ন্যাড়া মাথা এক মান্দার গাছের নিচে লোকটা নিজেকে সমর্পণ করে, ধরফরায়। দেহে তপ্তকুচি চিনচিন হুল কাটে। ভূমিতে ডালপালার ছায়াজালিকার ছাপ, শরীরেও ছায়ানকশা। মনের আহ্লাদ বাড়ে।
সিসাগলা গরমে এই যেন স্বর্গসুখ। চারদিকে গরমকুণ্ডের সুবিশাল প্রান্তর। মরীচিকার ফাঁদ, এদিক সেদিক।
ডাকপিয়ন পিঠে রাখা চটের ঝোলাটি অভ্যাশবশত আঁকড়ে আছে। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শরীর ফুঁড়ে ঘাম ঝরছে। ফোটা ফোটা শিশির গড়িয়ে পড়ছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই।
শরীরে বাতাসের আরাম পরশ। একটু কেঁপে ওঠে।
নিজের অবস্থান বিষয়ে সচেতন হয়ে বুঝতে পারে ছোট্ট এক বৃত্তে আটকে পড়েছে। বৃত্তভাঙা মানে নরকের স্পর্শজ্বালা।
তখন দূরের অশ্বত্থ নজরে আসে, যেন ঝাকড়া চুলের বিদ্রোহী কবি নজরুল। পাতার ঢেউ খেলা এখান থেকেও চোখে পড়ে। মরিচিকার ধাঁ ধাঁ বৃক্ষের মাথায় চিক চিক করছে।
কখনো মনে হয়, গলানো সিলভার পাতায় লেপ্টে আছে, গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
অশ্বত্থ বৃক্ষ তাকে টানে। পা চালাতে প্রস্তুতি নিয়েও থমকে দাঁড়ায়, ঘাড় ফিরিয়ে মান্দার গাছে দোয়েলের পুচ্ছ নাড়ানো দেখে, পাখিরা এ-ডাল ও-ডাল করছে।
আর একটি লাল টুকটুকে প্রজাপতি পাখিটির সাথে সাথে, একটু নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে, এখানে সেখানে যাচ্ছে।
দোয়েলের মাথায় একটা শুকনা পাতা ঝরে পড়ে। একটু হতভম্ব হয়ে, পাখিটি পাখা জাপটে অন্য ডালে চলে যায়।
ঘন ঘন পুচ্ছ নাড়ায়, মুখাবয়ব স্থির ও গম্ভীর।
ডাকপিয়ন হাঁটা পথ ধরে। ঘাসে মোড়া কাচা রাস্তার মধ্যখান দিয়ে চুলের সিঁথির মতো নগ্ন পায়ে চলা পথ, পথ ধরে সে হাঁটছে।
চারপাশ থেকে গরম জেঁকে ধরে, অবিরত ঘাম ঝরছে। হাতে মুছে নেয় একটু পর পর।
মাথা নিচু করে, পথের রেখা বরাবর চলছে। কখনো হঠাৎ আকাশে চোখ চলে যায়, যখন নামায় তখন দুনিয়া অন্ধকার।
কিছুক্ষণ পর চোখ ভিজে ভিজে ঝাপসা আলোর ঝকমারি পায়, আস্তে আস্তে সমস্ত দৃশ্য দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়।
বাতাসের তোড়ে কখনো ঝরাপাতা, খড় কিংবা কোনো অবশেষ পায়ে লুটোপুটি খায়, পা বেয়ে বেয়ে কিছু ওঠে আসে।
তখন তাকে খাড়া হয়ে থাকতে হয়। মাথার চুল হাওয়ায় ওড়ে।
ডাকপিয়ন ও অশ্বত্থ বৃক্ষ, ২
আকাশে একজোড়া পাখি ভাসছে। কখনো বৃত্তাকার, কখনো সরলপথে উড়ছে। কখনো নিচে নামছে, কখনো উঁচুতে।
আরো একজোড়া পাখি এল, অতঃপর আরো একজোড়া। এমনি করে অনেক।
