
খুচরো কথা চারপাশে
পৌষ পার্বণ নিয়ে
সুনীল শর্মাচার্য
পৌষ পার্বণ নিয়ে
পৌষ পার্বণ দেশে দেশে
বাঙালিদের কাছে মূলত নতুন ফসল তোলার উৎসব পৌষ পার্বণ। মোগল আমল থেকেই এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। পুরনো ঢাকায় মকর সংক্রান্তি ‘সাকরাইন’ নামে পরিচিত। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই দিনটিতে নানান উৎসব পালিত হয়।
নেপালে মকর সংক্রান্তি ‘মাঘি’, থাইল্যান্ডে ‘সংক্রান’, মায়ানমারে ‘থিং ইয়ান’, কম্বোডিয়ায় ‘মহাসংক্রান’ নামে পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে মেলা বসে। বীরভূমের কেন্দুলি গ্রামের জয়দেব মেলা ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার সাগরদ্বীপের গঙ্গাসাগর মেলা বিখ্যাত।
পৌষ পার্বণ নিয়ে
আইলা মকর কড়কড়ি
পৌষ সংক্রান্তি বাঙালি তথা ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আদি উৎসব। সকালে উঠেই সূর্য স্নানের পর পূজার্চনা চলে এবং এসবের পর আর সমস্ত কিছু ছাপিয়ে পেটপূজো। চালের পিঠে পেটে না-পড়লে অনুভব হয় না পৌষ সংক্রান্তির আমেজ।
মকর পরবের গুরুত্ব বোঝা যায় এক প্রবাদ থেকে। সুবর্ণরৈখিক ভাষায় প্রবাদটি হলো : ‘আইলা মকর কড়কড়ি, গেলা মকর ঋণ করি।’ মানে মকর তাড়াতাড়ি এলো। কিন্তু গেল গৃহস্থকে একগাদা ধার করিয়ে। বাঙালির রসনার বিলাস এমনই।
মাঠের নতুন ধান ঘরে উঠলেই শুরু হয়ে যায় পিঠের প্রস্তুতি। গৃহিণীর মুখে চওড়া হাসি। উৎসবের আগে ঘটা করে নতুন ধান ঝাড়াই-মাড়াই করে কুটিয়ে নেওয়ার পালা। তবে সময় বদলেছে। এখন সর্বত্রই ধান ভাঙানোর কল।
‘অ বউ ধান ভানে রে ঢেঁকিতে পার দিয়া, বউ নাচে ঢেঁকি নাচে হেলিয়া দুলিয়া, বউ ধান ভানে রে’ গ্রাম-বাংলার সেই গান আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। যেটুকু ঢেঁকির ব্যবহার থাকল তার পরে, তাও এই শীতের কালে। চালের আটা করার জন্য ব্যবহার হতো ঢেঁকি। এখন তো তা-ও দেখা যায় না।
মকর উৎসব কাছাকাছি এলেই শুরু হয়ে যায় পিঠে তৈরির কর্মসূচি। আগের দিন রাতে চাল জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। ভোরের আলো না-ফুটতেই মা-কাকিমা-রা চাল নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন ঢেঁকি ঘরে।
দু’জন অনবরত ঢেঁকিতে পাড় দিতো, আর সেই তালে তালে গর্তের মধ্যে চাল ঢালা। এই গর্তকে বলে গড়। ঢেঁকির মাথা যখন গড়ের ওপরে থাকবে তখনই গর্তের মধ্যে হাত দিয়ে চাল দেওয়া বা আটা তোলার কাজ সেরে নিতে হয়। এভাবেই চলত সারাদিন চাল কোটানোর পালা।
সন্ধ্যার মধ্যে আটা তৈরি করে ফিরতে হয় বাড়িতে। তার পর তৈরি হতো নানাবিধ পিঠে। পিঠে এখনো পুরো হারিয়ে যায়নি, কিন্তু চাল কোটার এই দৃশ্য প্রায় চোখেই পড়ে না!
