সর্ষে ফুল
সুনীল শর্মাচার্য
সর্ষে ফুল
বেশ্যার শরীরটা তার নিজের নয়। তার কোনো নিজের ঘর নেই। কোনো নামও নেই। নাম দেয় মাসি। কিন্তু ললিতা ব্যতিক্রম। তৃতীয়বার মালিকানা বদলের সময় তার নাম রাখা হয় কাজরী।
সেই তার প্রথম নকল নাম। মুম্বাই-এর সেই রেণ্ডিখানায় প্রথম খদ্দের তাকে আদর করে যখন ‘এ মেরি কাজরী রাণী’ বলে চিবুকে চুমু খায়; তখন সে নববধূর ব্রীড়াশীলা হয়ে ছলোছলো চোখে বলে—মেরি আসলি নাম ললিতা।
—দেখো কাজরীয়ানি ললিতা, রেণ্ডিকা ন বাপ হ্যায় ন মা। ন ঘর হোতা ন শৌহর। পুরানা নাম সে ক্যা মতলব। ফিরভি আজ পহলা রাত, নয়ি জিন্দগী ম্যায় তুমহে ললিতা হি বুলাউঙ্গা…
‘পহলা রাত’ কথাটা শুনে সে বুঝে যায় মাসি মোটা টাকা গেঁড়িয়ে তার কুমারীত্ব বিক্রি করেছে
লোকটাকে। আহা রে লোকটা জানবেই না যে, হাত বদল হতে হতে কতবার কত লোক ওর
অনাঘ্রাত কুমারী যৌবন দলে পিষে থেঁতলে চলে গেছে। সে চেপে গেল।
পর পর সাত রাত ধরে মাসি নতুন নতুন খদ্দের লেলিয়ে দিয়ে তার মিথ্যা কুমারীত্ব বিক্রি করে মোটা টাকা কামিয়ে ফেলল। ললিতা নামটাই হয়ে গেল চাউর। মাসি ওটা আটকাতে পারল না।
এরপর কত হাত ঘুরে কীভাবে ললিতা সোনাগাছিতে পৌঁছল সে-কথা সেও জানলো না।
এখন সে লাজলজ্জাহীন নিঃসঙ্কোচ বেশ্যা জীবনের প্রাত্যহিকে ঢুকে পড়েছে। সেখানে মাতাল-বর্বর খদ্দের যেমন, তেমনি সহানুভূতিশীল লোকও আসে। অনেক বাবু তাকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়ে কোথায় চলে গেছে, সে আর কোনোদিন তাদের খুঁজেও পায়নি।
এখন আর সেসব নিয়ে ও তেমন মিথ্যে স্বপ্ন দেখে না। এখন তাকে ঘিরে এক কাদার জীবন। এই সোনাগাছির গলিটা কোনো কোনোদিন মায়াবী হয়ে ওঠে। হঠাৎ। হঠাৎ…
অনেক অনেকদিন পর আজ রাতে এসেছে মাসুদ মিয়া। ও এলেই ললিতার কাছে গলিটা হয়ে ওঠে মায়াময়। কাদাপাঁকের ওই অন্তহীন নরকে ঠিকরে পড়ে স্বর্গীয় আলো। তড়কা-রুটি-পেঁয়াজ-লঙ্কা আর বিলাইতি নিয়ে সে সটান ঢুকে পড়ে ললিতার ঘরে। সবাই হিংসে করে।
যেদিন ঘরে অন্য খদ্দেরকে সে আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকে, মাসুদ ধৈর্য ধরে গলির মোড়ে পানদোকানে বসে বসে সিগ্রেট টানে। কাজলা, করিশমা, গৌরীরা মিয়ার হাত ধরে টানাটানি করলেও, পাবে না ওকে। ও শুধু ললিতার। ঝামেলা লাফড়া মিটিয়ে গা ধুয়ে দরজা খুলে মোড় থেকে ওকে আদর করে আনতে ছোটে ললিতা।
মাসুদের বুকে লম্বা কাঁচা পাকা চুলের গুচ্ছ। ধূসর ওই বুকে মাথা রেখে ললিতা আধো আধো আদুরি গলায় জানতে চায় মিয়ার রোমাঞ্চকর সব অভিযানের বৃত্তান্ত।
এবার তুমি কোত্থেকে এলে গো, বল না—উঁ
বহেড়াগোড়া।
সেটা কোথায়? নাম শুনিনি তো!
বিহার বংগাল আর ওড়িষার বর্ডার আছে। লাল মিট্টির দেশ। জংগল, নদী, পাহাড়…
কি নদী গো?
নদীর নাম বড়া সুইট আছে, সওন্নরেখা—গোল্ড পাওয়া যায় দরিয়া থিকে।
তুমি আমার জন্যে আনলে না তো, যাও একটুও ভালোবাসবো না…
ললিতা তু পাগলি আছিস নাকি? গোল্ড আমি কি আনব! তু যদি দেখিস, গোল্ড গোল্ড বলে আর কখুনও চিল্লাবি না!
কেন মিয়া?
উত্থানে, নদীর ধারে জেনানারা সাহরা দিন বসে বসে বালু চালছে তো চালছেই—খুন পসিনা এক হো গয়া—কুনহ দিন কিসমতে থাকে অ্যাই এওটুকুন একটা সরষো দানার মাফিক গোল্ড পায় কি পায় না—ফির মিলল তো শালা মহাজন দালাল দিমাক খারাপ করে দিবে—উত্থান থেকে আমি গোল্ড আনব…
কি দারুণ না!