আকাশে তখন পাখির মেলা। সেদিকে তাকিয়ে আছে ডাকপিয়ন, পিঠে ঝোলানো চটের থলের অস্তিত্ব অনুভব করে। থলেটা বুঝি একটু নড়ে উঠল! নাহ্।
নিজের মনের ভুলের জন্য লাজরাঙা হলো। প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে, রোদের তেজ সহে, পাখি দেখতে দেখতে অশ্বত্থ বৃক্ষ স্মরণে আসে।
সামনে তাকায়, দেখে, অশ্বত্থ বৃক্ষের পাতা বেশি রকম নড়ছে।
পাতা ঘষার শব্দ কানের কাছে ঝির ঝির করছে । কিছু পাতা পাক খেতে খেতে গড়িয়ে নিচে পড়ছে।
পাতাঝরা তাকে বয়ঃপ্রাপ্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। জীবন থেকে একে একে অনেক বছর ঝরে গেল।
জীবনবৃক্ষ এখন ন্যাড়া। অথচ তার পথ এখনো সেই শুরুর মতোই, দৌড়, শুধু দৌড়।
এই দৌড়ের লক্ষ্য কী, এর শেষ কোথায়, জানে না। শুধু জানে তাকে দৌড়াতে হবে।
থমকে যাওয়া মানে অনেক কিছু পিছুতে ফেলা। অথচ দেহকাঠামোয় যেন জং ধরেছে, কটমট করে দ্রোহ করে, শুয়ে-বসে থাকতে চায়।
অথচ মনের আনন্দ দৌড়ানিতে। মন শুধু ফাস্ট হতে চায়।
দেহ ও মনের এই রকমফের তাকে অসহায় করে দেয়। কখনো এসব দ্বৈততার টানাপোড়েনে জরিমাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বোধশূন্যতার অতলে ডুবতে থাকে।
তখন হয়তো আকাশে ওড়া কোনো পাখির দিগন্তে মিশে যাওয়া দেখতে দেখতে, সামনে এগোনোর প্রেরণাটা উস্কে ওঠে।
দেহ তখন কড়মড় করে অনীহা প্রকাশ করলেও, মনের জোরে নিস্তেজ।
বাতাসে সুবাস মৌ মৌ করছে। ধনচে ফুলের সুবাস। সাথে মিশেছে মাটির ভাপ-ওঠা গন্ধ।
জমিতে ধনচে গাছগুলো একে একে অন্যের গতরে হেলে পড়েছে, শরীর থেকে ঝরে পড়েছে বেশির ভাগ পাতা।
গায়ে-গতরে বয়সের ঝুল। কিছু কিছু ধনচেতে কিছু পাতা, কিছু ফুল, যেন জোর করে গজিয়ে উঠেছে, দেখতে করুণ ও অপ্রতিভ।
মৌমাছি, ফড়িং এলোমেলো ওড়ছে, কখনো বসছে। উড়ছে বসছে। জমিতে কয়েকটি শালিক মাটিতে সতর্ক চোখ ফেলে কী যেন খুঁজছে, হঠাৎ দৌড়াচ্ছে, আবার হাঁটছে।
ডাকপিয়ন ও অশ্বত্থ বৃক্ষ, ৩
ডাকপিয়ন হাঁটছে। আজকাল সব কিছু দ্বিধাময়। প্রতি পদে পদে প্রশ্নের তোড়া এসে ঝাক্কি মারে। মুখাবয়বের ভাঁজ বাড়িয়ে দেয়। বারবার পিছু টানে।
পেছনের কিছু শব্দ, কিছু ছবি চলার পথের রাশ টানে। তার অসহায়ত্ব বাড়িয়ে দেয়।
তখন চোখের ঝাপসা পর্দায় চলচ্চিত্র প্রস্ফুটিত হয়: ভাঙাচোড়া ঘর, ছেঁড়া কাপড়ে প্রৌঢ়া, বয়স্কা অনুঢ়া যুবতী, দুই যুবকের হাড় জিরজিরে দেহকাঠামো, এক প্রৌঢ়ের বিড়ি টানা, চটের আকাশ।
