…।

‘ঘটনা আরো আছে…।’

‘কী…?’

‘কালোহার মওলানা কদ্দুস, ওই যে জামাতে ইসলামির চেলা, আলিয়া মাদ্রাসায় মাস্টারি করে, সে গ্রামে ফিরে এসেছে, শুনেছ তো…?’

‘হ্যাঁ, শুনেছি…।’

‘সে গ্রামে ফিরে এসেছে। আমার মনে হয়—মুসলিম লীগের চেলা কলিমুদ্দি মোল্লা আর জামাতের চেলা মওলানা কদ্দুস মিলে একটা ঘোট পাকিয়েছে। তারা হয়তো ওইসব ছেলেদের ভয় দেখিয়েছে, কিংবা টাকার লোভ দেখিয়ে রাজাকার বানিয়েছে…।’

‘তাও হতে পারে…।’

মে মাসের অন্তিম রাত। রাত পোহালেই জুন। মধ্যরাতে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটলো…।

বানকিনা রশিদ বিএসসি’র বাড়ির ঘাটে দু’টো ছইঅলা নৌকা ভিড়েছে। ছইয়ের নিচে টিমটিম করে জ্বলছে হারিকেন। দুই নৌকায় ছ’জন লোক। দু’জন নৌকার মাঝি। বাকি চারজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা—কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য…।

চারজনের ছোট দল। হাবিব দলপতি। তারা রশিদ বিএসসি’র কাছে কাদের সিদ্দিকীর বার্তা নিয়ে এসেছে…।

কাদের সিদ্দিকী লিখেছেন—‘ভাই রশিদ, সালাম ও শুভেচ্ছা জেনো। আশা করি ভাল আছ। আমি তোমার খবর জেনেছি। তুমি নিজের গ্রামে মুক্তিবাহিনী গঠন করেছ। ট্রেনিং দিচ্ছ। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মতোই কাজ করছ তুমি। তোমাকে এবং তোমার সহযোদ্ধোদের সংগ্রামী সালাম জানাই। কিন্তু আমি জানি, তোমার হাতে অস্ত্র নাই। অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ করবে কীভাবে? আমরা পাহাড়ের আন্ধি এলাকায় ট্রেনিং-ক্যাম্প খুলেছি। এর মধ্যেই তিন হাজার দাঁড়িয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা। এখন আমাদের ঐক্য প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ করলে ফল পাওয়া যাবে না। চরাঞ্চলে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কবি বুলবুল খান মাহবুব দল গঠন করেছিলেন। তিনি আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আন্ধি আসছেন। তোমাদের জন্য দু’টি নৌকা পাঠিয়েছি। তোমরা এসে পড়ো। জয় বাংলা…।’

চিঠি পড়া শেষ করে রশিদ আলালের মুখের দিকে তাকালো। আলাল রশিদের মুখের দিকে তাকিয়েই ছিল। দু’জনে চোখাচোখি হলো। দু’জনের মনেই প্রশ্ন—এখন কী করা উচিত…?

কাদের সিদ্দিকী পাহাড়ে দল গঠন করেছেন, তার হাতে অস্ত্রশস্ত্র আছে—রশিদ, আলাল তা জানে। রশিদ বলল—‘তোমার মত কী, আলাল…?’

‘চিঠি সবাইকে পড়ে শোনাও। সবারই মতামত নেয়া উচিত…।’ বলল আলাল।

ইতোমধ্যে এই ক্যাম্পের সবাই জেনে গেছে—কাদের সিদ্দিকীর চিঠি নিয়ে লোক এসেছে। চারজন। চারজনের কাঁধেই সত্যিকারের বন্দুক। ক্যাম্পের কেউ জেগে ছিল, কেউ ঘুমিয়ে পড়েছিল, সবাই এখন সারিবদ্ধভাবে বসে আছে। রশিদ বলল—‘প্রিয় ভাই ও বন্ধুরা। ছাত্রলীগ নেতা এবং আমাদের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী সাহেবের ছোটভাই কাদের সিদ্দিকী পাহাড়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করেছেন। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন—আমরা যেন তাঁর সাথে যোগ দিই। ওনারা তার চিঠি নিয়ে এসেছেন। আমি চিঠিটি তোমাদের পড়ে শোনাই…।’

চিঠি পড়া শেষ করে রশিদ বলল—‘এখন তোমরা বলো, কী করবে? যাবে…?’

একজন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল—‘আপনি যে সিদ্ধান্ত নেন আমরা তাই মেনে নেবো…।’

রশিদ বিএসসি হাবিবকে বলল—‘আপনারা নৌকায় গিয়ে বসুন। আমরা একটু পরে আসছি…।’

হাবিবরা চলে গেলে রশিদ বলল—‘শাজাহানভাইর নির্দেশ আছে, কাদের সিদ্দিকীর দলে যোগ দেয়া যাবে না। ইন্ডিয়া গিয়ে মুজিববাহিনীর ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে হবে। মুজিববাহিনীর সদস্য হিসেবেই যুদ্ধ করতে হবে…।’

‘এখন তাহলে কী করবেন…?’ বলল আলাল।

‘আমরা ওদের নৌকায় উঠবো কিন্তু পাহাড়ে যাবো না, ওদের নৌকা নিয়েই সীমান্ত পাড়ি দেবো…।’ বলল রশিদ।

আলাল চমকে উঠলো রশিদের কথা শুনে। বলল—‘ওরা…?’