কিসের কি দারুণ হলো?
ওই যে, সোনার বরণ নদী, দু’দিকে পাহাড় আর জংগল, আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি বউরা বসে বসে বালু চালছে আর সোনার দানাগুলো আঁচলে বেঁধে রাখছে গিঁট দিয়ে।
আচ্ছা, নদীর ঠিক ধার ঘেঁষে অনেক দূর পর্যন্ত ওখানে সর্ষেফুল ফুটে আছে না?
সরষে কা ফুল?
হ্যাঁ গো, সর্ষেফুল কি চেনো না নাকি? সোনা হলুদ, সর্ষে ফুলও হলুদ—নদীর ধারে ধারে শীতকালে ভারি সুন্দর লাগে, দেখনি তুমি?
তোর দিমাক খারাব আছে ললিতা, তু বহোত দারু পিয়ারে…
ধুস্ শালা ট্রাক ড্রাইভার, খালি জেনানা দেখবে লাইন মারবে…
ফাল্তু বাত বোলবে; তুর উপর এমন গাড়ি চালিয়ে দিব না… ডেরাইভারের মর্দানি দেখবি নাকি, হেই ললিতা!
আরে মরদ আমার—লিতা ওর চাপ দাড়িতে চিমটি কাটে, আবার ‘লাগল’ বলে ন্যাকামিও করতে থাকে। এ খেলা মাসুদের খুব পছন্দ, ঘুমিয়ে পড়ে ও।
দূর থেকে, ওসব পাড়া যেমন হয়—মাতালে প্রলাপ ও গান, চিৎকার, দলবদ্ধ নেড়িদের ছোটাছুটি, ঘাঁক ঘাঁক গোঙানি, গোঙানি ও কলতলায় হড়হড় বমির ঘিন ঘিনে শব্দের আঁশটে গন্ধ ভেসে আসে। ওর ঘুম আসে না।
বোধহয় গৌরীর ঘর থেকে নাচতে নাচতে ঢুকে পড়ে ওর ঘরে—একটা রগুরে গান—তুমি যেখানেই যাও না কেন পিয়া, আমি তোমার ঘুঙরু হয়ে বাজব, কাঁকন হয়ে ঝনঝনাব, কানের দুল হয়ে দুলব, দুষ্টু হাওয়া হয়ে তোমার খসিয়ে দেব আঁচল—তখন তুমি…
বাচ্চাকে মা যেমন ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরিয়ে দেয়, পা’টা তুলে দেয় বালিশে, ভাঁজ হওয়া হাত খুলে সোজা করে দেয়, তেমনি গভীর বাৎসল্যে মাসুদের বেহুঁশ, মাতাল শরীর পরিচর্যা করে ললিতা।
অনেক বছর ধরে অসংখ্য-লম্পটের বীর্য থেকে তেড়ে আসা কীটের দল কতবার না শরীরে বাসা ছিনতাই করেছে, প্রত্যেকবার তাদের টিপে টিপে মেরেছে ও। নিরুপায়। সেইসব অন্ধকীটের, ভ্রূণের দল জোট বেঁধে আজ চুপিসারে ঢুকে পড়েছে ঘরে। সেকি মাসুদ মিয়া?
না-কি সব নষ্ট ভ্রূণের মিলিত এক দৈত্যাকার লোমশ শিশু! ঘুমন্ত ওই দানব শরীর ঘিরে অজস্র আর্ত অস্ফুট। ভীত ললিতা দৌড় লাগায়।
অনেক অন্ধকার গলি ঘুঁজি নর্দমা ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে সে দেখতে পেল জঙ্গল, জঙ্গল থেকে পাহাড়, পাহাড় থেকে নামতে নামতে হঠাৎ একদল মাতাল কামুক টেনে ধরে ওর আঁচল, তাদের হো হো হো হাসির ভেতর থেকে ছুটে আসে আগুনের গোলা—রেণ্ডি হ্যায় বে, খানকি কোথাকার!
শরীর থেকে ভয় ছুটে পালায়, জেগে ওঠে ঘৃণা ও ক্রোধের দৃপ্ত ভঙ্গিমা—ও ঘুরে দাঁড়ায়। কোথায় পাহাড়!
—ওর সামনে হলুদের বান—মাইল মাইল শীতের রৌদ্রমাখা মিষ্টি হাওয়ায় হুটোপুটি খাচ্ছে সর্ষের আদিগন্ত ক্ষেত। সে রাতে নেশাটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল ললিতার!
.
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
নিহিত মর্মকথা : সুনীল শর্মাচার্য
প্রয়াণগাথা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তপদ্য
ইচিং বিচিং পদ্য : সুনীল শর্মাচার্য
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প : সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মতামত
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হাল্কা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
রাজনীতি বোঝো, অর্থনীতি বোঝো! বনাম ভারতের যুবসমাজ
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
ভারতের CAA NRC নিয়ে দু’চার কথা
ভারতের এবারের বাজেট আসলে অশ্বডিম্ব, না ঘরকা না ঘাটকা, শুধু কর্পোরেট কা
ইন্ডিয়া ইউনাইটেড বনাম সেলিব্রিটিদের শানে-নজুল
করোনা, ভারতীয় জনগণ ও তার সমস্যা
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা
সুনীল শর্মাচার্যের দশটি কবিতা
নাসিমা খাতুনের কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের কবিতা