তিলফুল
জ্যোতি পোদ্দার
.
গতকাল টব এঁকে রুয়ে দিয়েছি মাধবীলতা।
মাধবী তোমার নিত্য সহচরী।
তোমার মতো জড়ানো ছড়ানো মেলবন্ধন স্বভাব।
.
আমি একাকী পথিক
হাঁটতে হাঁটতে দেখি তোমার নিজস্ব স্বর।
.
কাল পেন্সিলে এঁকেছি ছোট ছোট কলি
আজ দেখি ছেয়ে গেছে টব
উজ্জ্বল মুখশ্রী
সাদা আর নীলে কাজ করা
বাতাসের সাথে খেলছে মাধবীলতা।
.
তখন আমি আর হাঁটি না।
টবের একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাতের ভাঁজে একে একে
কুড়িয়ে তুলব তোমার সৌরভ
আর তোমার অধর থেকে খসে পড়া তিলফুল।
.
একাকী পথিক আমি
হাঁটতে হাঁটতে দেখি তোমার নিজস্ব স্বর
তোমার যাপনকলা।
তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার
২
আমার নোটেশনের সুর বা স্বর একমাত্রার কারণে আমি মূলত ঘাড়ত্যাড়া ব্যক্তি। সঙ্গ ও সঙ্গিকে কয়েক কিলোমিটার দূরে কোনো লোকাল বাস স্টপেজে ফেলে এসেছি। বলে রাখা ভালো, অনিচ্ছায় নয়—ইচ্ছায়; স্বেচ্ছারিতার আক্ষরিক অর্থ মেনে।
.
ঘাড়ত্যাড়া ঠেডার সুবিধা এই যে, আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
মানে দৃশ্যত শত্রু নেই।
শরিকানার হিস্যার মামলা মোকদ্দমা নেই।
এমনকি গণতান্ত্রিক কূটচালের কোনো কর্মতৎপরতা নেই।
এতো এতো নেইয়ের ভেতর, গোপনে বলি, আমি কিন্তু শর্ষে তেলের ডিব্বা রাখি।
.
একটু তলিয়ে দেখলে শত্রু নেই—কথাটা থাটে না, বরং আমি নিজেই শত্রু শত্রু খেলা খেলতে খেলতে শত্রুতা জারি রাখি। যতটুকু বৃত্ত রাখি—ততটুকু ছদ্মবেশী শত্রু রাখি।
.
এসব মিডিয়া জানে। আপনি পাশে থেকেও আন্ধারে।
এক্সচেঞ্জ ভ্যালু এ্যাড না-হবার কারণে
মিডিয়া রাষ্ট্র করেনি।
তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার
৩
ছায়ার শরীর রক্তাক্ত করার যে চার্ম সেটি আপনি জানেন না।
.
ক্যারাম খেলায় কৌশল যার যার তার তার।
প্রথম স্ট্র্যাইকে ছত্রভঙ্গ করার ভেতর
যে ভয় ও সম্ভবনা লুকিয়ে থাকে
সেটি কেন আপনাকে বলে খেলার মৌতাত নষ্ট করব?
.
পরের দৃশ্যটি সিনেমাটিক। এখনো শ্যুট করিনি।
শুকনো বালি
টপ টপ টপ—ধীরে সশব্দে শরীর থেকে রক্ত ঝরছে।
শুকনো বালি লালে লালে কালচে খয়েরি।
(ক্লজ শর্ট)
মাছির ভন ভন
চাপাতি
ছেঁড়া স্যাণ্ডেল
রেড পকেটে ফেলতে-না-ফেলতেই সার্পোট দিতে না পারলে
আপনি পক্ক খেলোয়াড় নন।
গুটি ও পকেটের দূরত্ব শুধু আঙুলের টোকার উপর
নির্ভর করে না।
ম্যাচ জিতবার যে গুপ্ত বিদ্যা সেটি অজানা থাকার কারণে
আপনি জানেন না—ছায়ার শরীর রক্তাক্ত করার চার্ম
কী ভীষণ রোমাঞ্চকর!
.