রশিদ বলল—‘আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে। কোনো সমস্যা হবে না…।’

জুলাই ১৯৭১…।

বানকিনার চারপাশে অথৈ সাগরের মতো জল। বাতাস উঠলেই জলসঙ্গীত বেজে ওঠে। গাঁয়ের চারপাশে শুধু যে জলের সঙ্গীত বাজে, তা না; জলের ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে যুদ্ধের খবরও বানকিনাবাসীর কানে আসে…।

জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে…।

কাদেরিয়া বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট শুরু হয় ৮ মে। সখীপুর হাইস্কুল মাঠে লোক বাছাই করা হয়। মে মাসজুড়ে একই সাথে লোক রিক্রুট এবং ট্রেনিং চলে। খোরশেদ আলমকে রিক্রুট অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ৯ জুন আন্ধি হেডকোয়ার্টারে মুক্তিযোদ্ধারা শপথগ্রহণ করে। শপথবাক্য পাঠ করান বাহিনী-প্রধান কাদের সিদ্দিকী।

‘আমি শপথ করিতেছি যে, মুক্তিবাহিনীর সকল আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মানিয়া চলিব এবং মুক্তিবাহিনীর সুনাম রক্ষায় সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকিব। আমি কোনোক্রমেই একন কোনো কাজ করিব না, যাহাতে সংগঠনের সুনাম বিনষ্ট হয়…।’

‘আমি স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, কমান্ডারের নির্দেশে আগুনে, পানিতে কিংবা হানাদারদের ওপর ঝাঁপাইয়া পড়িতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিব না…।’

শপথ শেষে কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি কোম্পনিতে ভাগ করে কোম্পানি কমান্ডার নিয়োগ দেন। তারা দল-প্রধান নির্দেশিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে…।

১২ জুন সকালে বল্লাবাজারের কাছে পাকিস্তানি-হানাদারদের সাথে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বাঁধে। সকাল ন’টার দিকে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। থেমে থেমে দুপুর পর্যন্ত চলে। অসংখ্য হানাদার হতাহত হয়। শেষ পর্যন্ত টিকতে না-পেরে তারা পশ্চাৎপসরণ করে। কাদের সিদ্দিকী ছুটে যান নদীর তীরে। হানাদারদের ১০-১২টি লাশ নদীতে ভাসছে। নদীর জল রক্তবর্ণ…।

১১ জুন রাতে কাদের সিদ্দিকী সিঙ্গাইর ছিলেন। কোম্পানি কমান্ডার খন্দকার ফজলুর রহমান তার বাহিনী নিয়ে ছাউনি ফেলেছিলেন বল্লাবাজারের পূর্বপাশে। নদীর ওপার। বল্লা আর সিঙ্গাইর পাশাপাশি গ্রাম। ১২ জুন সকাল ৭টার দিকে ফজলুর রহমান কাদের সিদ্দিকীকে ফোন করলেন। বললেন, ‘স্যার, বল্লাবাজারের মিষ্টি খুবই সুস্বাদু। আপনার জন্য মিষ্টি পাঠালাম…।’

সকাল ৮টা। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আকবরের মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে নিজের মিষ্টিতে কেবল কামড় দেবেন কাদের সিদ্দিকী, তখনই আবার ফজলুর রহমানের ফোন—‘স্যার সর্বনাশ! কালিহাতী থেকে হানাদার আসছে। চারান অতিক্রম করেছে। বিশাল বহর। দু’শ’র কম হবে না…।’

কাদের সিদ্দিকী মিষ্টি আর খেতে পারলেন না। বললেন, ‘তোমরা প্রস্তুত থাকো। আমরা এখনই আসছি…।’

বল্লা তাঁত-সমৃদ্ধ গ্রাম। যুদ্ধ শুরুর আগে দিনরাত কাপড় বোনার খটখট শব্দে মুখর থাকতো চারদিক। ৫ মে হানাদার বাহিনী এসেছিল এই গ্রামে। তখন মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ছিল না। হানাদাররা বল্লাবাজার, গ্রামের বহু ঘরবাড়ি, তাঁত পুড়িয়ে ছারখার করে। যাকে যেখানে পায় সেখানেই গুলি করে মারে। গ্রামটি শ্মশানে পরিণত হয়। কাদের সিদ্দিকীর মাথায় ধরে না একমাসের ব্যবধানেই, এই সাতসকালে হানাদাররা কেন আবার আসছে…?