ডাকপিয়ন চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে নিদাগ দুপুরের তেজোময় রোদের ঝলসানি থেকে আরামদায়ক ছায়ায় প্রবেশ করে।
মাথার উপর বিশাল ছায়া। ঝিরঝিরে গান। পাখির কলতান। ঝরাপাতার গড়িয়ে গড়িয়ে চলা। হাঁটা পথে মচ মচ শব্দ।
অশ্বত্থের অনেক ঝুল উবু হয়ে পড়েছে, মাটিতে আটকে রেখেছে বৃক্ষ, যেন মহাকাশের কোনো মহাশক্তিধর টেনে নিয়ে যেতে না পারে।
বৃক্ষের এত টানা মাটিতে পুঁতে আছে যে, ডাকপিয়ন বেশি দূর এগোতে পারে না। মোটা এক ঝুলে দেহ এলিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রাখে। যখন খোলে, মনে হয় স্বর্গের এক টুকরা জমি। চোখ আরো প্রসারিত করে, দেখে, অশ্বত্থ ঘিরে এক বৃত্ত তৈরি করা। এর সীমানা ছাড়িয়ে আগুনের দাউ দাউ।
নিজেকে পৃথিবীর একমাত্র একজন মনে হয়। তখনই নৈঃসঙ্গ অনুভব করে। খারাপ লাগে না। চারদিকে পাতা পোড়া গন্ধ।
পাতায় পাতায় পাখির খচখচানি, জানা-অজানা সুরের টান। ঝিঁ ঝিঁ শব্দ।
এরই মধ্যে দূরের কোনো ঢোলক শব্দ, যেন, দূর কালের সময় পেরিয়ে আজকের জগতে ঢং ঢং করছে।
যেন দূরকালের কেউ সংকেত পাঠাচ্ছে। কখনো ডম ডম বিতিকিচ্ছিরি শব্দ, বুক কাঁপিয়ে দেয়। ব্যাঙ-ছাতা নড়ে উঠছে। ঝরাপাতারা বেশি রকম তোলপাড় করে।
অশ্বত্থের পাতার ফাঁকে ফাঁকে কখনো ঝিলিক খেলে। আর হো হো করে বিকট শব্দ, একটু পর পর আতংক ছড়ায়।
বৃক্ষটিও হেলেদুলে ওঠে। এসব পরিবর্তন তাকে ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত করে। চোখে ঘুম আসে।
মাথাটা হেলে পড়ে। মোটাসোটা এক ঝুলে হেলান দেয়। তার ঘুম আসে।
কাঁধের ঝোলাটা একপাশে ছিটকে পড়ে পেঁচিয়ে রাখা ওপরের অংশ উল্টা ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ প্যাচ ভাঙতে থাকে।
ডাকপিয়ন ও অশ্বত্থ বৃক্ষ, ৪
পড়ে থাকা ঝোলাটা নড়ে ওঠে। কিছু শব্দ, বিচিত্র রকম। অতঃপর ঝোলার মুখ খুলে যায়। সাদা মানুষ, সবুজ মানুষ, কালো মানুষ, হলুদ মানুষ, নীল মানুষ—এমনি নানা রঙিলা মানুষ।
হেলেদুলে তারা ব্যাঙ-ছাতার পাশে গোল হয়ে বসে। একে অন্যকে অবাক হয়ে দেখে।
সাদা দেখে কালোকে, সবুজ দেখে ধূসরকে, হলুদ দেখে নীলকে, লাল দেখে সবাইকে। সবাই যার যার জায়গায় স্থির। কথা বলছে না। মুখাবয়ব দেখে তাদের প্রকৃতি বোঝা সম্ভব।
এক একজনের চোখে এক রকম অভিব্যক্তি। এতে প্রেম, দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা, মমতা, সহায়তা, নানাভাবে প্রকাশমান।
সাদা তিন-আঙুলে মানুষ, বুকে হাত দুটো ভাঁজ করে, মুখে ভাবগাম্ভীর্য তুলে, ধীর লয়ে সুরেলা গান গায়, গানটি অনেকটা স্ত্রোস্ত পাঠের মতো, পবিত্র গুনগুন ছড়িয়ে পড়ে।
