খুচরো কথা চারপাশে
ফেসবুক, কবি, বুনো ফুল এবং আমিও পলিটিক্যাল
সুনীল শর্মাচার্য
ফেসবুক, কবি, বুনো ফুল এবং আমিও পলিটিক্যাল
ফেসবুক নিয়ে
ফেসবুকে লিখি। দেখি আমার লেখা তেমন পাঠ্য নয়। মতামত ও পছন্দের যোগ্য নয়। ভাবি, আমি আমার মতো আছি। ভাবি, আমার রচনা জনপ্রিয় নয়। হয়তো অপাঠ্য! তবু লিখি। ব্যর্থ লেখকের অব্যর্থ অনুভূতি—যা আমার একান্ত ব্যক্তিগত। অন্যের নয়।
২
ফেসবুকে সুন্দর, সুন্দরীর রঙ্গ দেখে হাসি পায়। নিজের মুখ দেখিয়ে, গুছিয়ে, সাজিয়ে ৫০০ লাইক। ৩০০ মন্তব্য!
৩
ফেসবুক শুধু মুখ দেখানো নয়। উল্টোপাল্টা লেখাও নয়। ফেসবুক হোক চিন্তা-চেতনার উপলব্ধি। ব্যক্তিক পরিসর ভেঙে সামগ্রিক চেতনায় বিকশিত হোক।
৪
ভাবছিলাম, নূপুরের দাম হাজার টাকা হলেও, তার স্থান কিন্তু পায়ে। আবার টিপের দাম এক টাকা হলেও তার স্থান কিন্তু কপালে…
ইতিহাস সাক্ষী আছে, নুনে কখনো পোকা ধরে না, কিন্তু মিষ্টিতে প্রতিদিনই তো পোকা ধরে, আবার পিঁপড়েরাও ছাড়ে না।
মোমবাতি জ্বালিয়ে মৃত মানুষকে স্মরণ করা হয়, আর মোমবাতি নিভিয়ে জন্মদিন পালন করা হয়। মানুষ সোজা পথে চলতে চায় না, বাঁকা পথে চলতে সবাই পছন্দ করে। সেজন্যই মদ বিক্রেতাকে কারো কাছে যেতে হয় না, অথচ দুধ বিক্রেতাকে বাজারে যেতে হয়, বাড়ি বাড়ি যেতে হয়। আমরা দুধ বিক্রেতাকে সর্বদা বলি, দুধে জল মেশাননি তো? অথচ মদে মানুষেরাই জল মিশিয়ে খায়।
আজ পর্যন্ত মানুষকে এইটুকুই চিনলাম, জানোয়ার বললে ক্ষেপে যায়, কিন্তু বাঘের বাচ্চা বললে খুশি হয়। অথচ দুটোই পশুর বাচ্চা!
মানুষ বড়ই আজব…!
.
কবি হতে গেলে
কবি হতে গেলে কী কী দরকার, সে সম্পর্কে দু’জন শাস্ত্রকার কী বলেছেন, পড়ুন :
দণ্ডী বলেছেন,
‘নৈসর্গিকী চ প্রতিভা, শ্রতঞ্চ বহু নির্মলম।
অমন্দশ্চাভিযোগ্যে স্যাঃ কারণং কাব্যসম্পদ:’
(অর্থাৎ স্বাভাবিক প্রতিভা চাই, নানা বিদ্যার জ্ঞান আর নিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলন চাই, এসব একসঙ্গে থাকা চাই।)
মন্মাটাচার্য বলেছেন,
‘শক্তির্নিপুণতা লোকশাস্ত্রকাব্যাদ্যবেক্ষণাৎ।
কাব্যজ্ঞশিক্ষয়াভ্যাস ইতি হেতুস্তদুদ্ভবে।।’
(অর্থাৎ কবির পর্যবেক্ষণ শক্তি চাই, নানা শাস্ত্রজ্ঞান চাই, অন্য কবিদের কাব্য পড়া চাই,
তবেই নিপুণতা।)
ওরে বাব্বা! আমার তো এসব কিছুই নাই।
অতএব, কাব্য বিদায়! কবিতা লেখা, ঠিক কবিতা লেখা সত্যিই কঠিন হ্যায়!