যাই হোক, কাদের সিদ্দিকী তার দলবল নিয়ে দ্রুত বল্লা ছুটে আসেন। নিজে নেতৃত্ব দেন যুদ্ধের…।

বল্লাযুদ্ধে মার খেয়ে হানাদাররা প্রচণ্ড মুষড়ে পড়ে। তারা ঘাঁটি ছেড়ে বাইরে বেরুনোর সাহস করে না। এই সুযোগে কাদেরিয়া বাহিনীর বিভিন্ন কোম্পানি দিনে-দুপুরেই বাসাইল, ঘাটাইল, গোপালপুর থানা আক্রমণ করে। সব থানা আক্রমণই সফল। হানাদাররা ঝোপ-জঙ্গলে পালিয়ে বাঁচে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র…।

বল্লার যুদ্ধ, বিভিন্ন থানা আক্রমণ, কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধাদের জয়লাভ—সব খবরই আসে বানকিনা। এই দ্বীপগ্রামে কে যুদ্ধের খবর নিয়ে আসে কেউ জানে না। তবে খবর আসে। শুধু রশিদের খবর আসে না, তার সাথে আরো যারা বাড়ি ছেড়ে গেছে, তাদের কোনো খবর আসে না। তারা কোথায় আছে, কোথায় যুদ্ধ করছে—কোনো খোঁজ নাই। রশিদের বুড়ো মা-বাবা সারাদিন জায়নামাজে বসে থাকে। আল্লাহকে ডাকেÑ ‘হে আল্লাহমাবুদ, হে দিনদুনিয়ার মালিক, তুমি রশিদরে রক্ষা করো। তার সঙ্গী-সাথীদের হেফাজত করো। হে আল্লাহ, বাছারা যুদ্ধে শহীদ হলে হোক, শোক করবো না, কিন্তু ওরা কেউ যেন হানাদারদের হাতে ধরা না-পড়ে মাবুদ…।’

রশিদের মা-বাবার চোখে ঘুম নাই…।

আলালের মা-বাবার চোখে ঘুম নাই…।

সামাদের মা-বাবার চোখে ঘুম নাই…।

রশিদের সাথে যারা মুক্তিযুদ্ধে গেছে কারো মা-বাবার চোখেই ঘুম নাই। তারা সবাই রাত জেগে গুমরে গুমরে কাঁদে আর আল্লাহ আল্লাহ করে। কলিমুদ্দি মোল্লা যা শুরু করেছে, কার কপালে কী আছে, কে জানে…!

বানকিনার কে কে রশিদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে গেছে কলিমুদ্দি তা খুঁজে বের করেছে। এটা তো তার জন্য কঠিন কোনো কাজ না। নিজের গ্রাম বলে কথা। সবার হাঁড়ির খবর তার নখদর্পণে। বানকিনার ১২ জন যুদ্ধে গেছ। রশিদরা গ্রাম ছাড়ার ক’দিন পরই কলিমুদ্দি নিজে নেতা সেজে রাজাকার বাহিনী গঠন করেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধে গেছে প্রতিদিন সকালে একবার করে দলবল নিয়ে তাদের বাড়িতে হামলে পড়ে কলিমুদ্দি। তাদের মা-বাবাকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে, বলে—‘এখনো সময় আছে, ছেলেকে ফিরাইয়া আইনা রাজাকারে ভর্তি কইরা দেও। নইলে কিন্তু আমি তোমাগো বাঁচাইতে পারমু না। ঘরে সোমত্ত ম্যায়া আছে, পাঞ্জাবি সোলজাররা পবিত্র পাকিস্তান রক্ষার জন্য বউ ঘরে রাইখা আছে, তাদের ম্যায়ালোক দরকার, তারা তোমার ম্যায়াডিরে ধইরা নিয়া যাবো…।’

সিকদারবাড়ি দিনে দু’বার যায় কলিমুদ্দি। ময়নাল সিকদার রশিদের বাবা…।

‘সিকদারের পো, তোমরা কি সবাই জানে মরবার চাও? তোমার ম্যায়াডারে কি বাঁচাইতে চাও না? তোমার পোলা রশিদই তো নাটের গুরু। তার জন্যই গ্রামটা ছারখার হবে। বউ-ঝিদের হারাইতে হবে…।’

ময়নাল সিকদার কোনো কথা বলে না…।

২১ জুলাই…।

সকাল ন’টার মতো বাজে। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছিল। বৃষ্টিস্নাত সকালে বানকিনার কেউ তখনো কাজে বের হয়নি। বর্ষাকালে এমননিতেই বানকিনা, হাশড়া, পাইকড়া, কালোহা, রোয়াইল, মৌরিতে কাজ কম। তখন প্রধান কাজ মাছ ধরা। সেদিন বানকিনার লোকজন মাছ ধরতে যেতেও দেরি করেছে। এই সময় চারটি স্পিডবোটে হানাদার এসে গ্রাম ঘিরে ফেলে। একটি বোট থামে ময়নাল সিকদারের বাড়ির ঘাটে…।

ময়নাল সিকদার, তার স্ত্রী আয়মনা—দু’জনেই ষাটোর্ধ বুড়ো। রশিদের বয়স একুশ, তাতে এই দম্পতির জোয়ানই থাকার কথা, কিন্তু তারা বুড়ো; এর একটা ইতিহাস আছে। এই দম্পতির প্রথম চার সন্তানের কেউ বেঁচে নাই, অকালমৃত্যুর কবলে পড়ে তারা। রশিদ ময়নাল-আয়মনার পঞ্চম সন্তান। যা হোক, বুড়ো ময়নাল মাছ ধরতে যায় কদাচিৎ। সেদিনও যায়নি। সবাই মিলে ঘরের বারান্দায় পাটি পেতে খেতে বসেছিল। উঠোনে হানাদার এসেছে, টেরই পায়নি কেউ। হঠাৎ উঠোনে কলিমুদ্দির লম্বা গলা—‘স্যার, এই দুইডা মূল কালপ্রিট রশিদের মাও-বাপ। ওই ছুকরি বোন আর ওই ছোঁড়া ছোট ভাই…।’

কলিমুদ্দির গলা শুনে সবাই মুখ তুলে তাকায়। দেখে—উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে সাত যমদূত…!

