শিশুতোষ উপন্যাস, ধারাবাহিক—পর্ব ৮
নিলেশ ও ছোট্ট ভূত
আফরোজা অদিতি
নিলেশ ও ছোট্ট ভূত
ওদের বেড়ানোর পালা শেষ। গোছগাছ শেষ, আগামীকাল যাওয়ার দিন। কিন্তু যাওয়া পিছিয়ে গেল একদিন। দাদিমা বলেছেন, আগামীকাল চৈত্রসংক্রান্তি, ঐ দিন কোথাও যেতে নেই। আগামি পরশু বছরের পহেলা দিন, ঐ দিনও যেতে নেই, তবুও ঐ দিন যাবে তোমরা।
মা তো দাদিমার কথা সাধারণত শোনেন না। এইদিন কেমন করে শুনে ফেললেন, ভেবে পায় না নিলেশ। যেমন করেই হোক যাওয়া একদিন পিছিয়ে গেল, এতেই আনন্দ নিলেশের। আনন্দে ওর পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছা করছে।
ওর ঢাকা শহরে থাকতে ভালো লাগে না। যানজটে যাওয়া হয় না কোথাও। ঢাকা শহরে মাঠ পাওয়া যায় না কাছেপিঠে যে খেলতে যাবে, সেটাও হয় না আর খেলাও হয় না। শুধু স্কুল-কোচিং-বাসা, বাসা-কোচিং-স্কুল করতে ভালো লাগে না ওর।
অনেক অনেক পড়া, অনেক অনেক হোম-ওয়ার্ক—এতোটা পড়তে, হোম-ওয়ার্ক করতে ভালো লাগে না। মাঝেমধ্যে খেলতে ইচ্ছা করে। শুধু পড়ার বই না, কখনো কখনো গল্পের বই কিংবা অন্য কিছু পড়তে ইচ্ছা করে। বই পড়তে লাইব্রেরিতে যাওয়া হয় না! যেতে-আসতে অনেকটা সময় লেগে যায় বলে লাইব্রেরিতে যেতে দিতে চান না মা।
ওদের এই গ্রাম এখনো পরিচ্ছন্ন, বাতাসে দুষণ নেই, আকাশ নীল, গাছের পাতাগুলো সবুজ। এক দৌড়ে বাইরে গেল নিলেশ, সঙ্গে অভীক। ডিংডং তো থাকবেই। অভীক দেখতে পায় না ডিংডংকে। অভীকের সামনে ওর সঙ্গে কথাও বলে না নিলেশ।
একদিন কথা বলেছিল, তা দেখে ফেলেছিল আর বলেছিল, ‘একা একা কথা বলছো কেন?’ চমকে উঠেছিল নিলেশ, কিন্তু ওর কথার জবাব দিতে পারেনি।
তবে সামলে নিয়েছিল নিজেকে। বলেছিল, ‘ঐ একটা কথা মনে পরে গেল তাই বলছি।’ ওর খুব খারাপ লাগছিল—এই মিথ্যে বলার জন্য, কিন্তু ডিংডং-এর জন্য এটুকু তো করতেই হবে!
ওরা বড় রাস্তায় এসে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করে। ডিংডং বলেছিল, নদীর পাড়ে যেখানে অভীককে পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে নিয়ে গেলে সবকিছু মনে পড়তে পারে অভীকের! নিলেশ নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে যেখানে অভীককে পেয়েছিল, সেখানে গিয়ে বসে।
অভীককে বলে, ‘বসো অভীক।’
নদীর পাড়ে বসে আছে ওরা। সূর্য ডুবু ডুবু করছে। বিদায়ী সূর্যের আলো পড়েছে বাঁশের পাতায়, নদীর জলে। নদীজলে সূর্যের আলো পড়ে চমৎকার লালচে এক আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে, দেখতে খুব ভালো লাগছে, চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে!
