shubhobangladesh

সত্য-সুন্দর সুখ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবসময়…

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২০তম পর্ব

Little Magazine
Little Magazine

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২০তম পর্ব

জ্যোতি পোদ্দার

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা – ২০তম পর্ব

আঠারো

‘চারদিকে ছিন্নমূল মানুষের আর্তনাদ। অত্যাচার, নিপীড়ন, বঞ্চনায় অতীষ্ট সমাজের মানুষ দিশেহারা, বিভ্রান্ত। সীমাহীন দরিদ্র ও দুর্নীতির পক্ষাঘাতে সমাজ জর্জরিত। প্রতি পদে পদে মানবিক মূল্যবোধ হচ্ছে উপেক্ষিত—তাই সমাজের ভুখা মানুষের সুন্দর জীবনের কামনায় আমাদের সন্মিলিত এ ‘ক্ষোভ’।’

এটি ছিল সমস্বর সাহিত্য গোষ্ঠীর মুখপাত্র ‘ক্ষোভ’ (১৯৮১)-এর সূচনা সংখ্যার সম্পাদকীয়। সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। অনিয়মিত এই সাহিত্য সাময়িকী ইউনুস প্রেস থেকে মুদ্রণ। বিনিময় মূল্য দুই টাকা।

.

‘কেন মনে হয়? কিছু নেই কিছু নেই কিছু নেই

কেন মনে হয় জীবন সন্ধার আর কতটুকু বাকী? ’

(কিছু ব্যথা : স্বপ্ন সেন)

‘আমার চোখের উপর ঠ্যাং রেখে

পড়ে আছে ভালোবাসার মৃতদেহ।

জীবনটাকে তাই ব্যাকরণের মতো মনে হয়;

জীবনের স্টেশানে টিকিট কেটে বসে আছি—

স্টেশনের ঘণ্টা

সিগন্যাল

রাত্রি

এমন কি স্টেশন মাস্টারও বলেছিল

ট্রেন আসছে।’

.

এই ‘জীবন স্টেশনে ভালোবাসার মৃতদেহ’ কবিতাটি লিখেছেন সাদিকুর রহমান মিরন। এ ছাড়া গল্প লিখেছেন তপন চক্রবর্তীসহ বেশ কয়েকজন তরুণ। কিন্তু ক্ষোভের আগুন বেশিদিন টেকসই হয়নি। সাইফুল ইসলাম ও তাঁর পারিষদ আর এক থাকতে পারেননি। সাইফুল পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ঠাঁই হয় ড. কামাল হোসেনের গণফোরামে।

.

উনিশ

১৯৮৭ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদ ঢাকায় গঠিত হবার পরের বছরেই শেরপুর জেলাশাখা গঠিত হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’ শ্লোগানকে সামনে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সারা বাংলাদেশে তাঁর প্রভাব পড়ে। কবিরা নেমে আসে রাজপথে।

শেরপুরের তরুণ কবিরাও এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সম্পাদক ও কবি বৃতেন্দ মালাকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল’ (১৯৮৮/মার্চ) স্মরণিকায় প্রচ্ছদ করেছেন কবি রণজিত নিয়োগী।

.

অ.

‘অস্থির পাখিরা কি

সূর্য্যের গান শোনে?

উচ্ছল হাসিতে কি

ঝর্না বাজায় ভায়োলিন?

পাহাড়ের গুহা থেকে প্রতিধ্বনির আশায়?

(এ কোনো সময় এখন : রিয়াজুল হাসান)

.

রিয়াজুল হাসান আটের দশকে কবিতায় মেতে উঠলেও, পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়ে পড়েন ক্ষমতায়। রিয়াজুল হাসান পঠন-পাঠনে প্রাগ্রসর। সমকালীন বৈশ্বিক চিন্তা সূত্র সম্পর্কে সবসময়ই এগিয়ে।

একবার আমার বাসায় আয়োজিত সাহিত্য আড্ডায় মেতে ছিলেন তিনি। সেদিন সান্ধ্য আড্ডায় বক্তা তিনি একাই বলে গেছেন সমকালীন বিশ্ব রাজনীতির তত্ত্ব ও তার প্রায়োগিক নানা খুঁটিনাটি বিষয়-আশায়। টাউন শেরপুরে একাধিক কাগজে কবি রিয়াজের লেখা প্রকাশিত হলেও, ‘মানুষ থেকে মানুষে’ পত্রিকায় তিনি তুলে ধরেছেন আটক দশকের কথকতা।

.