পৌষ পার্বণ নিয়ে
এখনো কিছু আছে
পৌষ মাসের শেষে গ্রামের হাটগুলোতে গেলে উৎসবের আমেজ বেশ অনুভব করা যায়। শিউলিদের (যারা খেজুরের গুড় তৈরি করে) সদ্য তৈরি করে হাটে নিয়ে আসা নলেন গুড় কেনার জন্য লম্বা লাইন। পাটালি, নারকেল বিক্রেতাদের ব্যস্ততা।
মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে গুড়, নারকেল, চালগুঁড়ো পাঠাবার রীতি দক্ষিণবঙ্গের বাঙালি পরিবারগুলোতে এখনো হারিয়ে যায়নি। কৃষি প্রধান বাংলাতে পৌষ সংক্রান্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশেষ কিছু লোকাচার।
অগ্রহায়ণ মাসে মাঠ থেকে ফসল ঘরে ওঠে। সংক্রান্তির দিন উঠোনে ধানের গাদার সামনে আলপনা এঁকে কৃষিদেবীর আরাধনা করা হয়।
পৌষ সংক্রান্তির দিন সকাল থেকেই সাজ সাজ রব গৃহস্থের বাড়িতে। হরেক রকমের পিঠে তৈরিতে ব্যস্ত গৃহিণীরা। পরদিন উঠোনে বসে মাঘের মিঠে রোদ গায়ে মেখে নলেন গুড় সহযোগে নারকেল পিঠে, চিতই পিঠে কিংবা পাটিসাপটা খাওয়া রসনা বিলাসী বাঙালির কাছে এক অপার্থিব অনুভূতি।
একসময় পৌষ মাসে নাকি সারা পাড়ায় ঢেঁকিতে চাল কোটার শব্দ শোনা যেত। মিক্সি মেশিনের যুগে সেই শব্দ অবশ্য হারিয়ে গেছে। কালের নিয়মে আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে অনেক লোকাচার, পার্বণ।
তবে বাংলার গ্রামীণ সমাজে পৌষ পার্বণের অনেক পুরনো রীতি আজও পালন করা হয়। বেঁচে থাকুক বাংলা ও বাঙালির আবেগ মিশ্রিত এই পার্বণগুলো।
পৌষ পার্বণ নিয়ে
পিঠেপুলির স্মৃতি
শৈশবের শীতকালে আমরা খেয়েছি কত ধরনের পিঠে। মা-মাসী-পিসিরা তৈরি করতেন সেইসব পিঠে। স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে সড়াই পিঠে, গোকুল পিঠে, পাটিসাপটা, পুলি, দুধপুলি, মুগপুলি, ক্ষীরপুলি, ভাপাপুলি, রাঙা আলুর পান্তুয়া, রসবড়া, নলেন গুড়ের পায়েস, চিতাই পিঠে, চন্দনকাঠ (রান্না পিঠে), চুসিপিঠে আরো কত কী সব। খেয়েছি চিতাইপিঠের পায়েস। আহা, কী স্বাদ!
মনে পড়ে খুব মালপোয়ার কথাও। ভাসা ভাসা স্মৃতি। আমার মা দুধের মধ্যে দিতেন ময়দা, তার পর দেখেছি সেগুলো রুটির মতো করে ঘিয়ে ভাজতেন। ভাজা শেষ হলে ভাইবোনদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেত।
প্রথমে যে মালপোয়া নিতো সে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত ডায়লগ ‘মাসিমা মালপোয়া খামু’ বলে দৌড়ে পালাত। আবার ঘুরেফিরে যখন আসত, তখন অনেকগুলো মালপোয়া ভাজা হয়ে গেছে।
পৌষ মাসের শেষের দিনে মানে পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তিতে পিঠে বানানোর ধুম পড়ে যেত বাড়ি বাড়ি। এ-এক মস্ত পর্ব। এখন আর তেমনটা দেখি না। পিঠে খাওয়ার পাশাপাশি ঘুড়ি ওড়াতেও দেখতাম এদিন। সে-সব এখন স্মৃতি।
নতুন ধানের চাল, খেজুরের গুড়, নারকেল, দুধ এবং পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠে তৈরি হতো ঘরে ঘরে। আমাদের বাড়িতে এ-সব তৈরি করতেন আমার মা এবং জেটি মা দু’জনে মিলে। বিশেষ করে, নলেন গুড়ের পায়েস খাওয়ার কথা—এই মধ্য জীবনে এসে বারে বারে মনে জাগছে। আহা, কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে পৌষ পার্বণ!
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প: সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হাল্কা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
রাজনীতি বোঝো, অর্থনীতি বোঝো! বনাম ভারতের যুবসমাজ
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
13 thoughts on “পৌষ পার্বণ নিয়ে”