এক হানাদার চিতাবাঘের মতো ময়নার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ময়না পাজামা-কাঁচলি পরা ছিল। হানাদার একটানে কাঁচলি ছিঁড়ে ফেলে। ময়না নিজের দুই হাতে বুক আগলে রাখার চেষ্টা করে। পারে না। মানুষের মতো দেখতে হানাদারটা চিতার মতো ময়নার স্তন কামড়াতে শুরু করে…।

ময়নাল, আয়মনা, শাহেদ ঘরে ঢোকার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু কেউই ঘরে ঢুকতে পারে না। হানাদারদের গুলি খেয়ে তিনজনেই চৌকাঠের ওপর উপুর হয়ে পড়ে…।

ময়নার তখন জ্ঞান নাই। একে একে সাত-হানাদারই তাকে উঠোনে ফেলে তার ওপর উপগত হয়। শেষ হানাদার জ্ঞানহীন ময়নাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করে। তারপর ময়নালের ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পাশের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে সবাই…।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বানকিনার অন্য সব মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতেও দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। হাশড়া, পাইকড়া, কালোহা, রোয়াইল ও মৌরির মানুষেরও চোখে পড়ে এই আগুনের শিখা…।

সেপ্টেম্বর ১৯৭১…।

ভারতের টাণ্ডুয়া-ক্যাম্প থেকে ট্রেনিং শেষে রশিদ বিএসসি তার দল নিয়ে দেশে ঢোকে…।

মুজিববাহিনীর এই দলটিই সর্বপ্রথম ঢুকেছে বাংলাদেশে…।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর তত্ত্বাবধানে টাণ্ডুয়া-ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। এখানে মুজিববাহিনীর সদস্যরা ট্রেনিং নিয়েছে। এই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা, ইঞ্জিনিয়ার হাসানুল হক ইনু। র-এর কর্মকর্তারা তো ক্যাম্পের তত্ত্বাবধান করতেনই, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজও এই ক্যাম্পের ট্রেনিং-পরিস্থিতি দেখভাল করতেন…।

৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বললেন—‘…তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’, ৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ; মাত্র ১৯ দিনের ব্যবধান, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো, প্রকৃতার্থে কিন্তু তখন যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তারপরও বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিক, চাকরিজীবী—সবাই দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন, এখন আর কারো ঘরে বসে থাকার সুযোগ নাই, হাতে অস্ত্রশস্ত্র কিছু আছে কিনা তাও ভাবার ফুরসত নাই; এখনই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। যে যেখানে পারে, খোঁজ পেলেই হয়, কেউ কোথাও ট্রেনিং-ক্যাম্প খুলেছে, মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিচ্ছে; সেখানেই গিয়ে নাম লেখাতে শুরু করে। সাতদিন কি পনেরো দিনের সামান্য ট্রেনিং, বন্দুকের ট্রিগার ঠিকমতো টিপতে শিখেছে কি শেখে নাই, গ্রেনেডের বোতামও ঠিকমতো খুলতে পারে না; সম্মুখ-সমরে নামলে নিজের প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে কি পারবে না তাও জানা নাই; কিন্তু কমান্ডারের নির্দেশে রাত নাই, দিন নাই, অমাবশ্যা কি পূর্ণিমা নাই, শত্র“সেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে…।

এই সময় বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ চার যুবনেতা আব্দুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ; বঙ্গবন্ধুর চার খলিফা হিসেবে খ্যাত নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কদ্দুস মাখন, আ স ম আব্দুর রব ও শাজাহান সিরাজ—বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করে এই আট নেতার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, এখন যারা যুদ্ধ করছে, পাকিস্তানি প্রশিক্ষিত বাহিনীর সামনে তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে না। তাদের রাজনৈতিক ডেডিকেশনও দুর্বল, যুদ্ধের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে হতাশ হয়ে তারা যুদ্ধত্যাগ করতে পারে। এইসব মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন কঠিন হয়ে উঠবে। পাকিস্তানি প্রশিক্ষিত আর্মির সাথে যুদ্ধ করতে শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত বাহিনী দরকার। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের দিয়ে এরকম একটি বাহিনী গড়ে তুলতে হবে…।

যুব ও ছাত্রনেতাদের অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধী সরকার র-এর তত্ত্বাবধানে যে-বাহিনী গড়ে তোলে সেটিই মুজিববাহিনী…।

রশিদ বিএসসি শাজাহান সিরাজের অনুগত ও অনুসারী। টাণ্ডুয়া গিয়ে সে শাজাহান সিরাজকে খুঁজে বের করে। শাজাহান সিরাজের তত্ত্বাবধানেই নিজের দলসহ ইনুর ক্যাম্পে ট্রেনিং করে রশিদ…।