‘আম্মু তুমি

আর ভেবো না

ছেলে তোমার সোনা,

ঠিক ফিরে ও

আসবে আবার

মিছেই খোঁজ না

ভাইয়া আমার

লেনিন পড়ে

দোষটা কিসে বলো?

মিছিল নিয়ে

ওই আসছে

দেখতে যাবে চলো।

(মিছেই খোঁজ না : রিয়াজুল হাসান)

.

কিংবা—

.

‘আমি বেঁচে থাকি

কিন্তু আমি একা কখনো বাঁচি না

বিশাল প্রান্তরে অসম্ভব সবুজ ঘাস

আর আকাশের অনন্ত নীলকে নিয়ে

আমি বেঁচে থাকি

কিন্তু আমি একা কখনো বাঁচি না

সারি সারি উদ্যত কাস্তে

আর চকচকে লাঙলের ফলাকে নিয়ে

আমি বেঁচে থাকি

কিন্তু আমি একা কখনো বাঁচি না

(আমি বেঁচে থাকি : রিয়াজুল হাসান)

.

গত শতকের ছয়-সাত-আটের দশকটিই এমন উচ্চকিত। আর্দশ তাড়িত। রাগী যুবকের রগফোলা চিৎকার সমগ্র। শুধু শেরপুর না—সমগ্র বাংলাদেশে একই টিউনে বাঁধা। তারের যেখানেই হাত দাও—একই সুর ও স্বরের ধ্বনি—

.

তবু, মানুষ বলে পরিচয় দিও, মানুষের কাছে।

(আমাকে : বিশ্বনাথ মণ্ডল)

আ.

শ্রমিকের ঘামে ভিজে গেছে

কলকারখানা সব

ঘামের দামের সাথে নেবে

জান্তব রাজার শব।

(জান্তব রাজার শব : মামুন রাশেদ)

ই.

‘একটি বুনো ষাড় চষে বেড়াচ্ছে মাঠ

তছনছ করছে মাঠের শোভা

হরিৎ ফসল।

ধারালো ক্ষুরের যথেচ্ছ আঁচড়ে

ক্ষত বিক্ষত করছে মাটির হৃদপিণ্ড

উপড়ে ফেলছে ক্রমে ফসলের মৌলিক শিকড়।

ছিন্নভিন্ন করছে লতা গুল্মের নিবিড় বন্ধন।

(ষাড় : মুশতাক হাবভাত)

ঈ.

‘আমি সখিনা, জয়গুণ আর

উমেছার গান

চিরদিনই গাইবই।

আমি রুস্তম, সেলিম আর

ফরিদ আলীর কথা বলবই।

আমি লিখবই

সর্বহারা শোষিত জনাতার কথা।

(যাত্রা মোর শুরু হলো)

.

‘যাত্রা মোর শুরু হল’ শিরোনামে যে কবিতাটি কবি শিব শংকর কারুয়া একদা লিখেছিলেন;  সেই যাত্রায় এখনো সক্রিয়ভাবে জারি রেখেছেন প্রাক্তন এই ছাত্র ইউনিউনকর্মী শিব সংকর কারুয়া। শিবু শহীদ পরিবারের সন্তান।’ দিনটি ছিল বৈশাখের ২৬ তারিখ, ১৩৭৮।

শিবু লিখেছেন, ‘আমার বয়স তখন চার বৎসর। চার বৎসরের একটি শিশুর সামনে মৃগী নদীর হাঁটু সমান জলে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয় আমার বাবা, বাবার বন্ধু নিবারণ চন্দ্র সাহা, মহেন্দ্র নাথ দে-সহ অন্য পাঁচ জনকে।’২৯

সেদিন ভাতশালা ইউনিয়নের ঝাউগড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত মৃগী নদীতে যে রক্তের ধারা নেমেছিল তা জড়িয়ে-ছড়িয়ে মিশেছে তের শত নদীর বাংলাদেশে।।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, শেরপুর জেলা সংসদের প্রথম সন্মেলন উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা ‘প্রস্তুতি’ প্রকাশিত হয় শিব শংকর কারুয়ার প্রযত্নে ১৯৮৬ সালের ৪ নভেম্বরে। প্রস্তুতির কাঠ খোদাই প্রচ্ছদ করেছেন বিজন কর্মকার।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে যেয়ে শাসকদের রোষানলে পড়ে শাসকেরা বিপ্লবীদের বন্দী করে রাখত আন্দামান দ্বীপে। সেই দ্বীপে বন্দ্বী থাকাকালীনে নানা স্মৃতি ও ঘটনা নিয়ে বিপ্লবী রবি নিয়োগী ‘প্রস্তুতি’তে লিখেছেন—‘মুক্তিতীর্থে আন্দামান’—একটি স্মৃথিচারণ।