কোত্থেকে এক সাদা পায়রা এসে মজমায় আনন্দনৃত্য করে। সেই নৃত্য সবুজ মানুষের দেহে তরঙ্গ তোলে, আস্তে আস্তে সে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায়।
তখনই নীলের চিৎকারে আনন্দ ও বিষাদ ঝন ঝন করে। সবাইকে দ্বিধায় ফেলে, কেউই নীলের প্রকৃত স্বভাব আবিষ্কার করতে পারে না।
দ্বিধায় ভাঁজ কাটার আগেই কালো মানুষ থাবা মেলে ধরে, তার নখর বাড়তে থাকে। ধারালো নখর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে সবাইকে দেখায়, মুখে ক্রূর হাসির ইশারা।
ডাকপিয়ন ও অশ্বত্থ বৃক্ষ, ৫
অতঃপর সে উঠে দাঁড়ায়, বৃত্তের চারিদিকে ঢেং ঢেং করে তা-বনৃত্য করে, শীঘ্রই তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। সবাই ভয়ে ও শংকায় নীল হয়, কাঁপতে থাকে।
সাদা মানুষ তখনো স্থির, সাবলীল। মুখে স্মিত হাসি। আকাশের দিকে তাকায়, উঁকি-ঝুঁকি করে চোখ বড় করে।
যা খোঁজে তা দেখে না, চোখের পাতা দ্রুত উঠানামা করে। একটু শংকা যেন আছর করে, দৃষ্টি চলে যায় দূর থেকে আরো দূরে।
অতঃপর অশ্বত্থের মগডালে চোখ থিতু হয়। দেখে সাদা পায়রা নিরীহ অসহায় ভাব নিয়ে বসে আছে।
সবুজ পাতা ছায়া দিয়ে, বাতাস দিয়ে আগলে রেখেছে। তখনই আবার মরণ-চিৎকার।
সবাই ধাতস্ত হয়ে দেখতে পায়, কালো মানুষটি ছিঁড়ে ফেলেছে নিজের দেহের মাংস, রক্ত পড়ছে গল গল করে। কালো মানুষটি আরো কালো হয়। অথচ তার রক্ত গাঢ় লাল।
লোকটি মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি যায়, এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাস বাতাস ভারি করে।
সবাই নড়েচড়ে বসে। তিন-আঙুলে হলুদ মানুষ হাতে শর্ষেফুল নিয়ে সবাইকে অভিবাদন জানায়।
তারপর দু হাত প্রসারিত করে, চক্রাকারে ঘুরতে থাকে, আশপাশ হলুদ হতে থাকে। সবার চোখ ধাঁ ধাঁ করে।
সবার রঙ হলুদ হয়ে যায়। বাতাস হলুদ হয়। ধীরে ধীরে তারা উপরে উঠতে থাকে।
শূন্যতায় ভাসতে থাকে। পা উপরে মাথা নিচে এমনি করে তারা ভাসে। হঠাৎ সবাই নিচে আছড়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ জ্ঞানহীন, তারপর আস্তে আস্তে বোধ ফিরে আসে। ঝাপসা চোখে তখনো আবছা পরিপার্শ্ব।
আড়মোড় ভেঙে ধাতস্ত হবার চেষ্টা করছে। তখনই হো হো অট্টহাসি। লাল তিন-আঙুলে মানুষ লম্ফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, হাতে ধরা লাল পতাকা পত পত করছে, বাতাসে তখন রণদামামা।