নৌকা চলছে, মাঝি গান গাইছে। নদীতে ঢেউয়ের শব্দ, বাতাসে বাঁশপাতার ঝিরিঝিরি শব্দ। নদীজলের শব্দ আর বাঁশপাতার শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে নতুন অভিনব শব্দ হয়ে ভেসে আসছে নিলেশের কানে। হঠাৎ নিলেশের মনে হলো, ও যদি নৌকা বাইতে পারতো, তাহলে নদী পার হতো। খুব নদী পার হতে ইচ্ছা করছে ওর।
‘চিন্তা করছো কেন বন্ধু, চলো আমি তোমাদের নৌকায় ঘুরিয়ে আনবো।’ ডিংডং বলে।
খুব খুশি হলো নিলেশ, কিন্তু অভীক কী যাবে? অভীক নৌকায় যাবে না বলল, ওর ভয় করে।
অভীক বলল, ‘তুমি ঘুরে এসো, আমি এখানে বসে থাকি, নদীতে ভয় পাই। আগে তো পেতামই, এখন আরো বেশি করে ভয় পাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে, থাকো, কিন্তু এখান থেকে কোথাও যেয়ো না।’ মাথা নেড়ে নিলেশের কথায় সায় দিলো অভীক। যাবে না।
নিলেশ খুশিতে নেচে নেচে ডং-এর হাত ধরে পানির কাছে পৌঁছে গেল। ওখানে গিয়ে একটা নৌকা দেখতে পেলো। নিলেশ উঠলে ছেড়ে দিলো নৌকা।
নৌকা বাইছে ডিংডং, কিন্তু অভীক দেখতে পাচ্ছে না। অভীক দেখতে পাচ্ছে নৌকা চলছে একা একা! নিলেশ নৌকাতে উঠে পানি নিয়ে খেলা করছে, আঁজলা ভরে পানি তুলছে আর ফেলছে!
নিলেশের কবিতা মনে এলো, কিন্তু খাতা নেই। মনে মনে আউড়ে গেল, যতোটুকুন সম্ভব মনের মাঝে লিখে রাখলো কবিতা।
নৌকা চলে নৌকা চলে
কথা বলে জল
জলের বুকে রবির আলো
কেমন লাগে বল…
নিলেশের মন উদাস। মনে পড়ছে মায়ের কথা, মায়ের ছোটবেলার কথা। মা বলেছেন, মায়ের বয়স যখন দুই/তিন, তখন যুদ্ধ লেগেছিল। তখন এই নদী ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। দাদার বাড়ি আর নানার বাড়ি পাশাপাশি ছিল। মায়ের নানা-নানি, বাবা ছিল যুদ্ধে।
যুদ্ধে মায়ের বাবা মারা গিয়েছিল, আর দেশ স্বাধীনের পর মায়ের নানা-নানি গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়েছিলেন। তারা সেই যে চলে গিয়েছিলেন, আর ফিরে আসেননি। মা বড় হয়েছে নানা-নানি আর মায়ের বোনের কাছে। মা যে বোনের কাছে বড় হয়েছেন, সে বোনও মারা গিয়েছেন। অসুখ হয়েছিল।
মনে মনে বলে নিলেশ, ‘খালার আত্মা যেন শান্তি পায়।’
নিলেশকে চুপ করে থাকতে দেখে ডিংডং বলে, ‘বন্ধু কষ্টের কথা মনে করো না, আনন্দ করো। মনে রেখ, আনন্দ সবসময় পাওয়া যায় না, আনন্দ সবসময় আসে না। তাই মনের আনন্দটুকু কষ্টের কথা মনে করে নষ্ট করতে নাই। তুমি চেয়ে দেখ নদীর ঢেউ, ঢেউয়ের মন মাতানো ছন্দ। বাঁশবনের ছায়া, বাতাসে বাঁশপাতার ঝিরিঝিরি শব্দ, আর তোমার এই নৌকা-ভ্রমণ আজকের এই দিন। দিনের এইসব কথা তুমি কী আর অন্যদিন পাবে, পাবে না। তাই যা দেখছো মন-প্রাণ ভরে দেখে নাও, যা শুনছো তা শুনে নাও, আনন্দ করো।’
ডং-এর কথা ভালো লাগলো নিলেশের, শুধু ভালো নয়, খুব ভালো লাগলো।
নিলেশ ওর নাম শুনে তীরের দিকে তাকিয়ে দেখে অনেক লোক জড়ো হয়েছে সেখানে। নিলেশ ডিংডংকে নৌকা ফেরাতে বলে। ওরা ফিরে এলে জড়িয়ে ধরেন মা।
কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেন ‘এখানে আর থাকবো না, আসবোও না এখানে। এখানে তুমি এলেই একটা না একটা কাণ্ড বাধাও। ভালো লাগে না আমার।’
মা একটু চুপ করে চোখ মুছে বলে, ‘তুমি যে মাঝ নদীতে গিয়েছ, তুমি কি সাঁতার জানো। এই রকম একলা একলা…।’
মা কথা শেষ করে না। মায়ের বুকে মুখ রাখে নিলেশ। কিছুক্ষণ আদর খেয়ে বলে, ‘মা আমাকে ক্ষমা করো। তুমি মিথ্যেই ভয় পেয়েছ, আমি তো একা…।’ ডিংডং ওর হাত ধরে টান দেয়। কথা শেষ না করে বলে, ‘মা অভীক কোথায়?’