কোলগেটের হাসি বিজ্ঞাপিত হবার পরই প্রাইম নিউজে
ক্যামেরাম্যান উঁচু টাওয়ার থেকে লাইভে জুম শর্টে দেখাচ্ছে
.
টঙ দোকানে স্টার জলশা দেখতে দেখতে
মনুষ্যকুল কুট কুট করে কালচে দাঁতে
বিস্কুট খাচ্ছে।
শব্দ করে চা খাচ্ছে।
আর দমে দমে বিড়ি ফুঁকে ফুঁকে ক্রমেই ধোঁয়াটে করছে টঙঘর।
তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার
৪
যে নিঝুম পাড়ায় খোকারা একদিন মায়ের কোলে
মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল নিশ্চন্তে
সেখানে এখন হাই রাইজিং
কর্পোরেট অফিসপাড়া।
.
মায়ের গল্পে নটে গাছটি মুড়িয়ে খোকাও ঘুমাল পাড়াও জুড়ালো
এবং মা আমার একদিন বৃদ্ধ হলেন
আর খোকা লায়েক হলো বছরে বছর।
.
বর্গীরা আনসিন থেকে বেরিয়ে এলেন সিনে ফটোগ্রাফির ফ্রেমে।
কর্পোরেট অফিস পাড়ায় তিনি এখন
নির্বাহী আর ব্লু ম্যানেজার।
.
উন্নয়ন বিষয়ক প্রকল্প নীতি নির্ধারণী সভায় কথা বলছেন
তিনি হোম অফিস থেকে।
বনায়ন মানে বৃক্ষরোপণ সামাজিক বনায়ন
সারি সারি আকাশমনি
আর ইউক্লিপটাসের ইকোপার্ক।
.
মা ঝাপসা চোখে হাসতে হাসতে খোকার গলায়
ঝুলে থাকা টাই দেখেন আর বিড় বিড় করে বলেন
.
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে?
খোকা নাচাল পাড়া পোড়ালো বর্গী থাকলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে?
তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার
৫
আট আনা চার আনা এক টাকা জলে ধুয়ে টেকে তুলতেন সুবোধ’দা। সুবোধ’দা বৈষ্ণব। ছিপছিপে গড়ন। গলায় তুলশীর মালা ছুঁয়ে ধরাতেন সকাল নয়টার চুলো।
.
জিবে একগাদা রস নিয়ে আমরা দেখছি
সুবোধ’দা ঝাঝরা হাতায় উল্টে পাল্টে দিচ্ছেন সিঙ্গারা
.
গরম তেলে সিঙ্গারা টগবগ করছে। ছাতার মতো মেলানো কড়ুই গাছের নিচে আগুনের তাপে ভাপে সুবোধ’দার শাদা পিঠে ছোটছোট দলা পাকানো ঘামে দরদরে বইছে।
.
টিফিনে চাপ পরে সুবোধ’দার। দ্রুত হাতে একবার তাওয়ায় উল্টে দিচ্ছেন
বিক্রি করছেন সহসা কণ্ঠিত ছুয়ে কী যেন বিড়বিড় করতে করতে তাকাচ্ছেন আকাশে হাসছেন আবার বাম হাতে উস্কে দিচ্ছেন চুলার আগুন।
.
সুবোধ’দা জলে ধুয়ে টেঁকে তুলতেন টাকা পয়সা
তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার
৬
তিনটি জীবন আমার। একটি অপর দু’টি
অপেক্ষায় অধিক প্রশস্ততায় বিন্যস্ত।
.
এবং দুটির যোগফল অপেক্ষা
নেট জীবনের স্কোরিং ঊর্ধ্বমুখী।
.
তিন বাহুর তিনটি জীবন নিয়ে
কাজে কামে আছি
আছি উপাসনায়
আর আছি নিয়ত হাজির তরঙ্গ খণ্ডে।
তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার
৭
একটি দু’টি নয় বরং অজস্র বিন্দুর ছড়াছড়ি।
যে কোনো বিন্দু দিয়েই আঁকতে পারো
যে কোনো সাইজের বৃত্ত।
.