১৯৬৮-৬৯ সাল থেকেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রকট দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। একপক্ষ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর অনুসারী, অপর পক্ষ সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজের অনুসারী। ঊনসত্তর সালের গণআন্দোলন ও সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে দুই পক্ষ এক হয়ে কাজ করে, কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে আবার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে দুই পক্ষ। টাঙ্গাইলে আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম ও কাদের সিদ্দিকী নূরে আলম সিদ্দিকীর পক্ষাবলম্বন করে; আলমগীর খান মেনু, খন্দকার আবদুল বাতেন, আব্দুর রশিদ বিএসসি শাজাহান সিরাজকে অনুসরণ করে। তারা মুক্তিযুদ্ধও করে পৃথক পৃথক বাহিনী গঠন করে। শুধু পাকিস্তানি হানাদারদের হাতেই না, দু’পক্ষের হাতেই খুন হয় প্রতিপক্ষ ‘জয় বাংলা’র যোদ্ধা…।

রশিদ বিএসসিকে মুজিববাহিনীর কালিহাতী থানা কমান্ডার নিয়োগ করে দেশে পাঠানো হয়। সে গ্রামে এসে নিজের বাড়িতেই ঘাঁটি গাড়ে…।

রশিদ দল নিয়ে মধ্যরাতে নৌকা থেকে বাড়ির ঘাটে নামে। কিন্তু বাড়ি কই! এ যে ছাইভস্মের স্তূপ। মা-বাবা কোথায়? ময়না-শাহেদ কোথায়? রশিদের বুঝতে বাকি থাকে না কী হয়েছে। এটা কলিমুদ্দি মোল্লার কাজ। এই শুয়োরের বাচ্চাকে দিয়েই অপারেশন উদ্বোধন করতে হবে…।

চোখ ছলছল করছে রশিদের। সে বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো ছাইস্তূপের সামনে। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাকে তিনদিক থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখেও জল ছলছল করছে। কমান্ডারের বাড়ির কেউ যে বেঁচে নাই এটা নিশ্চিত। এখন কী নির্দেশ দেবে কমান্ডার, কে জানে…!

কিছুক্ষণ পর রশিদ মুখ খুলল—‘আলাল…।’

‘জি স্যার…।’

রশিদ-আলাল দুই বন্ধু। কিন্তু রশিদ এখন কমান্ডার। কমান্ডারকে স্যার বলতেই হবে—এটা যুদ্ধের বিধান। আলালও রশিদকে স্যার সম্বোধন করে…।

মুখ খোলার পরই রশিদের চোখ থেকে জল নয়, অজস্র আগুনের গোলা বেরুতে থাকে। এই আগুনে যেন বানকিনা গ্রামের সব ঘরবাড়ি পুড়ে ছারখার হবে। আলাল কমান্ডারের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। রশিদ বলল—‘আলাল, আমি পাঁচজন সাথে নিয়ে কলিমুদ্দির বাড়িতে যাচ্ছি। বাকিদের নিয়ে তুমি বাংকার খুঁড়ে ছাউনি ফেলো…।’

রশিদরা খালি হাতে টাণ্ডুয়া গেছিল। এখন সবার হাতে-কাঁধে অস্ত্র…।

কলিমুদ্দির ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছিল। টিমটিমে আলো। ঘরে কথাবার্তার শব্দ। অর্থাৎ ঘরে কলিমুদ্দি একা না, আরো লোক আছে। ছোট দোচালা ঘর। কথাবার্তার আওয়াজ যেটুকু আসছে তাতে অনুমান করা যায়—লোক খুব বেশি হবে না। বড়জোর চার-পাঁচজন। রশিদ ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিল—‘কলিমুদ্দি চাচা…।’

‘কে? এতো রাইতে কে…?’

‘আমি রশিদ…।’

‘রশিদ….?’

‘হ্যাঁ, রশিদ। দরজা খুলুন। সাথে অস্ত্র থাকলে হাতে নেয়ার চেষ্টা করবেন না। আমরা খালি হাতে আসিনি…।’

কলিমুদ্দির মাথায় যেন ঠাটা পড়লো। সে তো কল্পনাও করেনি—রশিদ আবার গ্রামে আসতে পারে। ভয়ে তার পা ঠকঠক করে কাঁপছে। দাঁতকপাটি লাগার মতো পরিস্থিতি। ভয়ে বাকি চারজনের অবস্থাও তথৈবচ।

‘চাচা, দরজা খুলে হাত উঁচু করে দাঁড়ান। দেরি করলে কিন্তু ঘরে আগুন ধরিয়ে দেবো। সবাই ঘরের ভেতর পুড়ে মরবেন…।’

কলিমুদ্দি ভয়ে পেচ্ছাব করে দিয়েছে। সে উবু হয়ে বসে পড়লো। এক রাজাকারকে বলল—‘মিয়াচান, দরজা খুইলা দে…।’

মিয়াচান দরজা খুলে দিল। রশিদ এক মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্দেশ্য করে বলল—‘রফিক, পাঁচটাকেই তোমরা বাঁধো। বেঁধে ঘাঁটিতে নিয়ে চলো। আর ওদের বন্দুক পাঁচটি নিয়ে নাও…।’

বাড়িতে এসে রশিদ নিজে সবার হাতের বাঁধন খুলে দিল। কলিমুদ্দিকে বলল—‘আমার মা-বাবা কোথায়? ময়না-শাহেদ কই…?’

‘নাই…।’

‘নাই মানে? কী হয়েছে…?’

‘পাকবাহিনীর সোলজাররা গুলি কইরা মারছে…।’

‘ঘরে আগুন দিয়েছিল কে…?’

