দশটি কবিতা
চন্দ্রশিলা ছন্দা
চন্দ্রশিলা ছন্দার দশটি কবিতা
জলপিপি
আমার কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য
ব্যাংক ব্যালেন্স নেই।
বাবা মা গত হয়েছেন ছোটবেলাতেই
তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজন আছে বলে
জানা নেই, নেই জায়গা জমি ঘর বাড়ি
থাকার কোনো আশ্রয়
এক কথায় কোনো সম্পদই নেই আমার
সম্পদ যার যত কম, তার হিসেব নাকি…!
সন্তান-সন্ততি ছিল, তারা মেরুদণ্ডহীন
ইহকালে টিকে থাকতে আমার করণীয়গুলো কি?
সেইসব বুঝে ওঠার আগেই
আমার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে
পরকালের হিসেব-নিকেশ
পাহাড়বাসীদের কারো কারো ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটেছে,
গাছতলায় সিদ্ধি লাভ
গুহাবাসে নবীরা হয়েছেন ওহী প্রাপ্ত
আমি জাগতিক যন্ত্রণা থেকে পালিয়ে বাঁচতে
অক্ষর আর পৃষ্ঠার ভাঁজে ভাঁজে ডুবেছি
দিনের পর দিন… মাস বছর
হয়েছি কবিতা প্রাপ্ত
অথচ কবি না-হয়ে হলাম জলপিপি
বুকজুড়ে শুধু তৃষ্ণা
তৃষ্ণা সবটুকু জীবনজুড়ে।
চন্দ্রশিলা ছন্দার দশটি কবিতা
দেখি কেমন সাধক বাউল
আজকে থেকেই বদলে নেবো কথার ধরন
আজকে থেকেই হোক না শুরু নতুন মরন!
.
আজকে থেকেই প্রেম করবো তুই তোকারি
প্রেম করবো প্রেমের মতো মানবো না তোর খবরদারি।
দু’হাত দিয়ে করবি যখন কেবল এলোমেলো
জংলী হবো বন্য হবো, হবো মাটি-ধুলো।
.
চোখের বানে খুবলে নেবো বাসবি যখন ভালো
আমার চোখে দেখবি তখন এক পৃথিবী আলো।
.
খুব ডুবেছিস শীতল জলে দুবেনী আর চুলের ফিতায়
বাঁচলে এবার আয় না মরি সউত্তরের একই চিতায়।
প্রেম মানে কি শুধুই শরীর? মৌমাছি আর মধু ফুলের?
দিলাম সঁপে তোর বাহুতে সুবাস নিতে এলোচুলের।
দেখি কেমন সাধক বাউল একতারাতে মন বাজাবি?
দখলদারি বাড়াবাড়ি মানবো না তো,
ফুল সাজাবি?
দেখি কেমন নাচাস আমায় পুতুল? নাকি পেখমধরা?
হিসেব-নিকেশ বাদ দিয়ে চল এবার বাঁচি প্রেমের মরা!
চন্দ্রশিলা ছন্দার দশটি কবিতা
আমার শহর
আমার শহর পুরো পৃথিবী
প্যারিস ব্যাবিলন
আমার শহর স্বপ্নে ভরা
গহীন-আমাজন।
.
বাংলা আমার মাতৃভূমি
পৃথিবীর অংশ
পিতামহ আর প্রপিতামহী
তাঁরা কার বংশ!
.
আর্য খ্রিস্ট আদি পিতা-মাতা
একই তো পরিবার
মানুষ ভেদে স্বদেশ-বিদেশ,
ভাগাভাগি কারবার।
.
আমার শহর সবুজ পাহাড়,
নদ-নদী ফিসফাস
সরিষা ক্ষেতে হলুদ ঝুটির
বিমুগ্ধ চারপাশ।
.
আমার শহরে সোনা মসজিদ
শাহ্ মখদুম পীর
শত যোদ্ধার সাথেই ঘুমায়
শহীদ জাহাঙ্গীর।
.
হোক না জন্ম ছোট্ট নগরে
গ্রাম কী-বা কোনো গঞ্জে
পৃথিবীজুড়ে ছুটবই আমি,
ছুটবে আমার মন যে।
.
মুগ্ধ দু’চোখ যতদূর দ্যাখে
উড়ে পাখি পাখি মন
আমার শহর এশিয়া ভারত,
আরো সুন্দরবন।
.