রবী নিয়োগী লিখেছেন, ‘…সেলুলার জেল রূপান্তরিত হয় মার্ক্সীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই সেলেই পড়াশুনা, আলাপ আলোচনা, রাজনৈতিক ক্লাশ, বিভিন্ন দিবস পালন, খেলাধুলা—এমন কি নাটক করা প্রভৃতি কাজগুলো পুরোদমে শুরু হয়।’

প্রস্তুতিতে আরো ছিল সত্যেন সেনের উপন্যাস ‘উত্তরণ’ নিয়ে সুধাময় দাসের আলোচনা, ছিল সাইফুল ইসলামের ‘শিক্ষা সুযোগ নয়—অধিকার’ ও এম এম আকাশের দীর্ঘপ্রবন্ধ ‘আইএফএম বনাম অর্থমন্ত্রী’। এ ছাড়া কবিতা লিখেছেন—মহাদেব সাহা, রনজিত নিয়োগী, শাহীন ও বৃতেন্দ্র মালাকার।

১৯৮৩ সালে শেরপুর ছাত্র কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে যে সাহিত্য সংকলনটি প্রকাশিত হয় তার নাম ‘রক্তপদ্ম’, সম্পাদক সেলিম আল জাহান। বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত ওই সংকলনে লেখেন—গঙ্গেশ চন্দ্র দে, মাহমুদ দিদার, সৌমিত্র শেখড় দে-সহ স্কুল-কলেজের অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা।

অন্যদিকে, শেরপুর জেলা ছাত্র সমিতি গঠিত হয় ১৯৮৬ সালে। তাদের উদ্যোগে প্রকাশিত সাময়িকী ‘কংস’ প্রকাশিত হয় মামুন রাশেদেন সম্পাদনায় ১৯৯০ সালে। এই সংখ্যায় রবী নিয়োগী লিখেছেন স্থানিক রাজনৈতিকতা নিয়ে তথ্য বহুল একটি নিবন্ধ, আর মোস্তফা কামালের ‘শেরপুরের উপভাষা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধ। এ ছাড়া কবিতা লিখেছেন—তালাত মাহমৃদ, স্মিতা সারথী রফিকুল ইসলাম ও খন্দকার তাজমিনুর।

এই দশকের শেষের দিকে গঠিত হয় আগামী সাহিত্য অঙ্গন। ‘অংকুর’ আগামীর মুখপত্র। গোটা দুয়েক সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন—তুলশী নাগ, সুদীপ নন্দী, বিপ্লব দাম ও সুব্রত রায়। অঙ্কুরের প্রচ্ছদ ও ব্লক করেন তুলশী নাগ স্বপন।

তুলশী আটের দশকে পাতাবাহারের মুখপত্র ‘প্রতিধ্বনি’রও সম্পাদক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। অঙ্কুরে মলয় মোহন বল ‘শেরপুরে নাট্যচর্চা’র ইতিহাস নিয়ে চমৎকার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এ ছাড়া কবিতা লিখেছেন—মানিক নাগ, বৃতেন্দ্র মালাকার, কমল চক্রবর্তী, জাহাঙ্গীর আলাম ও শামীম এজাজ।

(চলবে)

…………………

পড়ুন

কবিতা

রাংটিয়া সিরিজ : জ্যোতি পোদ্দার

তিলফুল : জ্যোতি পোদ্দার

জ্যোতি পোদ্দারের কবিতা

প্রবন্ধ-গবেষণা

টাউন শেরপুরে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা

১ম পর্ব । ২য় পর্ব । ৩য় পর্ব । ৪র্থ পর্ব । ৫ম পর্ব । ৬ষ্ঠ পর্ব । ৭ম পর্ব । ৮ম পর্ব । ৯ম পর্ব । ১০ পর্ব । ১১তম পর্ব । ১২তম পর্ব । ১৩তম পর্ব । ১৪তম পর্ব । ১৫তম পর্ব । ১৬তম পর্ব । ১৭তম পর্ব । ১৮তম পর্ব । ১৯তম পর্ব । ২০তম পর্ব

About The Author

শেয়ার করে আমাদের সঙ্গে থাকুন...