‘ওরাই দিছিল…।’

‘ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল কে…?’

‘বাবা রশিদ, আমারে মাফ কইরা দেও। জীবনে আর এইরকম ভুল করুম না…।’

কলিমুদ্দি রশিদের পা জড়িয়ে ধরে। সে পা সরিয়ে নেয়। তারপর অন্য চার রাজাকারকে বলে—‘তোমরা…?’

এক ছেলে, বয়স আঠারো-ঊনিশের বেশি হবে না, বাড়ি পাইকড়া, সে বলল—‘স্যার, এই কলিমুদ্দি মোল্লা আর মওলানা কদ্দুস আমাগো ভুল বুঝাইয়া রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করছে। আমাগো মাফ কইরা দেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিমু…।’

‘তোমাদের বিশ্বাস কী…?’

‘বিশ্বাস যদি না করেন, এখনই গুলি কইরা মাইরা ফালান। এই যে হাত তুললাম…।’

চার রাজাকার দু’হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে রইলো…।

রশিদ কলিমুদ্দিকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর রাজাকারটার বুক বরাবর গুলি করলো। পরপর দু’টি…।

উপস্থিত সব মুক্তিযোদ্ধা ও চার রাজাকার সমস্বরে স্লোগান দিলো—‘জয় বাংলা…।’

দু’টি গুলির আওয়াজ, বহুলোকের সমস্বরে জয় বাংলা স্লোগান—বানকিনার মানুষের ঘুম ভেঙে গেল। ঘটনা কী? এতো রাতে গুলি করলো কে? জয় বাংলা স্লোগানই দিল কারা…?

ভোর হতে না-হতেই গাঁয়ে রাষ্ট্র হয়ে গেল—রশিদ বিএসসি তার দল নিয়ে ফিরে এসেছে। তাদের কাছে প্রচুর ভারী ভারী অস্ত্র। রাজাকার কলিমুদ্দির ভবলীলা সাঙ্গ করেছে রশিদ। সেই গুলির শব্দই তারা রাতে শুনেছে…।

নভেম্বর ১৯৭১…।

গাঁয়ে ফিরে আসার তৃতীয় দিন সকালেই রশিদ গ্রামবাসীকে নিয়ে বসলো। টাণ্ডুয়ার ট্রেনিং-ক্যাম্পে কর্নেল সুরজিৎ সিং বলতেন, ‘গেরিলাযুদ্ধ মানে জনযুদ্ধ, এলাকার জনগণকে সাথে নিয়েই এই যুদ্ধ করতে হয়। এখানেও ঘরে শত্রু রেখে বাইরের শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে জয়লাভ করা যাবে না। রশিদ গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বলল—‘আমরা আপনাদেরই সন্তান। আমরা দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে নেমেছি। হানাদাররা আমার মা-বাবা, ভাই-বোনকে হত্যা করেছে, এ জন্যে কোনো শোকতাপ নাই। আমি জানি—রক্ত ছাড়া দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি মেলে না। এই জন্যেই তো বঙ্গবন্ধু বলেছেন—রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো… দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ। অর্থাৎ, রক্ত বিনে মুক্তি নাই। আমরাও রক্ত দিতে প্রস্তুত। কিন্তু এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলে, যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে আপনাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা আপনাদের অকুষ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা চাই…।’

মনু মণ্ডল বানকিনার প্রবীণ মাতাব্বর। তার কথায় গ্রামের মানুষ উঠে-বসে। সে বলল—‘শোন রশিদ বাবাজি, আইজ থিকা, আমি বলতাছি, তোমার কথাই বানকিনার আইন। তুমি যা বলবা, তুমি যা চাও, আমরা গ্রামবাসী তাই মাইনা নিমু। তুমি কী সহযোগিতা চাও…?’

রশিদ বিএসসি খুব খুশি মনু মণ্ডলের কথা শুনে। সে বলল—‘আমরা আপনাদের কাছে বেশি কিছু চাই না। শুধু এইটুকু চাই, গাঁয়ের কেউ যেন আর কলিমুদ্দির মতো রাজাকার না-হয়, আমরা যে গাঁয়ে আছি, এটা যেন বানকিনার কেউ হানাদারদের কাছে ফাঁস না-করে…।’

মধ্য নভেম্বর, বানকিনার লোক তাদের কথা রেখেছে; নতুন করে কেউ আর রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়নি, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল যে এই গ্রামে ঘাঁটি গেড়ে আছে, এই খবরও হানাদারদের গোচরে দেয়নি কেউ। কিন্তু বানকিনার চারপাশে যে পাঁচটি গ্রাম—হাশড়া, পাইকড়া, কালোহা, রোয়াইল ও মৌরি—এইসব গ্রামে রাজাকারদের উপদ্রব সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। হাশড়ার মওলানা ইদ্রিস, পাইকড়ার মওলানা কদ্দুস, কালোহার জলিল মেম্বার; এই তিন রাজাকার-কমান্ডারের কাছে খবর পৌঁছে গেছে, কীভাবে কার মাধ্যমে এই খবর পৌঁছেছে তা বলা কঠিন, কোথাও যুদ্ধ শুরু হলে সত্যি-মিথ্যা নানা খবরও সৃজিত হয়; তিন রাজাকার খবর পেয়েছে—রশিদ বিএসসি তার দল নিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছে, কলিমুদ্দি মোল্লা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খুন হয়েছে; রশিদ-বাহিনী তাদেরকেও সুযোগ পেলে ধরাশায়ী করবে, সুতরাং তারা সুযোগ পাওয়ার আগেই তাদেরকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে, নিজেরা আক্রান্ত হওয়ার আগেই এই গাদ্দারদের দোযখে পাঠাতে হবে; এই পরিকল্পনা করে তিন রাজাকার…।