সজল আকাশ শহর আমার
ফসলের মাঠ বই
ভাবনা যদি না-হয় এমন
তবে আমি কবি নই।
.
যদি না দেখি বন্ধ চোখে
আঁধারের ফুল জল
কেমন করে লিখবো কবিতা,
কবি কেন হবো বল?
.
পুরো পৃথিবী বাঁধা যদি যায়
স্নায়ুতন্ত্রের দৈর্ঘ্যে
আমি পুরোহিত, আমিই দেবতা,
পৃথিবী প্রাপ্তি অর্ঘ্যে।
.
জীবন পাড়ের অভয়ারণ্যে
দাঁড়িয়ে দেখা ক্ষণ
আমার শরীর আমার শহর
যতদূর ভাবে মন।
চন্দ্রশিলা ছন্দার দশটি কবিতা
একদিন ঘনবরষায়
একদিন ঘনবরষায় তুমি নিজের বারান্দায় এসে চিৎকার করে ডেকে বলেছিলে, রোদ্দুর…
এসো না, আমরা হাত ধরে বৃষ্টির সাথে খেলি
.
—কেউ দেখবে না?
—দেখলে হবে লুকোচুরি।
.
আচ্ছা রোদ্দুর, তুমি আমার বিকেল হবে?
—আমার ঘরে ফেরা পাখি?
—আমি পাখি হলে তুমি আমার রাধাচূড়া… বাতাসের দোলা।
—না, আমি বাতাসের দোলা হতে চাই না।
বাতাস ভেসে যায়, ছেড়ে যায় সব!
—তবে তুমি ঝিরিঝিরি পাতা?
—না, তাও না। পাতাও তো ঝরে যায়।
—উমম্, তাহলে তুমি আমার কাটুম-কুটুম।
—তুমি তবে বাক-বাকুম
—হা হা হা, তুমি আমার ইন্টিমিন্টি।
—তুমি তাহলে কিন্টাকুন্টো
—তুমি ঘন দুধে চিকন শেমাই, মিষ্টি।
—তুমি নিশ্বাস, পরম স্বস্তি।
—তুমি মন।
—তুমি অনুরণন।
—তুমি কাছে আসা।
—তুমি তবে প্রেম।
.
—রোদ্দুর, তুমি নির্যাস, পুরু ঠোঁট।
—ঝিলিক, তুমি তবে আয়েশি সিগারেট।
.
এর পর পরই ছিটকে গেলে তুমি!
আর কখনো কোনোদিন বারান্দায় এলে না;
কত উথাল-পাথাল বৃষ্টি হলো—
কত চোখের জল…!
কী ভুল ছিল? তাও বলোনি কোনোদিন।
.
মনে মনে আমি ধরে নিয়েছি
হয়তো তুমি আবেগঘন চেয়েছিলে আনমনে
আমার উষ্ণ পুরু ঠোঁট চায়ের মতো
চুমুক দেবে;
তোমার কাটুস ঠোঁটে?
.
আমার তখন উঠতি যুবক বয়স।
আমার তখন অদম্য তৃষ্ণা; দুরু দুরু বুক।
আমার তখন ক্ষণে জ্বলে ওঠা
সিগারেটই ছিল মানানসই শ্রেষ্ঠ উপমা!
.
সেদিন তুমি অবুঝের মতো
এক ঝটকায় হাত টেনে নিতেই
হাতের চুড়িটা খুলে এলো আমার হাতে।
.
তোলপাড় করা বৃষ্টি রাতে আজও
তোমার কাম-ঘাম লেগে থাকা কাঁচের চুড়িটা
আমার বুকের ওমে রাখি
ঠোঁটে ছোঁয়াই…
ইন্টিমিন্টি কিন্টাকুন্টো খেলি
একা একাই।
চন্দ্রশিলা ছন্দার দশটি কবিতা
স্থবিরতা
স্রোতস্বিনী সেই নদীটি
কেন এখন মরণ ঘেঁষা
পাড় ভাঙে না ঢেউ তোলে না
হারায় না পথ খরস্রোতা
.
কার জীবনে জ্বালতে আলো
জোনাক হলো অন্ধকারে
ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে
তুষের আগুন বারে বারে
.
জীবন এখন ভীষণ বোঝা
ঘরের কোণে শ্রাবণ দিন
নোনা জলে পুড়ছে আজও
তৃষ্ণা শরীর বিরামহীন।
.