কোনো বৃত্তই কোনোটার মতো নয়।
কোনোটা মৃন্ময়ী
কোনোটা ধ্যানী যোগীর নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে
জ্বালিয়ে রেখেছে পঞ্চপ্রদীপ।
.
আবার কোনো বৃত্তের ব্যাসার্ধে বসে আছে
এক জোড়া কথা বলা কাকাতুয়া।
.
কেন্দ্রের সেন্ট্রি রাজা চেক দিলেও
পরিধিজুড়ে যে ধারাপাত বিন্দুর বাড়-বাড়ন্ত সংসার
সেদিকেই আমি হেলে পড়ি।
.
আর কোনো বৃত্তের ব্যাসার্ধে গড়ে
তুলি আমার একান্ত
নিরাজন।
তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার
৮
তুমি মিঞা ঠেডা পুরুষ
ঠারে ঠারে নানা কথা কও
.
আধেক বুঝি আর আধেক বিড়ির ধোঁয়া।
সাজ রাইতে কথাতে ফোটাও হলুদ ফুল
রাইত পোহালে চোখে মুখে
ছড়াইয়া দেও মরিচফুল
.
কচকচ করে বুকগলা জ্বলে
হেচকি দিয়া কান্না আসে
কাউরে বেবাক কথা কইতে পারি না।
.
তুমি মিঞা ঠেডা পুরুষ মানুষ
কথার ভাঁজে কথা রাইখ্যা
বিনা জলে চিড়া ভিজাও
.
তুমি মিঞা ঠারে ঠারে কথা কওনের গোঁসাই
তুমি মিঞা দখলদারের নায়েব মশাই
তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার
৯
এতো এতো রোদ, তবু তোমার চিবুকে এক
বুক অন্ধকার।
.
পাঠ থেকে পাঠান্তে কেবল মিছে ছুটে চলা
দু’হাতে রেখেছি তবু
প্রত্নবীজ।
.
এতো রোদ তবু এক বুক অন্ধকার নিয়ে
লিখছো পাতায় তুমি অর্থহীন দিনলিপি?
প্রত্নবীজ দেখলে না?
.
এমন চিবুকে আমি রাখিনি আমার কোনো মুখ।
.
সরে সরে যাচ্ছে মন ও মনন ভুমি
ঘরের ভেতর ঘর
.
নিয়ত জীবন ঘষে ঘষে অন্য কোনো ঘর।
অন্য ঘরে অন্য স্বরে
আঁকতে চাইনি আমার নিজস্ব নির্জনতা।
.
এতো এতো রোদ, তবু তোমার চিবুকে এক
বুক অন্ধকার।
তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার
১০
একহারা গড়নে লোকটি উচ্ছ্বাসী আলাপী
তুলোট কাগজে মোড়া বুনট স্মৃতি ও সম্পর্কের
কথামালা থরে থরে সাজিয়ে দেন
বর্তমানতার পরতে পরতে।
.
আমি ও আমরা মুগ্ধ শ্রোতা।
.
লোকটির গহীনে উচ্ছ্বাসী বক্তা লকলকিয়ে ওঠে।
চকচকে চোখ আর হাতের শৈল্পিক কারুকাজে
আসরের শ্রোতাদের সাথে সম্পর্কের
বুনট আঁকেন আগামী কোনো বর্তমানতার কথামালা।
তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার
১১
তাকানোর কায়দা দেখেই বুঝেছি
এমন প্রচ্ছদ
অদেখা ও অপাঠের যৌথ মিশেলে এক রন্ধন শিল্প।
.
খুড়লে হয়তো হাতভরা উচ্ছ্বাস উচ্ছলে পড়বে
তবু তার গহীনে থাকবে কালো কালো
পাথর কুচি আর প্রত্ন যন্ত্রণা
.
এমন প্রচ্ছদ দেয়ালে
ঝুলে থাকা ক্রুশবিদ্ধ জীবন।
…………………
পড়ুন
টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী : জ্যোতি পোদ্দার
36 thoughts on “তিলফুল”