‘ঘরেই আছে, ওর কাছেই তো শুনলাম। এখন ও ঘুমুচ্ছে। শরীর বোধহয় এখনো সারেনি।’
নিলেশ ঘরে চলে যায়। ওরা যে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে, ঐ বিজ্ঞাপনটি বের হয়নি এখনো। জেলা শহরের কাগজ, সময় নেয় একটু।
নিলেশ কিছুক্ষণ ভাবে তারপর মাকে বলে, ‘মা ফেসবুকে স্ট্যাটাচ দিলে কেমন হয়।’ এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রেগে আগুন মা। মায়ের আগেই রাগ হয়েছিল সেটি প্রকাশ পেলো এখন।
‘তোমার না ফেসবুকিং বারণ।’ মায়ের কণ্ঠে রাগ গনগনে আগুন-মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে। মায়ের রাগ দেখে মুখ শুকিয়ে যায় নিলেশের।
শুকনো কণ্ঠে বলে, ‘মা আমি করবো না, আপুকে বললে করবে। না-হলে চাচ্চুকে বললে ফেসবুকিং করে দিবে ওরা! ফেসবুকে দিলে একটা রেজাল্ট পাওয়া যাবে।’
মায়ের রাগ একটু কমেছে মনে হলো নিলেশের; কারণ মা বললেন, ‘দেখা যাবে।’
অভীকের ওপর মনে মনে চটে রইলো নিলেশ। ওকে না-করার পরেও, বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে বলে দিয়েছে। মাকে কষ্টে ফেলেছে! মাকে কষ্টে ফেলাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না নিলেশ। কিন্তু করার তো কিছু নেই।
ওকে চিন্তিত দেখে ডিংডং বলে, ‘অভীক বন্ধুর ওপর রাগ করো না, ও ভয় পেয়ে এমন করেছে। ওকে কিছু বলো না। আর তুমি চিন্তা করো না বন্ধু, আমি অভীক বন্ধুর খবর এনে দিবো।’
‘কেমন করে আনবে। ও তো কিছুই বলতে পারছে না।’
‘তবুও পারবো। একটু ধৈর্য ধরো। অভীককে ওর বাবা-মায়ের নাম, বাড়ির নম্বর, স্কুলের নাম সবকিছু মনে করানোর চেষ্টা করবো আমি।’
ডিংডং-এর হাত ধরে নিলেশ। বলে, ‘তাই করো ডিংডং, তাই করো।’ ডিংডং মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। তবে আমি ঢাকা গেলে সব খবর বের করে দিতে পারবো।’
‘তাই। আমি স্বস্তি পেলাম ডং।’ নিঃশ্বাস ফেলে বলল নিলেশ।
(চলবে)
…………………
পড়ুন
কবিতা
গল্প
শিশুতোষ উপন্যাস
নিলেশ ও ছোট্ট ভূত : পর্ব ১, পর্ব ২, পর্ব ৩, পর্ব ৪, পর্ব ৫, পর্ব ৬, পর্ব ৭, পর্ব ৮
মুক্তগদ্য
ভ্রমণ
অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণকথা – ২য় পর্ব
দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও রাণী রাসমণি
দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও রাণী রাসমণি – ২য় পর্ব
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা
ইষ্টিমিষ্টি ছড়া
সুনীল শর্মাচার্যের ভারতীয় হালচাল
ছোট ছেলে বড় ছেলে