সবাই আস্তে আস্তে ওঠে দাঁড়ায়। অবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। লাল মানুষকে কেন্দ্র রেখে নতুন বৃত্ত হয়।
লাল মানুষ হাত নেড়েচেড়ে, আবেগে আপ্লুত হয়ে, জ্বালাময়ী কিছু বলে, সবাই তখন হাততালি দেয়। কখনো বাহবা জানায়।
বৃত্তটা হাতে রেখে, অবিচ্ছেদ্য হয়। বাতাসে নানা রঙ ছড়িয়ে পড়ে। রঙের ক্রীড়া নানা অবয়ব ধারণ করে।
ডাকপিয়ন ও অশ্বত্থ বৃক্ষ, ৬
কখনো ধাবমান ঘোড়া, কখনো রঙধনু, কখনো মেঘ। সেই সাথে বিবিধ শব্দ। হাসি, কান্না, যন্ত্রণা, চিৎকার, শীৎকার। শব্দগুলো ভয়াবহ হয়, কানে ধারালো ধাক্কা মারে।
নিজেরাও আরো ঘনসংলগ্ন হয়। আচমকা সভায় হট্টগোল লাগে এবং সবাই স্থির ও চুপসে যায়।
চুপি চুপি তারা ডাকপিয়নের ঝোলায় প্রবেশ করে। ঝোলা ফুলেফেঁপে উঠে।
ডাকপিয়নের ঘুম ভাঙছে। ঘুমচোখে এপাশ-ওপাশ করে। তারপর ডাকপিয়ন আস্তে আস্তে উঠে, হাঁটু ভেঙে বসে। চোখ খোলে ধীরে ধীরে।
চোখ তখনো অন্ধকারময়। চোখে জলজ আবরণ লেগে আছে। পানির ঝাপটা দ্রুত কেটে যায়, ফকফকা আকাশ সামনে।
আকাশ স্থির, জমাটবাঁধা। সূর্য হেলে পড়ছে। তেজ কমেছে। তবু মাটি ফেটে ভাপ বেরুচ্ছে। অশ্বত্থের তলায় পাতারা স্থির।
ব্যাঙছাতা গুড়িয়ে তছনছ, শুকনো পাতারা কুচি কুচি, মাটিতে চটলা ওঠা—এইসব অবলোকন করে সে বিস্মিত হয়।
অতপর আরো পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হয়। দেখে শূন্যতায় নানা রঙের খেলা। মেঘের মতো ভাঙছে, গড়ছে।
বিস্ময়ের ঘোর ভাঙার আগেই, বিবিধ শব্দরা একসাথে তোলপাড় তোলে, বৃক্ষের পাতারা নড়ে ওঠে। সে ওঠে দাঁড়ায়।
দলানো-মোচড়ানো ব্যাঙ-ছাতারা পাশে, লতাগুল্মের ভাঙচুর চোখে পড়ে। এখানে সেখানে ছোপ ছোপ লাল। চটের ঝোলার পাশে এসে থমকে দাঁড়ায়।
মুখটি আলগা। ত্বরায় ঝোলাটির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ধরে, ভেতরে দেখে, এবং আশ্বস্ত হয়। ঝোলার মুখটি কয়েক পাঁক মুচরিয়ে নেয়। আশেপাশে ঘুরে ঘুরে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে।
তারপর ঝোলাটি পিঠে ফেলে যাত্রাপথ ধরে। ক্ষেতের আল ধরে যেতে যেতে অনুভব করে, সূর্যের তেজ কমে আসছে। ধনচে ফুলের গন্ধ নাকে লাগে।
আকাশে একটি চিল, কী যেন হারিয়ে খুঁজছে। চিলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘূর্ণি খায়। সূর্য টলোমলো করছে।
ডাকপিয়ন এগুতে থাকে। মনে আনন্দ হয়। ফিসফিস গান গায়। বাতাসও শা শা তাল মেলায়।
পিঠের ঝোলাটি ক্রমশ হালকা হয়ে আসে। যদিও সেদিকে তার মনোযোগ নেই।