রশিদ ত্রিশ ছাত্র-যুবক নিয়ে টাণ্ডুয়া গেছিল। তার দলের সদস্য এখন ৫৫ জন। ট্রেনিং শেষে, তাকে যেহেতু থানা কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়, তাকে বাড়তি আরো ২৫ মুক্তিযোদ্ধা দেয়া হয়েছে। রশিদ নিজের সাথে ১০ জনকে রেখে বাকি ৪৫ জনকে ৯ জন করে ৫ গ্রুপে ভাগ করেছে। রশিদের নিজের গ্রুপ, বাকি ৫ গ্রুপ—সবাই সারাদিন বানকিনার ক্যাম্পে অবস্থান করে, রাত নামলেই গেরিলা অপারেশনে বের হয়। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বেরোয় তারা। সুবিধামতো ডাঙা-পথ পেলেই নৌকা ছেড়ে তারা পায়ে-হাঁটা শুরু করে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের এলেঙ্গা, ইছাপুর, শোলাকুড়া, বাংড়া, বাঘুটিয়া—হানাদারদের টহল গাড়িতে আক্রমণ করে…।

কালিহাতী থানা ও এলেঙ্গা সাব-থানার কমান্ডারের মেজাজ ভীষণ-রকম বিগড়ে গেছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় শরাব পান করার পরও তাদের মেজাজ ঠাণ্ডা হচ্ছে না। ঘটনা কী? পাকা সড়কে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা টহল, সড়কে ওঠার সব পথে, পায়ে-হাঁটা কাঁচা সড়ক কি নৌকার পথ—সব পথে চেকপোস্ট, তারপরও মুক্তিরা কোত্থেকে কীভাবে এসে হামলা করছে…!

বানকিনা থেকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়কের দূরত্ব ১০ মাইলের কম হবে না। এই সড়কে যেতে হলে বালিয়াটা বাজারের পূর্বপাশে নৌকা রেখে বালিয়াটা-পৌজান রাস্তা ধরে যাওয়াই সুবিধা। বালিয়াটা বাজারে রাজাকাররা সারারাত ডিউটি করে। দিনের বেলায়ও নজরদারি করে। সন্দেহজনক কাউকে পেলেই আটক। জিজ্ঞাসাবাদ। সদুত্তর না-পেলে হাত বেঁধে, চোখ বেঁধে এলেঙ্গা সাব-থানায় পাকবাহিনীর কাছে সোপর্দ। পৌজান বাজারেও রাজাকার আছে। তাহলে মালাউনের বাচ্চারা কোন্ পথ দিয়ে যাতায়াত করে? রশিদের লোকেরা একদিনও কেন তাদের চোখে পড়বে না—এটাই বালিয়াটা বাজারের রাজাকার কমান্ডার জয়নাল ভেবে পায় না…।

মওলানা কদ্দুস রাজাকার বাহিনীর ইউনিয়ন কমান্ডার। সে জয়নালকে আশ্বস্ত করে—‘তোমাকে আর ভাবতে হবে না জয়নাল। আমি আজই এলেঙ্গা গিয়ে ক্যাপ্টেন স্যারকে বিষয়টা জানাবো…।’

দু’দিন পর ভোরবেলা ক্যাপ্টেন সুলতান বানকিনা আক্রমণের পরিকল্পনা করে…।

সেদিন ২৫ নভেম্বর…।

নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ, মানে—বাংলাদেশে হেমন্তকাল, কার্তিক মাস। বানকিনার চকে তখনো সামান্য জল আছে। হাঁটু জল। গাঁয়ের পায়ে হাঁটা রাস্তা তখনো বের হয়নি, ডিঙ্গি নৌকা নিয়েই গাঁয়ের পথে যাতায়াত করতে হয়; তবে বালিয়াটা-বল্লা-রামপুর-রতনগঞ্জ যে-রাস্তা, এই রাস্তার জল তখন সরে গেছে, মানুষ ডিঙ্গি নৌকা ছেড়ে দিয়ে এই রাস্তায় পায়ে হাঁটা শুরু করেছে, দু’চারটি গরুরগাড়িও কষ্টেসৃষ্টে চলাচল করে, কিন্তু বানকিনা যেতে চাইলে ডিঙ্গি নৌকাই ভরসা…।

পাঞ্জাবি হানাদাররা জল দেখে ভয় পায়। ওরা মরুভূমির লোক, সাঁতার জানে না, নৌকা কি স্পিডবোট—কোনোকিছুতে চড়েই জলপথে যেতে চায় না। কিন্তু মওলানা কদ্দুস ক্যাপ্টেন সুলতানকে বোঝানো শুরু করে—‘স্যার, এখন নভেম্বর মাস, চকে সামান্য পানি, স্পিডবোট ডুবে যাওয়ার কোনো শঙ্কা নাই…।’