মানুষ বলে, একটা জীবন
প্রতিক্ষণে ফোটাও ফুল
ফুলও যে হয় প্রাণঘাতী আর
সরল ফুলে গরল ভুল!
.
একটা জীবন ধূসর ফাগুন
মৃত সাগর অভিশাপ
একটা জীবন সুবাস দিতো
আলো দিতো এখন পাপ।
চন্দ্রশিলা ছন্দার দশটি কবিতা
বিক্ষোভ অভিশাপ
প্রতিদিন চোখ খুলে নবজন্মের রসাস্বাদন করি।
পাখির ঠোঁটে দেখি ছিনিয়ে আনা
এক টুকরো সূর্যালোক
মৌমাছির খুনসুটিতে পাপড়ি মেলা
ভোর দেখি মুগ্ধ চোখে!
দিন শেষে ঢলে যায় মৃত্যুর কোলে।
স্বঘোষিত আধিপত্যবাদের মস্তক হয়ে ওঠা
কতিপয় বুলডগের মুঠোয় পৃথিবীর ট্রাম্প কার্ড।
থকথকে মরণ আসুক আজ তাদের ফুসফুসে!
দু’হাত ভরে যাক তাদের কিলবিল ভাইরাস!
যারা ভেঙেছিল প্রজাপতির ডানা
ঘরের ছাদে, পাবলিক বাসে
পায়ে পিষেছিল উঠোনের কচি সবুজ ঘাস
লাগামহীন পাপে ডুবে এনেছিলে অভিশাপ
সেইসব ভয়ানক দানবের সাথে অসম্ভব প্রায়
সুন্দরের বসবাস!
যে হাতে পুড়িয়েছিলে পৃথিবীর ফুসফুস
নির্বাক আমাজন
ভেঙেছিলে মানুষের ঘর পাখির বাসার মতো
উজাড় করেছিলে সংখ্যালঘু
ঠোঁটের কষায় কাঁচা দুধের ঘ্রাণে আহ্লাদিত
শত শত ফুল যেভাবে হত্যা করেছিল
যে হাতে খুন করেছিল সেজদায় পড়ে থাকা
অগণিত মুসলিম!
খেলেছিলে পরমাণু নিয়ে ভয়ানক খেলা
এখন তোমাদের প্রায়সচিত্তের পালা
অতএব বাশার আল আসাদ কাঁদো
দু’হাত মুখে চাপা দিয়ে কাঁদো!
আকাশের রঙ বদলে ফেলা বিকৃত শকুনি
নত কর তোর চোখ, ঢেকে ফেল দু’হাতে
অঝরে কেঁদে ভাসা নাফের নীল জল!
.
নিজেদের পাপের দুর্গন্ধে ডুবতে ডুবতে
নাক মুখ চেপে ধরে কাঁদ শয়তানের দোসর
ক্ষমা চেয়ে নে অসহায় বাদুড়ের কাছে
লজ্জিত হ আক্রমণাত্বক অক্টোপাস এবং
সাপ ব্যাঙ কুমিরের কাছে
.
আর যত আছে শুয়োরের পালে বাটপার চোর,
তোদের কপালেও যেন আর না আসে একটিও ভোর!
বিশ্বস্ত দু’হাতে চেপে ধর সমগোত্রীয়র গলা!
যত আছে রাঘব বোয়াল প্রতিবন্ধী সিন্ডিকেট
আছে কথা কপচানো সুশীলের ছদ্মবেশে
সুবিধাভোগী সর্বগ্রাসী
এখন আলিঙ্গন কর একে-অপরকে!
.
দিনের পৃষ্ঠায় থমথমে ভৌতিক অন্ধকার
জনমানুষ শূন্য হাট-বাজার, ট্রেনের কামরা,
স্টেশন, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনাল
সমস্ত বায়ুমণ্ডল পুড়ছে চাপা দীর্ঘশ্বাসে
লজ্জায় মিইয়ে গেছে চৈত্রের চাঁদ।
লক্ষাধিক প্রাণের বিনিময়ে কি শোধ হবে
মানুষের সহস্র বছরের অপরাধ!
তোদের দু’হাত আজ তোদেরই বিচার করুক!
হাত দুটি হয়েছে তাই দুটো তাজা বোমা!
