সাতটি মিনি গল্প
সুনীল শর্মাচার্য
সাতটি মিনি গল্প
বিড়াল
আমার মধ্যে একটা বিড়াল রাতদিন ঘুরে বেড়ায়। সে মাছের গন্ধের কাঙাল। পথে-ঘাটে যেসব কাঁচামাছ চোখে পড়ে, তাতে আঁশটে গন্ধ। তার খেতেও অরুচি। ভাবি, বিড়াল মাছ খাবে না তা কি হয়? কাঁচা হোক, পাকা হোক, মাছ হলেই হলো!
এই বিড়াল স্বভাবের জন্য বন্ধুরা আমাকে ত্যাগ করেছে। অনেকেই কেমন কেমন ভাব দেখায়। আমার তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। আমি জানি, বাইরে, ঘরে, পথে-ঘাটে, যানবাহনে, অফিস-কাচারিতে সর্বত্রই বিড়াল এখন ঢুকে পড়েছে।
আসলে, বিড়াল-স্বভাব এখন সবাইকে পেয়ে বসেছে। তাই অন্য বিড়ালকে আর সহ্য হয় না!
.
মুরগি
সবাই আমাকে মুরগি ভাবে। আমি প্রতিদিনই মুরগি হই। মুরগি হতে থাকি। আমার স্বভাবটাই নাকি মুরগি মুরগি।
বউ বলে। এত সরল, সোজাসাপটা লোকের সঙ্গে ঘর করা চলে না। আমার মুরগিত্ব নিয়ে সে হাসাহাসি করে। আমি কষ্ট পেলেও, দুঃখ পাই না। ভাবি, কপাল।
যুক্তিতর্কে বাস্তবের মিল না-পেলে, মনের মতো কিছু না-হলে সবাই যেমন কপালের দোষ দেয়। আমিও তেমনি। কপাল বিশ্বাস করি। কপাল ছাড়া আর কি বলি!
ছোটবেলায় আদর্শলিপি পড়েছি। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় পড়েছি। নীতিকথা মান্য করেছি। এখন সেইসব নীতিকথাও কেমন জোলো লাগে। দিনে দিনে নীতির দিন শেষ। এখন অ-নীতির রামরাজত্ব!
আমিও মানি। বিশ্বাস করি। জীবনের পথে চলতে চলতে ঠোকর খেতে খেতে আমি মুরগিই হয়ে গেছি।
আর ভাবি, মুরগি কি আমি একা? পথে-ঘাটে, ঘরে ঘরে আমার মতো অনেক মুরগি আছে। নইলে, চারদিকে মুরগি কেটে কেটে, দিনে দিনে এত মুরগিব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়ছে কী করে!
.
ঠিকেঝির গল্প
বাড়ি বাড়ি কাজ করে যা পায় মেয়েটি তাতে সংসার চলে না। তবু সংসারের স্বাদ-আহ্লাদ এর মধ্যেই মেটায়। অন্যবারের মতো এবারেও মেয়েটির হাতে সামান্য বেতনের আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না।
অসুস্থ-শয্যাশায়ী স্বামীর জন্য ওষুধ কিনল। যেমন বছরের পর বছর সে করে আসছে। ছেলেপেলেদের জন্য কিছু মিঠাই, দু-একটা নোট বই, খাতা কিনল।
এই প্রথমবার সে সামান্য টাকা বাঁচাল, তা দিয়ে নিজের জন্যে সস্তা পাউডার, কাজল, নেলপালিশ, সুগন্ধি কিনল। এসব কিছু সে অন্ধ দোকানির কাছ থেকে কিনল। ফুটপাতে গুটিসুটি মেরে সে পসার সাজিয়ে বসেছিল।
.
পুনর্মিলন
এক বিশেষ সভায় জনসাধারণকে উপস্থিত থাকতে বলা হল। যে শিকড়-হীনতার ভয়ঙ্কর দুর্দশার আতঙ্ক তাদের তাড়া করে ফিরছিল, তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য।
যখন সভা শেষ হলো, তখন তারা সর্বগ্রাসী খিদের যন্ত্রণায় কাতর। হাভাতের মতো তারা ছুটে গিয়ে
মুঠো মুঠো খাবার তুলে খেতে লাগল।
এ-রকমভাবেই গোগ্রাসে খাওয়াটা তাদের চিরদিনের ঐতিহ্য। খাওয়া শেষ হলে তারা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমতে লাগল।
.