বালিয়াটা বাজার হানাদার-রাজাকারদের নিরাপদ একটি জায়গা। উজানে পৌজান-ভবানীপুর-চেচুয়া-মসিন্দা তাদের দখলে, ভাটি এলাকা জলমগ্ন। হানাদাররা মাঝে-মধ্যে বালিয়াটা বাজারে আসে। বাজারের ঘাটে তিনটি স্পিডবোট বাঁধা থাকে। জয়নাল সেদিনও বোট তিনটি প্রস্তুত রেখেছিল…।

তিনটি বোটে ৩০ জন হানাদার। সামনের বোটে ক্যাপ্টেন সুলতানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মওলানা কদ্দুস। তার হাতেও বন্দুক…।

ক্যাপ্টেন সুলতান ভেবেছিল—ঘুমন্ত অবস্থায়ই রশিদ এবং তার দলের সবাইকে খতম করবে। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি! তারা সিকদারবাড়ির ঘাটে নেমে ফায়ার ওপেন করার আগেই রশিদ-বাহিনী আক্রমণ করে…।

বুড়ো মনু মণ্ডল প্রাতকৃত্য সারতে ভোরবেলা বাড়ির ঘাটে এসেছিল। তার চোখে পড়ে গাঁয়ের দিকে স্পিডবোট নিয়ে হানাদার আসছে। সে পড়িমরি ছুটে গিয়ে রশিদকে খবরটা দিয়েছিল। প্রস্তুত ছিল রশিদ-বাহিনী। হানাদারদের স্পিডবোট তাদের রেঞ্জের মধ্যে আসামাত্রই তারা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে…।

আকস্মিক আক্রমণের মুখে পড়ে হতভম্ব হয়ে যায় হানাদাররা। এভাবে তারা আক্রান্ত হতে পারে—এটা তাদের কল্পনার মধ্যেও ছিল না। সামনে কোনো আড়াল নাই। মুক্তিরা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়ছে। এখানে যুদ্ধ করা বোকামি ছাড়া কিছু না। একটা সোলজারও প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না। ক্যাপ্টেন সুলতান তৎক্ষণাৎ হুকুম করে—‘বোট ঘোরাও…।’

পাইকড়ার সেই তরুণ ছেলেটি, আরমান, সে রশিদের পাশেই ছিল। সে বলল—‘স্যার, স্পিডবোটে পাঞ্জাবি-পরা লোকটাকে দেখছেন, ওই লোকটাই মওলানা কদ্দুস…।’ বলতে বলতেই মওলানা কদ্দুসকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে আরমান। গুলি খেয়ে ধপাস করে জলে পড়ে সে। রশিদের গুলি লাগে ক্যাপ্টেন সুলতানের মাথায়। সেও জলে পড়ে যায়। আরো চার হানাদার গুলিবিদ্ধ হয়ে জলে পড়ে। বানকিনা চকের জল লোহিতবর্ণ ধারণ করে…।

হানাদাররা পালাতে-পালাতেই মেশিনগান দিয়ে গুলি ছুঁড়ছিল। হঠাৎ একটি গুলি লাগে আরমানের গলায়। মনু মণ্ডলের মাথায় লাগে একটি গুলি। আরমান যুদ্ধ করছিল। মনু মণ্ডল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল যুদ্ধ, হানাদারদের পলায়ন আর গুলি খেয়ে তাদের জলে পতন…।

পাদটীকা
১ ডিসেম্বর ১৯৭১…।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পতন আসন্ন। তাড়া-খাওয়া কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে তারা। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক ধরে এগিয়ে আসছে ভারতীয় বাহিনীর কনভয়। পথপ্রদর্শক কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধা। পাহাড় থেকেও কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধারা দলে দলে আসছে। তারা রতনগঞ্জ-বল্লা-বালিয়াটা সড়ক ধরে পায়ে হেঁটে এগুচ্ছে। এলেঙ্গায় মূল দলের সাথে যোগ দেবে…।

মুক্তিযোদ্ধাদের জয় বাংলা স্লোগানে কাঁপছিল রাস্তা। কাছাকাছি গাঁয়ের লোকজন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দূর থেকেই হাত তুলে তাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। বানকিনার মানুষও বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছে। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হাত নাড়ছে। তাদের কারো কল্পনার মধ্যেও ছিল না মুক্তিযোদ্ধারা শুভেচ্ছার বিনিময়ে তাদের ওপর মেশিনগানের গুলি ছুঁড়বে…।

কিন্তু তাই ঘটলো। কাদেরিয়া বাহিনীর এই দলের পেছনের দিক থেকে দুই মুক্তিযোদ্ধা হঠাৎ বানকিনার দিকে মেশিনগান তাক করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। গুলিবিদ্ধ নারী-পুরুষের রক্তে ভেসে যায় বানকিনার মানুষের ঘর-দুয়ার…।

এই দুই মুক্তিযোদ্ধা কেন বানকিনার শুভেচ্ছাজ্ঞাপনকারী মানুষের ওপর গুলি ছুঁড়লো, না কাদেরিয়া বাহিনীর কেউ, না বানকিনার কোনো মানুষ, কেউ তা জানে না। জানে শুধু রশিদ বিএসসি…!

About The Author

শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে থাকুন...