বেছে বেছে ধ্বংস হোক জ্ঞান পাপী গণ্ডমূর্খের দল
প্রকৃতি যেন তোদের না-করে ক্ষমা।
.
নটিনী নটবর
ঘুম পাড়ানো শৈশবে ফিরি বারবার
প্রকৃতির কোলে আমি নটিনী নটবর
.
উড়ো আঁচল জলে ডোবা পা
আসন্ন বর্ষার সবুজাভ ন্যাড়া কদমের উঁকিঝুঁকি
বুনোঘ্রাণ আমায় ভাসিয়ে নেয়
সাদাকালো ছন্দময় স্মৃতিতে
তখনই জীবন ছিল জীবনের মতো
স্পন্দন ছিল বন্ধন ছিল
বিকেলের সাথে সাঁঝের
.
শৈশব মেখে নিয়ে শিশু মন জেগে ওঠে
আরো একবার
আরো একবার আমি প্রাণ খুলে হাসি
জল ছুঁয়ে পানকৌড়ি পানা ফুলে নাচি
.
ছেঁড়া ছেঁড়া উড়ো মন মেঘেদের পালে
আমিও ছিলাম বুঝি কোনো এক কালে
তবুও তো আলোকের অগোচরে
ফিসফাস ঝরে যায় হিজলের ফুল
.
আমিও ঝরে গেলে হিজলের মতো
অনাদরে পড়ে রবে, নাকছাবি দুল!
.
বিশুদ্ধ অপরাধ
কলমের ধৃষ্টতায় স্তম্ভিত আমি
বাঁধ ভাঙা সত্যের জোয়ারে যখন
সোচ্চার হয় সে;
শুনেছি আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন
নীল চাষি
রক্তে তাদের নেশার দাসবৃত্তি।
.
চারপাশে পিচ্ছিল মাঠঘাট
সচেতন প্রতিটি ধাপ।
তবু পিছলে পড়ি, তবু করি পাপ!
এ পাপ আমার নয়,
তিন আঙুলের ফাঁকে আলতো ধরে রাখা
কলমের অপরাধ!
.
কলম যদি হয় অদ্বিতীয় অপ্রতিরোধ্য;
আমার মাথা তখন উঠে যায় কয়েক হাত উঁচুতে।
চিৎকার করে বলি, শোনো হে প্রতিবন্ধী মানুষ
দাসজীবনের চাইতে উত্তম
বিশুদ্ধ এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ অপরাধ।
.
যখন নিভে যাবে আলো
মানুষ এমন এক সময়ের কিনারে দাঁড়াবে
যেখানে পবিত্রতা কিংবা পবিত্র সম্পর্ক বলে
থাকবে না কিছুই
থাকবে না প্রেম, ভালোবাসা, সহমর্মিতা
কামতাড়িত মানুষের রসহীন সঙ্গম হবে
যন্ত্র মানবের সাথে
উৎপাদন হুমকির মুখে এলে
মাছেরা কামাশ্রয় চাইবে মা মাছের কাছে
তখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে
বুড়ো পৃথিবী বিষ্ময়ভরা পলকহীন চোখে দেখবে আদিমতা আর অসভ্যতার ঘৃণিত তফাৎ
পাখিরা গান থামিয়ে বলবে,
আমাদের অরণ্যে দূষিত হতে দেবো না
কোনো মানবের স্থান নেই এই সবুজে, দূর হও, যাও!
শহরের আকাশ ঘৃণায় কুঁচকে নেবে তার বুক
আর নিয়ন আলো বলবে
এখানে এসো না উৎসের কাছে যাও
ততক্ষণে সকল দরজা জানালার আলো নিভে
পাকাপাকি বন্ধ হবে উৎসের দফতর।
.
আমার আমি
তপ্ত রৌদ্রে পুড়ছো একা
নরক আগুনে জ্বলো
কাউকে কিছু বলো না তো
একাই চলছো, চলো।
.
কে-বা তোমার আপন ছিল
কেই-বা বন্ধু ভাই!
তোমার চেয়ে প্রিয় আপন আর
তো কেহই নাই।
.
আগলে নেবে, ছায়া দেবে সব ধারণা ভুল
কান্না এলে দু’চোখ মোছে তোমারই আঙুল।
1 thought on “চন্দ্রশিলা ছন্দার দশটি কবিতা”