এর মধ্যেও কবি শহীদ কাদরীর কথা মনে পড়ল—‘একজন বড় কবি এবং একজন ছোট কবির মধ্যে Craftsmanship বা Skill-এর তফাৎ হয় না। তফাৎটা হয় অভিজ্ঞতার। বিভিন্ন
শেকড় বা রেঞ্জকে কতখানি স্পর্শ করেছে।’…
কোনো কোনো কবির প্রয়োজন হয় একটা ভালো কবিতা লেখার আগে দশটা মাঝারি ধরনের কবিতা লেখা। মানে একটাই If you want to be strong, Learn how to fight alone.
.
বনের নির্জনে ফোটা বুনো ফুল
বইমেলা এলে বই প্রকাশের ধুম পড়ে যায়। নতুন লেখকরাও নড়েচড়ে বসে। সীমিত ক্ষমতায় বই প্রকাশ করে। এইসব বইয়ে অনেক দুর্বল, অপরিণত লেখা থাকে। বিরক্তকর!
ভাবি, বই প্রকাশের আগে লেখালেখির কৌশল জানা দরকার। দরকার অসংখ্য অনুশীলন। একটা ফালতু লেখা প্রকাশ মানে হলো, সময় নষ্ট করা। অর্থ নষ্ট করা। মেধা নষ্ট করা। ফাইনালি পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা করা।
এই বিষয়টি নিয়ে রুশদি বলেছেন—‘ইতোমধ্যেই পৃথিবীতে বহু বই লেখা হয়ে গেছে। সারাবিশ্ব এখন বইয়ের ভেতর ডুবে আছে। আমরা যদি প্রতিদিনও একটি করে মাস্টার পিস পড়ি, তাহলে যতগুলি মাস্টার পিস এর মধ্যে লিখিত হয়েছে, প্রতিদিন একটি করে পড়েও সেসব আমরা শেষ করতে পারব না। এ অবস্থায় আপনি যদি বইয়ের সেই পর্বতে আরো একটি বই যোগ করতে চান, আমার মনে হয়, কাগজ তৈরির গাছগুলিকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।’
তাই ভাবছি, লেখার জগৎ থেকে অবসর নেব। বৃথা সময় নষ্ট, অর্থ নষ্ট, মেধা নষ্ট, শ্রম নষ্ট আর নয়। বনের নির্জনে ফোটা বুনো ফুল আমি, বনেই, অন্তরালে ঝরে যাব!
.
আমিও পলিটিক্যাল
জীবনের এই বিপর্যয়ে আমার শুধু শব্দের গিমিকে আত্মগোপন করার ইচ্ছে নেই। তাই সামাজিক-রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সরাসরি ছড়া/কবিতায় তুলে এনেছি।
আমার এই সময়ের কবিবন্ধুরা সামাজিক-রাজনৈতিক-ঘাত-প্রতিঘাতের ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। প্রতিবাদের ভাষাকে কবিতা/ছড়ায় স্থান দিলে নাকি কবিতা/ছড়া
শ্লোগানধর্মী হয়ে উঠবে, রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে।
তারা তিরিশের যুগে ফিরে যেতে চাইছেন। তখনকার কবিদের মতো কবিতা/ছড়ায় সংশয়, হতাশা, নিরাশ্রয়তার শূন্যতাবোধ, রাজনীতি-বিমুখ একাকিত্বকে এনে এক একজন মালার্মে হতে চাইছেন!