ঝুলন্ত ঝোলা থেকে তখন টুপটুপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, সে সাথে নানা রঙের ধুম্র—লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কালো।
ডাকপিয়ন ও অশ্বত্থ বৃক্ষ, ৭
চিকচিক করে একটা সাদা পাখি আকাশে ওড়ে যায়। পাখির ঝাপটানি থেকে রঙ ছড়িয়ে পড়ছে।
ডাকপিয়ন হাঁটছে, আর দূর দিগন্তে যেখানে আকাশ নেমেছে, সেদিকে সটান তাকিয়ে তাকিয়ে। আরো প্রতি পদে পদে পেছনে ছড়িয়ে দিচ্ছে রঙের রেখা।
তার পিঠ থেকে রঙধনুর গুটানো ভাঁজ খুলছে, এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত বাঁধতে যেন তার প্রস্তুতি।
রঙের ঘষার সাথে সাথে সঙ্গে শব্দের লহরী উঠে। তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।
ডাকপিয়ন তখন থমকে দাঁড়ায়, পেছনে তখন বিকট মট মট শব্দের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।
ডাকপিয়ন আচানক এক লম্ফ দিয়ে স্থির। ঘাড় ফিরিয়ে আশেপাশে দৃষ্টি বুলায়, দেখে অশ্বত্থ বৃক্ষটি নেই।
মনে ইতঃস্তত প্রশ্ন জাগে, গাছটি নেই নাকি সে চলে এসেছে বহু দূর । প্রশ্নের কোনো মীমাংসা হয় না। চোখে পড়ে, একটি ছায়া আকাশে ওড়ে যাচ্ছে।
আর অনেক পাখি ছায়া থেকে কায়া প্রাপ্ত হয়ে নীল আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ছায়াটি এক সময় অদৃশ্য হয়ে যায়, আর পাখিগুলি দিগন্তে।
ডাকপিয়ন পুনরায় পা চালাতেই, দেখে সামনে লোকারণ্য, মানুষেরা তাকে ঘিরে ধরে। সবাই মুষ্ঠিখোলা হাত বাড়িয়ে দেয়।
বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে, সে ঝোলাটি সামনে নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে।
তারপর সবার হাতে একটি একটি করে চিঠি তুলে দেয়। চিঠি পেয়ে কেউ হেসে ওঠে, কেউ কেঁদে ফেলে। কেউ মূক্ হয়, কেউ মাটিতে গড়িয়ে পড়ে…
বিবিধ মুখর শব্দাবলি পেছনে ফেলে ডাকপিয়ন আবার পথে নামে। মাইলের পর মাইল, মাঠের পর মাঠ। চলার শেষ নেই।
সূর্য উঠে, সূর্য ডোবে। রাত হয়, দিন হয়। তার পথ শেষ হয় না। চুল তার ধীরে ধীরে কালো থেকে সাদা হয়। প্রতিদিনই কিছু চুল খসে পড়ে।
কখনো থমকে দাঁড়িয়ে, অশ্বত্থ বৃক্ষটি খোঁজে। কখনো পায়, কখনো পায় না। ঝাপসা চোখে আকাশ দেখে, আকাশে চিঠিরা লুটোপুটি খায়।
ঝম ঝম বৃষ্টি তাকে ভিজিয়ে দেয়। সূর্যের তেজ তাকে পুড়িয়ে দেয়।
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা
সুনীল শর্মাচার্যের দশটি কবিতা
নাসিমা খাতুনের কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের কবিতা