শিকার
তাড়াহুড়ো করে ওরা নামল। কালিঝুলি মাখা জামাকাপড় আর না-কামানো দাড়ি নিয়ে ওরা আলোর নিচে এসে জড়ো হলো। ওরা এক নিষ্ঠুর নাচ নাচল। ওদের রক্তমাখা ছুরি ওদেরই ঊরুতে বিঁধে রইল। সূর্য ওঠার আগে ওরা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
ভোরে, কয়েকটি শিশু একজন নারীর দেহের ওপর তিড়িংবিড়িং লাফাল। এরপর শহরের শেষ প্রান্তে নারীটিকে মৃত অবস্থায় দেখা গেল।
তার বিধ্বস্ত দেহের—কটিদেশ থেকে বুক পর্যন্ত সাতাশবার ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। তার স্তনে, তার অজাত শিশুর জন্য যে দুধ ছিল, তা জমে নষ্ট হয়ে গেছে।
.
কালচক্র
বাচ্চা ছেলের জন্য বাজার থেকে বাবা কিনে এনেছেন তীরধনুক। বাচ্চা ছেলে ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে পয়লা চোটেই ঘায়েল করল দাদুর চোখ!
রক্তাক্ত চোখ নিয়ে দাদু বলল, দাদুভাই, তুমি তো ছেলেমানুষ, অর্থাৎ তুমি হলে ভবিষ্যৎ—অতীতের চোখ অন্ধ ক’রে দিলে! ভালোই করেছ! তবে বর্তমানকে যেন কানা করে দিও না ভাই!
.
তাই
নষ্ট মহিলাটি একটি খোলা জায়গায় প্রসব করে। উঁচু একটি ঢিপির পেছনে সে ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসেছিল। এক টুকরো কাপড় দিয়ে সে শিশুটিকে জড়াল। তারপর নিজের ভাগ্যের কথা স্মরণ করল।
সে কী শিশুটিকে কোন গেরস্থের দরজায় চুপিচুপি ফেলে যাবে? ওরা তাহলে ওকে মানুষ করবে। একদিন দেশের নাগরিক হবে। না, কোনো নিঃসন্তান মহিলার ঘরের দরজায় রেখে যাবে। যার বৃদ্ধ ধনী স্বামী, যার পুত্রসন্তান নেই, তার কাছে ছেড়ে যাবে।
সিদ্ধান্ত নেবার আগেই মহিলাটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। সদ্যজাত শিশুটি হঠাৎ বজ্রের মতো সবেগে বড় হয়ে উঠল। সে তার মায়ের দেহ দু’হাতে তুলে কাছের এক বনভমিতে কবর দিলো। আর কবর দেয়া পর্যন্ত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল।
তারপর সে হাঁটতে লাগল। আর মানুষকে ভালোবাসার কথা বলতে লাগল। অবশেষে নগর সেপাই তাকে গ্রেফতার করল। কারণ, সে কে? তার কোনো পরিচয়পত্র ছিল না!
কে তার পিতা, কোথায় থাকে তার পরিবার-পরিজন। সে কিছুই বলতে পারল না!
তাই…
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
নিহিত মর্মকথা : সুনীল শর্মাচার্য
প্রয়াণগাথা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তপদ্য
ইচিং বিচিং পদ্য : সুনীল শর্মাচার্য
ছড়া
অণুগল্প
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প : সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মতামত
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হাল্কা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
রাজনীতি বোঝো, অর্থনীতি বোঝো! বনাম ভারতের যুবসমাজ
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
ভারতের CAA NRC নিয়ে দু’চার কথা
ভারতের এবারের বাজেট আসলে অশ্বডিম্ব, না ঘরকা না ঘাটকা, শুধু কর্পোরেট কা
ইন্ডিয়া ইউনাইটেড বনাম সেলিব্রিটিদের শানে-নজুল
করোনা, ভারতীয় জনগণ ও তার সমস্যা
2 thoughts on “সাতটি মিনি গল্প”