এখন দেখি, প্রচার মাধ্যম-নির্ভরতাই কবিদের সাফল্য অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার বলে মনে করেন। অথচ, কোনো কবিকে প্রচার-মাধ্যম সহায়তা করে না ‘কবি’ হয়ে উঠতে। তারা ভুলে গেছেন, নিজের যোগ্যতায় সফল কবি হয়ে উঠতে হয়। কবিতা কখনো পণ্য হয়ে উঠতে পারে না। আর কবিতা/ছড়া নিয়ে চিন্তা-ভাবনার বিভিন্নতা থাকলেও, সমসাময়িক কালের সমাজজীবন, সাধারণ মানুষ, মনের গভীরতর তল থেকে উৎসারিত সংবেদনশীলতার উষ্ণ প্রস্রবণ প্রকৃত কবিকে অনুপ্রাণিত করে। আমাকেও করে।
কিন্তু ইদানীং এসবের অনুপস্থিতি সমৃদ্ধ কবিতা রচিত হচ্ছে, আর তা প্রকাশিত হচ্ছে বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকাগুলিতে। কারণ এই ধরনের পত্রিকাগুলির কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই। পৃথিবীতে মানব সভ্যতাবিরোধী শক্তি যতই মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক, লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে বেড়াক, শাসকশ্রেণি ফ্যাসিবাদী প্রবণতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ুক—তাতে এ-কালের কবিদের কিছু আসে যায় না।
তারা সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়কে গুরুত্ব না-দিয়ে বিশুদ্ধ কবিতা রচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। এসব একদিন সাধারণ মানুষ, সাধারণ পাঠক ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কেননা, ছড়া/কবিতার কাছে মানুষ আশ্রয় চায়, মুক্তি খোঁজে, সান্ত্বনা খোঁজে, মনবল খোঁজে।
আমরাও কিছু কবিবন্ধু রাজনীতির ব্যাপারে গাত্রে চুলকানি অনুভব করেন। রাজনীতি ব্যাপারটা ভালো লাগে না। তাঁরা কেউ কেউ বলেন, তাঁরা কোনো পলিটিক্সের মধ্যে নেই। তাঁরা পলিটিক্স শব্দটার বাংলা জানেন না। সেটা হলো লোকনীতি, রাজনীতি নয়।
আপনি যদি পলিটিক্সের মধ্যে না-থাকেন, আপনি মানুষই নন। সব মানুষই পলিটিক্যাল। একজন গুহাবাসী সন্তও এক পলিটিক্যাল প্রাণী। আমিও পলিটিক্যাল!
…………………
পড়ুন
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
ভারতে চীনা দ্রব্য বয়কট : বিষয়টা হাল্কা ভাবলেও, সমস্যাটা কঠিন এবং আমরা
রাজনীতি বোঝো, অর্থনীতি বোঝো! বনাম ভারতের যুবসমাজ
ভারতে শুধু অমর্ত্য সেন নয়, বাঙালি সংস্কৃতি আক্রান্ত
ভারতের CAA NRC নিয়ে দু’চার কথা
ভারতের এবারের বাজেট আসলে অশ্বডিম্ব, না ঘরকা না ঘাটকা, শুধু কর্পোরেট কা
ইন্ডিয়া ইউনাইটেড বনাম সেলিব্রিটিদের শানে-নজুল
করোনা, ভারতীয় জনগণ ও তার সমস্যা
ধরি মাছ না ছুঁই পানি, ফেসবুক, কবিতা ও অন্যান্য
আমরা প্রত্যেকেই আজ ফ্যাসিস্ট এবং প.বঙ্গের বাঙালিরা
ফেসবুক, কবি, বুনো ফুল এবং আমিও পলিটিক্যাল
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের গ্রাম্য স্মৃতি
নিহিত মর্মকথা : সুনীল শর্মাচার্য
প্রয়াণগাথা : সুনীল শর্মাচার্য
1 thought on “ফেসবুক, কবি, বুনো ফুল এবং আমিও পলিটিক্যাল”